চাঁদপুরে জাহাজে নিহতদের বাড়িতে শোকের
- ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩:১৩
গ্রেফতার করে শাস্তি দিতে হবে। পাশাপাশি নৌপথের নিরাপত্তা বাড়াতে হবে।
নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার লাহুড়িয়া ইউনিয়নের এগারোনলি গ্রামের সালাউদ্দিন (৪৫) দীর্ঘ ২০ বছর জাহাজে চাকরি করেন। দীর্ঘ চাকরি জীবনে তিনি জাহাজের চালক ছিলেন। অভাবের সংসারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন তিনি। সংসারে মা, স্ত্রী, এক সন্তান ও দুই মেয়ে রয়েছে তার। এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দিশেহারা সালাউদ্দিনের পরিবার। গত ১৪ ডিসেম্বর বাড়ি থেকে কাজে যান তিনি। এ দিকে গত রোববার রাতের চাঁদপুরের হরিণা ফেরিঘাটের কাছে ডাকাতদের হাতে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছেন তার ছেলে নাইম। সালাউদ্দিনের বড় মেয়ে ইতি খানম বলেন, বাবাই ছিল আমাদের সংসারের একমাত্র আয়ের ব্যক্তি। বাবাকে হারিয়ে আমরা দিশেহারা।
এ দিকে জাহাজে হত্যাকাণ্ডের শিকার আমিনুর রহমান মুন্সীর (৪৮) বাড়িও নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার উত্তর লংকারচর গ্রামে। সংসারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি হিসেবে প্রায় ১২ বছর ধরে জাহাজে কাজ করেন তিনি। এক মেয়ে ও দুই ছেলে রয়েছে তার। গত ২০ ডিসেম্বর গ্রামের বাড়ি নড়াইল থেকে কাজে যান তিনি। পরিবারের উর্পাজনক্ষম ব্যক্তিদের হারিয়ে দিশেহারা দুই পরিবারের সদস্যরা। নিহতদের পরিবার ও এলাকাবাসীর দাবি, হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার করে শাস্তি দিতে হবে। পাশাপাশি নৌপথের নিরাপত্তা বাড়াতে হবে। নৌপথ অনিরাপদ হলে এ কাজের প্রতি মানুষের ভীতি বাড়বে বলে মন্তব্য করেন সবাই।
মহম্মদপুর (মাগুরা) প্রতিনিধি জানান, বয়স ১৬ বছর। নবম শ্রেণীতে পড়ে মাজেদুল ইসলাম। বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। স্কুল বন্ধের ছুটিতে পরিবারের আর্থিক সঙ্কুলান দিতে জাহাজে লস্কারের কাজ নেয় সে। ১১ দিন পেরোতেই তাকে হত্যার খবর আসে।
তিন মাস হয়েছে বিয়ে করেছে সজিবুল ইসলাম। এর আগে জাহাজে চাকরি করলেও স্ত্রীর মুখে হাসি ফোটাতে এবং পদোন্নতির আশায় আবার জাহাজে যান তিনি। বেতন বাড়বে আনন্দে সংসারজীবন কাটাবেন। এমন সময় তাকেও হত্যা খবর আসে পরিবারের কাছে।
মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার পলাশবাড়িয়া ইউনিয়নের এই দুই পরিবারে চলছে শোকের মাতম। তাদের পরিবার ভবিষ্যৎ নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। সজিবুল ইসলাম যশোবন্তপুর গ্রামের আনিচুর রহমানের ছেলে এবং সজিবুল ইসলাম পলাশবাড়িয়া গ্রামের দাউদ মুন্সীর ছেলে।
মাজেদুল ইসলামের মা মুক্তি বেগম জানান, আমার মাজেদুল কেবল নাইনে পড়ে। স্কুল বন্ধ দেছে। কইছিল মা, আমি এই বন্ধের সময় বসে না থাহে জাহাজে যাই। কিছু টাহা হবি। আমার মনি ওই যে গিলো, আর আলো না। ফোন দিছি বন্ধ কয়। আমার ছেলেরে হত্যার বিচার চাই।
সজিবুল ইসলামের পিতা দাউদ মুন্সী জানান, আমার মেঝ ছেলে সজিব। তিন মাস হইছে তারে বিয়ে দিছি। সে কোর্স করছে পরীক্ষা দিয়ে জাহাজের মাস্টার হবে। তার বেতন বাড়বি। মা-বাবা বউ নিয়ে সুখে থাকবে; কিন্তু তা আর হলো না।
