মোবাইল ফোনে *#62# ডায়ালে আসছে অপরিচিত নম্বর!
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ০৩ আগস্ট ২০২৪, ১০:৪৫, আপডেট: ০৩ আগস্ট ২০২৪, ১১:০৯
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেককে শেয়ার করতে দেখা যাচ্ছে মোবাইল ফোন ট্যাপিং বা ট্র্যাকিং প্রসঙ্গে একটি বিষয়।
এসব পোস্টে বলা হচ্ছে, আপনার ফোন কেউ ট্র্যাকিং করছে কিনা তা জানতে *#62# ডায়াল করুন। সব ধরনের কল ডাইভার্ট বাতিল করতে বা মুছতে ##002# বা ##21# ডায়াল করুন।
*#62# দিয়ে ডায়াল করার পর অনেকের মোবাইলে ভেসে ওঠে একটি অপরিচিত নম্বর।
পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী জানান, ফেসবুকে এ ধরনের পোস্ট দেখে বিষয়টি তিনি ও তার বন্ধু মিলে একসাথে নিজ নিজ মোবাইলে চেক করেন। দুটি নম্বরে কল ফরওয়ার্ড অপশন অন দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন তিনি।
তিনি বলেন, ‘কয়েক দিন শুধুমাত্র ফোন চালু থাকায় অনেকের সাথে অনেক কথা বলা হয়েছে, নজরদারি করে ব্যবস্থা নিতে চাইলে অনেক কিছুই করা সম্ভব। এখনো বিষয়টি নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।’
কিছু ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে বাতিল করার কোড দেয়ার পরও সেটি কাজ করছে না।
প্রশ্ন হচ্ছে এই ডাইভার্টের অর্থ কী? বিষয়টি আদৌ কতটা উদ্বেগের? প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন?
ট্যাপিং, ট্র্যাকিং ও ডাইভার্ট কী?
ফোনে কারো কথোপকথন শুনতে গোপনে বিশেষ কোনো ডিভাইস বসানোকে বোঝানো হয় ট্যাপিং। আর ট্র্যাকিং সাধারণত কারো গতিবিধি নজরদারিকে বোঝানো হয়।
সিম কার্ড ছাড়াও ডিভাইসের আইএমইআই অথবা সফটওয়্যারের মাধ্যমে নজরদারি করা সম্ভব। যদিও সহজেই যে কেউ আরেকজনের কথায় আড়ি পাততে বা ট্র্যাক করতে পারবেন তেমনও না।
গোপনীয়তার অধিকার যেমন বিশ্বব্যাপী গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, আবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় অপরাধী ধরতে বা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে নজরদারির সুযোগ অনেক ক্ষেত্রেই থাকে।
অনেক ক্ষেত্রে মোবাইলে বিভিন্ন অ্যাপ ব্যবহার করতে মাইক্রোফোন, ক্যামেরা, লোকেশন এমন বিভিন্ন অনুমতি দিতে হয়।
এ জন্য অনেক সময়েই আমাদের গতিবিধি, কথোপকথন, সার্চ বা ক্লিক হিস্ট্রি, আগ্রহের ভিত্তিতে অ্যালগরিদম এমন নানা তথ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিজ্ঞাপনও আমরা দেখি।
তবে ফোন ডাইভার্ট বা ফরোয়ার্ড একটি ভিন্ন ব্যবস্থা। এটি ব্যবহারকারীর নাম্বার ব্যস্ত বা বন্ধ থাকলে অন্য নাম্বারে ফোন বা মেসেজ যাওয়াকে বোঝানো হয়। এটি সাধারণত ব্যবহারকারীর নিজস্ব পদক্ষেপ হিসেবে থাকে।
অপরিচিত নাম্বারে ডাইভার্ট?
এবার আসা যাক *#62# দিয়ে চেক করার প্রসঙ্গে। বেশ কয়েকজন তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ এ বিষয়ে জানিয়েছেন যে এটি দিয়ে চেক করার পর অপরিচিত যে নাম্বারটি দেখা যাচ্ছে সেটি আসলে মোবাইল ফোন অপারেটরদের নম্বর।
তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির বলেন, কল ট্যাপিং-এর জন্য কল ফরওয়ার্ডের দরকার হয় না।
তিনি বলেন, ‘কল ট্যাপিং-এর জন্য এ মুহূর্তে আমাদের সরকারের, বিশেষত এনটিএমসির (ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার) যে সক্ষমতা আছে তাতে তারা আসলে বাংলাদেশের যেকোনো ফোনকল যেকোনো সময় চাইলে ট্যাপ করতে পারে। একটা বড় অংশ স্বয়ংক্রিয়ভাবে রেকর্ড হয়, তারা চাইলে সেটা দেখতে পারেন, টার্গেটেড যারা তাদের কল রেকর্ড তো তারা করেনই।’
কল ফরওয়ার্ড অপশনে ব্যবহারকারীর নির্ধারিত নম্বরের বাইরে অপারেটরদের নম্বর দেখানোর পেছনে একটা কারণ মিসড কল অ্যালার্ট সার্ভিস।
কারণ ফোন বন্ধ বা ব্যস্ত থাকলে ও মোবাইলে মিসড কল অ্যালার্ট সার্ভিস চালু থাকলে সেই তথ্য সংবলিত মেসেজ পাঠাতে অপারেটরের সেই নাম্বার ব্যবহার করা হয়।
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিভিন্ন সাবস্ক্রিপশন সার্ভিস থেকে সেটি সম্ভব। যেমন ভয়েজ মেইল সার্ভিসের ক্ষেত্রেও এমন সম্ভব। আর এমন ফরোয়ার্ড সার্ভিস বন্ধ করার পরও যদি সেই ফরওয়ার্ড সার্ভিস সচল দেখায় সেটা টেকনিক্যাল কারণে হয়।
আরেকজন ইন্টারনেট ও প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ মোবারক হোসেন বলেন, যেমন নির্দিষ্ট কোনো সার্ভিস বা সাবস্ক্রিপশন যেভাবে চালু করা হয়েছে সেটার নির্দিষ্ট মেয়াদে থাকলে তার আগে অকার্যকর নাও হতে পারে।
