২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`
বৈষম্যবিরোধী বীরত্বগাথা

ঘুমের ওষুধ খাইয়েও ঘরে রাখা যায়নি শহীদ রাব্বিকে

-


পুলিশের তাজা বুলেট আমার সতেরো বছরের বাজানডারে কাইড়া নিছে। আমি তো শহীদের মা হতে চাই নাই। আন্দোলনে যাওনের আগে বাবাডা শখের হাত ঘড়ি, আংটি আর চামড়ার জুতা খুইল্যা গেছে। বাথরুমের স্যান্ডেল পইরা বাইর হইছে। আমার রাব্বিরে আইন্যা দেন আপনারা।
এ আহাজারি সায়েদাবাদের করাতিটোলা এলাকার গণ-অভ্যুত্থানে নিহত ঈসমাইল হোসেন রাব্বির মা আসমা বেগমের। ভ্যানচালক মো: মিরাজ (৫৮) ও তার মা তাদের একমাত্র পুত্রসন্তানকে হারিয়ে পাগলপ্রায়। ঘরের ভেতরে উপস্থিত সবার চোখে পানি। রাব্বির মায়ের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠছিল পরিবেশ। মেঝেতে বসা জ্বর ও শ্বাসকষ্টে ভোগা মো: মিরাজও ফুঁপিয়ে কাঁদছিল।
আসমা বেগম (৪৮) রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা (বাসস)কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, জীবনে কোনো অন্যায় কাজ করি নাই, আল্লাহর গুনাহ্র খাতায়ও মাফ। তারপরও এমন শোক আমি কেমনে বইবো। কলিজা ছিঁড়া বাজানডা যে চইলা গেছে।
তিনি বলেন, রাব্বিরে অনেক বুঝাইলাম মাথায়-গায়ে হাত বুলাইয়া, তুই মিছিলে যাস না রে বাবা। কত কষ্ট করি দেহস, আমার কষ্ট কি তোর লাগে না বাবা? তুই কোন অভাবে যাবি বাবা? কান্দন দেইখ্যা কইল, আম্মু তুমি কাইন্দ না। মুগ্ধ আর আবু সাঈদ শহীদ হয়েছে তাদের রক্তের মূল্য নাই? বলছি, তোরে ছাড়া বাঁচুম নারে বাজান। আমার দুই ভাইও বুঝাইছে; বলছে, কালকে সারা দেশে বিশ্বযুদ্ধ লাগবো। তুমি পরিবারের এক ছেলে, আন্দোলনে যাইও না। সবাই অনুরোধ করলাম, খালি চুপ কইর‌্যা সবার কথা শুনল। মনে করল না ওর আম্মু যে পাগল হইয়া যাইব। যেই জন্য ঘুমের ওষুধ খাওয়াইলাম কোনোটাতে কোনো কাম হইলো না।’

তিনি বলেন, মেয়েরা বলছে পোলারে আন্দোলনে যাইতে দিও না। ঘুমের ওষুধ খাওয়ায়ে বাসায় ঘুম পাড়াইয়া রাখো। বলছি যেমন কইরা হোক আমার পোলারে সামলাইয়া রাখুম। সামলাইয়া রাখতে পারি নাই। ঘুমাইতে পারি না। মনে হয় ঘরের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়, দেহি আমারে ডাকে, কয় আম্মু আমারে ভাত দাও। ডাক দেই, কোথাও ওরে খুঁজে পাই না।
মিতু আক্তার (২৮) ও মিম আক্তার (২৪)-এই দুই বোনের ছোট ঈসমাইল হোসেন রাব্বি শরীয়তপুর পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন।
মিম আক্তার বলেন, গত ১৫ ও ১৬ জুলাই রাব্বি শরীয়তপুরে আন্দোলনে গিয়েছিল । এটা জানার পর পারিবারিক সিদ্ধান্তে ওকে আমরা ১৭ জুলাই ঢাকায় নিয়ে আসি। আসার পর একদিনও বাসায় থাকেনি। শরীয়তপুরে আন্দোলনে গিয়েছে শুনে জরুরিভাবে ঢাকায় এনেও লাভ হলো না।
তিনি বলেন, যাওয়ার আগের রাতে আম্মু, আমি ও বোনের সাথে কথা হয় রাব্বির। আমি বলি, তুই আর যাস না ভাই, এবার গেলে আর কাউরে ছাড়বো না। বুলেট মারতেছে তুই কিন্তু টিকতে পারবি না। আমার কথা শুনে রাব্বি বলে, ‘তোমরা শুধু তোমাদের কথা ভাবছো। ছাত্র-জনতার উপরে যেসব জুলুম হচ্ছে তা সহ্য করা যায় না। এই জুলুমের বিরুদ্ধে আন্দোলনে গিয়ে যদি শহীদের মৃত্যু হয়, হোক। আমি শহীদ হবো।’
রাব্বি আরো বলেছে, ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে এবার কোন দল বের হয় নাই, বের হইছে মানুষ। এখানে সবাই মানুষ। এবার মানুষ বাইর হইছে এইবার হাসিনার রক্ষা নাই।
রাব্বি সবসময়ই ছিলেন প্রতিবাদী। সে প্রসঙ্গে মিম বলেন, ছোটবেলা থেকেই কোন মিছিল হলে তাতে যোগ দিত রাব্বি। সময়টা ছিল ২০১৮ সাল। রাব্বি তখন ক্লাস সিক্সের ছাত্র। নিজেই স্লোগান বানালো। ‘বাপের খাই বাপের পরি, সেই দেশে কেন রাস্তায় মরি।’ একটা কাগজে এই স্লোগান লিখে তা নিয়ে বের হয়ে যেত।

মিম আরো বলেন, ২১ জুলাই আন্দোলনে গিয়ে বুকে তার রাবার বুলেট বিদ্ধ হয়। আমি যখন জানতে চাইলাম বলল, পুলিশ আমাকে খুব কাছে থেকে রাবার বুলেট ছুড়েছে। কাঁদানে গ্যাস ছুড়েছে। প্রথমে বুলেট খাইয়া টের পাই নাই। রক্ত বের হচ্ছে দেখে নিজেই বুলেট বের করে ক্ষতস্থান পরিষ্কার করেছি। সেদিন রাব্বি তুলো দিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে এসেছিল।
শহীদ হওয়ার আগের রাতের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, গত ৩ আগস্ট রাত্রে হাতে দুইটা ঘুমের ওষুধ দিয়ে বলছি খা। বললাম, তুই ঘুমালে আর আন্দোলনে যাবি না। ও হাসে, কিছু বলে না। ওষুধ খেতে গিয়ে বলল, ‘আমারে এইডা খেতে দিলি?’ ও ঘুমের ওষুধ খাইয়াও এক ফোঁটাও ঘুমায় নাই। আমি ওর চুলে বিলি কেটে দিতে গেলাম। বলল, মাথার চুলে হাত দিস না। আমার মাথা ব্যথা করছে।

মিম ঘটনার দিনের কথা উল্লেখ করে বাসসকে বলেন, সেদিন সবাই সতর্ক হয়ে আছি। ভোরের দিকে বাথরুমে গেল, ওজু করল, নামাজ পড়ল। তার পর বিছানায় শুয়ে পড়ল। বেলা সাড়ে ১২টার দিকে ওকে দেখলাম বিছানায় ঘুমিয়ে আছে। সারারাত ঘুমায় নাই, ভাবলাম ঘুমালে ও আর আন্দোলনে যাবে না। রাব্বির মোবাইল বন্ধ করে দিলাম, যাতে কেউ কল দিয়ে ওর ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটায়। আমি ও আমার আমার মা আরবি পড়াতে বাসার বাইরে চলে গেলাম। সব মিলিয়ে ঘণ্টাখানেক হবে, এর মধ্যে আমরা বাসায় ফিরে দেখি রাব্বি নাই। দরজার একপাশ দিয়ে সিমেন্টের আস্তরণ ভাঙ্গা। ভেতর থেকে বাইরের দরজার লক খুলে বের হয়ে গেছে। রাস্তায় আব্বুর সাথে দেখা হয়েছিল। আব্বুর ডাকে কোন কথা বলে নাই। আসার পরে ওকে না দেখে চিন্তিত হয়ে ওর মোবাইলে কয়েকবার কল দিলাম। রিং হয়েছে, কিন্তু ও মোবাইল ধরল না। ফিরে আসার অপেক্ষা করে রাত বাড়তেই আমি, মা ও বোন ওর খোঁজে বের হই, অনেক জায়গায় খুঁজি। মিম বলেন, সেদিন রাত তিনটা পর্যন্ত খুঁজলাম। ওই সময় চাঁনখারপুল থানার সামনে গিয়ে দেখি লাশ আর লাশ। আমি লাশগুলো উল্টায়া দেখি। ওই লাশের স্তূপে রাব্বি নাই। পরের দিন ভোরবেলা আমি ও আমার বোন রাব্বিকে খুঁজতে খুঁজতে হাসপাতালে গেলাম। রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ ছিল,ব্যারিকেড জায়গায় জায়গায়। আর গুলির আওয়াজ। অনেক কষ্টের পর ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতালে পৌঁছাই আমরা। আমার মোবাইলের ওয়াল পেপারে থাকা রাব্বির ছবিটা নিয়ে হাসপাতালের এমাথা থেকে ওমাথায় দৌড়ে ডাক্তার, নার্স থেকে শুরু করে সবাইকে দেখাই।
মিম বলেন, সকাল সাড়ে দশটার দিকে হাসপাতালের একজন ওয়ার্ড বয় হাসপাতালের মর্গে যেতে বলে। মিতু বলে, রাব্বির লাশ মর্গে থাকতে পারে না, আমি মর্গে যাবো না।
মর্গের ছেলেটা দুইটা লাশের ছবি দেখায়। ওই দুইটা ছেলে অনেক ছোট ছিল। পরের ছবিটায় দেখি মাটিতে দেওয়ালের দিকে শেষ সারির আগের সারিতে রাব্বি পড়ে আছে। একটা স্ট্রেচারে এতোটুকু হয়ে গুটিয়ে আছে। মিতু চিৎকার করে কেঁদে বলছিল, ‘আল্লারে এটা আমি কি দেখলাম!’ এই কথা শোনার পর দুজনেই সেন্সলেস হয়ে যাই। প্রায় দেড় ঘন্টা মর্গের সামনে পড়েছিলাম।

মিম আরো জানান, জ্ঞান ফেরার পর রাব্বির লাশ চাইলে দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি জানায়, আপনার ভাইয়ের লাশ দেয়া যাবে না। ওকে ধানমন্ডি জিগাতলা পুলিশ নিয়ে গেছে। পরে জানতে পারি আমার ভাইকে ধানমন্ডি জিগাতলা পুলিশ নেয় নাই। আমরা হাসপাতাল প্রশাসনের কাছে দৌড়াদৌড়ি করেও রাব্বির মরদেহ আনতে পারছিলাম না। এদিন অনেকে বলাবলি করছিল, গুরুতর আহতদের হাসপাতালে নিয়ে আসছিল, ডাক্তাররা চিকিৎসা দেয় নাই। বলছিল, ‘উপর থেকে ওদের ট্রিটমেন্ট না করার নির্দেশ রয়েছে। মর্গে রেখে যেতে চাইলে রাখেন, নইলে লাশ নিয়া যান।’
মিম বলেন, বেলা দশটা এগারোটার দিকে চাঁনখারপুর এলাকা থেকে বৃষ্টির মতো গুলি আসছিল। আকাশ থেকেও গুলি করা হচ্ছিল। দুই মামাসহ সবাই ধানমন্ডির জিগাতলা থানায় যাই। থানার পুলিশ মামাদের ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়ে বলছে, ‘বারবার মিছিলে গেছে কেন, ঠিক হইছে’ আমাদের কাছে এখন আসেন কেন? ডেডবডির কাগজ দেবো না।’ নিরুপায় হয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ফিরে আসি। শুনলাম শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছে, এ কথা শুনে উপস্থিত কেউ কেউ ‘শোকর আলহামদুল্লিাহ’ বলল, কেউ মুনাজাত করলো।
বেলা সাড়ে তিনটা থেকে বিকেল চারটার দিকে জানলাম হাসপাতালের ভেতর সমন্বয়করা আসছেন লাশ নিয়ে মিছিল করার জন্য। ছাত্রদের কাছে গিয়ে রাব্বির লাশ দেখাতেই তারা দিয়ে দেয়। উনারা হাসপাতালের পিছন গেট দিয়ে বিজয় মিছিল নিয়ে বের হয়ে যায়। আমরা দুই বোন রাব্বির লাশসহ স্ট্রেচার কাঁধে নিয়ে মিছিলের মধ্যে দৌড়ে যাই মিছিলের মধ্যে থাকা একজন সমন্বয়ক হাসপাতালের ৭ নং ওয়ার্ডে গিয়ে ডেথ সার্টিফিকেট নিতে বলল, নইলে ঝামেলা হতে পারে।

পরে আমরা গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরে রাব্বির লাশ দাফন করি কিন্তু ওর ডেথ সার্টিফিকেট এখনো মেলেনি।
তিনি বলেন, ১০ ও ১১ আগস্ট থেকে নানা সময়ে ডেথ সার্টিফিকেটের জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যাই। বলা হয়, মৃত্যু সনদ নিতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে প্রত্যয়নপত্র লাগবে। মৃত্যু সনদ না পেলে রাব্বি যে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শহীদ হয়েছে তার কোন প্রমাণ থাকল না। প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও আমাদের নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে।
মিম আরো বলেন, উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া তার ফেসবুক থেকে একটি ভিডিও পোস্ট করেন। সেখানে আমরা দেখি লাশের মিছিল রাব্বিসহ চারজনের। গত ৪ আগষ্ট শাহবাগে যে চারটা লাশ নিয়ে মিছিল হয়েছিল তার মধ্যে রাব্বি ছিল। পরে রাব্বির লাশ হাসপাতাল মর্গে নেওয়া হয়। এতো প্রমাণের পরও কি রাব্বির ডেথ সার্টিফিকেট পাবো না?
মিম স্মৃতিচারণ করে বলেন, আব্বু-আম্মুর শক্তি ছিল রাব্বি। তারা এখন উপার্জন করতে পারেন না। সারাদিন কান্নাকাটি করেন। আব্বুর হাঁপানি বেড়ে গেছে। এখন সংসারই বা কিভাবে চলবে জানি না।
আসমা বেগম বলেন, খাইয়া না খাইয়া পোলাডারে লেখাপড়া শিখাইতেছিলাম। অনেক স্বপ্ন ছিল। ভাবছিলাম ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার হয়ে রাব্বি চাকুরি করে সংসারের হাল ধরবে। সংসারের অভাব দূর হইবো, বুড়া মা-বাপরে শেষ বয়সে রোজগার কইরা খাওয়াইবো। আমাগো নিয়তি আর বদলাইলো না।

 

 


আরো সংবাদ



premium cement
তালাক নিয়ে যুক্তরাজ্যে যেতে চান বাশার আল-আসাদের স্ত্রী চুরিতে মৃত্যুকে যাচাই-বাছাই ছাড়াই সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বলে প্রচার পিটিআইয়ের অনুসন্ধান শুরু দুদকের রাস্তা অবরোধে দুর্ভোগে রোগীরা রাজধানীতে পুলিশে শৃঙ্খলা ফেরেনি, বেপরোয়া দুর্বৃত্তরা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গণহত্যা মামলার তদন্ত ৩ মাসের মধ্যে শেষ হবে সাধারণ মানুষ সংস্কার বোঝে না, তারা ভোট দিতে চায় : ফখরুল সরকারের ছত্রছায়ায় রাজনৈতিক দল চায় না বিএনপি আরাকান আর্মির সাথে সরকার আলোচনা করতে পারে না : পররাষ্ট্র উপদেষ্টা সিলেটে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের সভায় ডা: শফিক পাঠ্যপুস্তক নিয়ে ষড়যন্ত্র ফাঁস

সকল