স্ত্রী প্রিয়া বলেন, আমাদের নতুন বিয়ে হইছে। আমার স্বামী আমার মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছিল। সে বলছিল পদোন্নতি হলে বেতন বাড়বে। আনন্দে থাকব। এখন ভবিষ্যৎ নিয়েই আমি দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছি। সামনে কি কবর জানি না।
চাঁদপুরের হরিণা ফেরিঘাটের কাছে সারবোঝাই এমভি আল বাকেরা জাহাজে ক্রু সদস্যদের গলা কেটে নির্মমভাবে হত্যা ও আহতের ঘটনা ঘটে। এতে নিহত সাতজনের মধ্যে ছিল মহম্মদপুরের মাজেদুল ইসলাম (১৬) ও সজিবুল মুন্সী (২২)। পরিবারসহ গ্রামবাসী এই হত্যার দৃষ্টান্তমূলক বিচার চেয়েছেন।
চির অবসর নিয়ে ফিরলেন লাশ হয়ে
ফরিদপুর প্রতিনিধি জানান, দীর্ঘ ৪০ বছর জাহাজে চাকরি করে এ বছরই অবসরে যাওয়ার কথা ছিল গোলাম কিবরিয়ার (৬০)। বাড়ি ফিরে মেয়েকে বিয়ে দেবেন। পাত্র ঠিক করে রাখার পাশাপাশি বিয়ের দিন তারিখও ঠিক করে রেখেছিলেন। সেইসাথে নিজের অবসরে যাওয়ার আগেই চেয়েছিলেন আপন ভাগনেকে জাহাজের চাকরিতে ঢোকাবেন। মাত্র দুই সপ্তাহ আগে মামা-ভাগ্নে দু’জনে মিলে রওনা হন চট্টগ্রামে জাহাজের উদ্দেশ্যে। এরপর সেখান থেকে জাহাজে সারবোঝাই করে যাত্রা করেন চাঁদপুরের উদ্দেশে। পথে মেঘনা নদীতে ঘটে যায় বছর শেষের এক হৃদয়বিদারক ঘটনা।
গোলাম কিবরিয়ার বাড়ি ফরিদপুরের সদর উপজেলার গেরদা ইউনিয়নের জোয়াইড়গ্রামে। তিনি চাঁদপুরের আলোচিত ওই জাহাজের মাস্টার ছিলেন। স্ত্রী, দুই মেয়ে ও ছোট এক ছেলে রয়েছে তার। তার ভাগ্নে শেখ সবুজের (২৬) বাড়িও একই গ্রামে। তাকে তিনি সেখানে জাহাজের লস্কর হিসেবে কাজ দিতে নিয়ে যান। সবুজের বাবার নাম মো: অতাউর রহমান। ছয় ভাই চার বোনের মধ্যে সবুজ ছিল ছোট।
সরেজমিন গোলাম কিবরিয়া ও সবুজের বাড়িতে যেয়ে দেখা যায়, তাদের হত্যা করার খবর জেনে স্ত্রী ও মা কান্নার বিলাপ করছেন। নিহতদের পরিবারের অন্যান্যরাও শোকে বিহ্বল। নিহত কিবরিয়ার প্রতিবেশী মো: আবুল হোসেন, তিনি অত্যন্ত ভালো মানুষ ছিলেন। ক’দিন আগেও তিনি আমাদের বাড়িতে গিয়েছিলেন একটা দাওয়াতে। তখন বলছিলেন, মেয়ের বিয়ের জন্য জানুয়ারিতে আসব। তোমরা থাইকো। আমরা এ জন্য তার বাড়িঘর পরিষ্কারও করে দিছি। তিনি বলেন, এভাবে তাদেরকে হত্যার শিকার হতে হবে তা ভাবতেও পারছেন না। এ ঘটনায় গোলাম কিবরিয়ার পরিবারটি অথৈ সাগরে পড়ে গেছে। তাদের উপার্জনের মতো আর কোনো কর্মক্ষম কেউ নেই পরিবারে।
গোলাম কিবরিয়ার স্ত্রী রোজি বেগম বললেন, মেয়ের বিয়ের জন্য জানুয়ারির ১০ তারিখে তারিখ ঠিক করছে। মেয়ে উঠেয় দিবি। বাপের স্বপ্ন থাকে যা সন্তান নিয়ে। আইজই নয়তো কাইলক্যা বাড়ি ফিরার কথা ছিলো। ও আল্লাহ, তুমি আমারে এতো বড় পরীক্ষায় কেনো ফেলাইলা? অসুস্থ হইতো আমি টানতাম। কিন্তু যা হইলো আমার ধরাছোঁয়ার বাইরে। কিভাবে কি হইলো কিছুই বুঝলাম না। আমারে সময় দিয়ার জন্যি বাড়ি আসতি চাইছিলো। এখন আমি কি দিয়ে কি করবো? গত পাঁচ মাস ধরে তিনি বেতনও পাননি। কিভাবে খেয়ে না খেয়ে সংসার চালিয়েছেন তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেন না। তিনি বলেন, যদি পরিকল্পিতভাবে এসব হয় তাহলে আমি অবশ্যই সুষ্ঠু বিচার দাবি করি। আমরা পরিবারে তিন-চারজন মানুষ। আমাদের কী অপরাধ?