মোবাইল অপারেটরদের কল ডেটা রেকর্ডের প্রক্রিয়া আলাদাভাবে করার সুযোগ রয়েছে। তবে সেটি এই কল ফরোয়ার্ড বা ডাইভার্টের সাথে সম্পর্কিত না বলে উল্লেখ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য ও প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও পরিচালক ড. বি এম মইনুল হোসেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা অনেক সময় শুনি বাইরের দেশ থেকে বিভিন্ন ধরনের ডিভাইস কেনা হয়েছে, অন্য দেশের সরকার কিনেছে বা কেনে। এটা অপারেটরদের মাধ্যমেও করা সম্ভব। আবার তেমন সংবেদনশীল ডিভাইস যদি থাকে তাহলে অপারেটরদের হেল্প ছাড়াও এটা করা যেতে পারে।’
তার মতে, নানাভাবে মোবাইল ফোনে নজরদারি সম্ভব এবং এক্ষেত্রে প্রযুক্তি জগতেও একরকম প্রতিযোগিতা রয়েছে। কোনো পক্ষ নিরাপত্তা বাড়াতে বা ক্রমাগত কাজ করে, বিপরীতে কোনো পক্ষ নিরাপত্তা বিঘ্নিত করতে কাজ করে।
আইনে কী আছে?
বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী ফোনে আড়িপাতা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সেক্ষেত্রে অনধিক দুই বছরের কারাদণ্ড বা পাঁচ কোটি টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে।
তবে আরেকটি ধারাও রয়েছে। সরকার থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত গোয়েন্দা সংস্থা, জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা, তদন্তকারী সংস্থা বা আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থার কর্মকর্তার ক্ষেত্রে সে বিধান প্রযোজ্য না।
আইনে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা জনশৃঙ্খলার স্বার্থে যেকোনো টেলিযোগাযোগ সেবা ব্যবহারকারীর প্রেরিত বার্তা ও কথোপকথন প্রতিহত, রেকর্ড ধারণ বা তৎসম্পর্কিত তথ্যাদি সংগ্রহের জন্য সরকার।’
এসব সংস্থার কর্মকর্তাকে ক্ষমতা দিতে পারে। এক্ষেত্রে সরকার বলতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীর অনুমোদন বোঝানো হয়েছে।
সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ও বিটিআরসির একজন উপদেষ্টা খন্দকার রেজা-ই রাকিব বলেন, রাষ্ট্রের যেকোনো জরুরি পরিস্থিতি বা প্রয়োজনে আইন অনুযায়ী গোয়েন্দা বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এটা করতে পারে। টেলিকমিউনিকেশন অপারেটরদেরও নির্দেশ দিলে এটা তারা মানতে বাধ্য থাকবে।
রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য বিভিন্ন দেশে আইনানুগভাবেই নজরদারি করা হয়।
মোবারক হোসেনের মতে, ‘রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, সাথে এটাও নিশ্চিত করতে হবে যে সেটা আসলেও রাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিনা এবং সেই জায়গাতেই বিভিন্ন দেশে গ্যাপ বা দুর্বলতা থাকে।’
রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্যই ব্যক্তির গোপনীয়তা লঙ্ঘন করা হলো কিনা সেটা নিশ্চিত করার দিকটাও উল্লেখ করেন তিনি। যদিও বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশে এমন নজরদারি, ফোনালাপ রেকর্ড কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে ফাঁস হলেও সেটার গভীরে যাওয়া বা প্রতিকার নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না।
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সাবির বলেন, ‘ফোনে আড়ি পাতা, ট্যাপিং বা রেকর্ড করার বিষয়টা বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে আইন করেই করা হয়েছে, আপনি যখন টেলিফোনে কথা বলছেন তখন আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন কেউ না কেউ এই কলটা শুনতে পারে।’
মোবাইল অপারেটরদের লাইসেন্সের বিষয়ে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) নীতিমালা রয়েছে যেখানে পর্যবেক্ষণ বা কল রেকর্ড-সংক্রান্ত নিয়মকানুন রয়েছে।
সবশেষ ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত নীতিমালা অনুযায়ী লাইন্সেন্সধারীকে কল ডিটেইলড রিপোর্ট, ট্রাঞ্জ্যাকশন ডিটেইলড রিপোর্ট, নেটওয়ার্ক ট্রাফিক ডেটা এমন নানাবিধ তথ্য তদন্ত বা কমিশনের আইনানুগ প্রয়োজনে দু’বছর পর্যন্ত সংরক্ষণ করবে।
কমিশন বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নির্দেশে ক্ষেত্রবিশেষে দু’বছর পার হলেও মুছে না ফেলে সংরক্ষণ করতে হবে। কল রেকর্ডের বাইরে আইপি এড্রেসসহ ডেটা সেশনের তথ্য ছয় মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করবে। এটিও কমিশনের নির্দেশে বেশি হতে পারে।
সূত্র : বিবিসি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা