২১ নভেম্বর ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

চীন ও পশ্চিমের মধ্যে বৈরিতা শুরু যে বোমা হামলার মধ্য দিয়ে

চীনা দূতাবাসে ন্যাটোর বোমা হামলার পর ক্ষুব্ধ চীনারা প্রতিবাদে ফেটে পড়েন - ছবি - বিবিসি

তখন কসোভোয় পুরোদমে চলছে যুদ্ধ। ২৫ বছর আগের কথা, তখন ১৯৯৯ সালের মে মাস। ন্যাটো বাহিনী ছয় সপ্তাহ ধরে ইউগোস্লাভিয়ার ওপর এক নাগাড়ে বোমাবর্ষণ করে চলেছে।

ন্যাটোর লক্ষ্য ছিল কসোভোয় আলবেনিয় সম্প্রদায়ের ওপর প্রেসিডেন্ট স্লোবোদান মিলোশেভিচের অধীনস্থ ইউগোস্লাভ সেনা বাহিনীর চালানো নৃশংসতার অবসান ঘটানো।

ওই সময়ে ৭ মে প্রায় মধ্যরাতের কাছাকাছি মার্কিন স্টেল্থ যুদ্ধ বিমান ইউগোস্লাভিয়ার রাজধানী বেলগ্রেডে চীনা দূতাবাসের ওপর রাতের আঁধারে পাঁচটি বোমা ফেলে, যেগুলো ছিল লক্ষ্যবস্তু নিশানা করে ফেলা বোমা। বিধ্বস্ত হয়ে যায় দূতাবাস ভবন। গুরুতরভাবে বিপন্ন হয় চীনের সাথে পশ্চিমের সম্পর্ক।

ঘটনাস্থলে সেদিন প্রথম যারা পৌঁছেছিলেন তাদের একজন ছিলেন চীনা ব্যবসায়ী হং শ্যেন। তার সাথে কথা বলেছেন বিবিসির বেন হেন্ডারসন।

‘আমি দূতাবাস চত্বরে ঢুকেছিলাম দেখতে সেখানে কেউ আছেন কি না। দেখলাম কালচারাল অ্যটাশে সেখানে রয়েছেন। তাকে আমি জানতাম। আমি কাছে গিয়ে তার সাথে করমর্দন করলাম। সাথে সাথে টের পেলাম, আমার হাতে ভেজা চটচটে রক্ত। আমি বললাম, আপনি তো আহত! তিনি একবার নিজের হাতের দিকে তাকালেন। সাথে সাথে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন,’ বলছিলেন হং শ্যেন।

রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ছিন্নভিন্ন দেশ
‘কসোভো যুদ্ধের আগে বেলগ্রেড ছিল খুবই শান্তিপূর্ণ একটা শহর। জীবন সেখানে ছিল বেশ নিস্তরঙ্গ – ঢিলেঢালা। আমার জন্ম শাংহাইতে, সেখানকার মতো উত্তেজনা বেলগ্রেডে ছিল না,’ বলছিলেন হং শ্যেন।

কিন্তু সেই শান্তির পরিবেশ তখন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।

বিংশ শতাব্দীর শেষ সবচেয়ে ভয়াবহ ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের দাপট চলেছে ইউগোস্লাভিয়ায় ১১ সপ্তাহ ধরে। দেশটির মানুষ স্বপ্নেও ভাবেনি তাদের জীবন এভাবে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। বাস্তব জগতের সাথে তাদের সরকার সব যোগাযোগ ছিন্ন করে দেয়ায়, তাদের কোনো ধারণাই নেই যে কেন এই যুদ্ধ? কী ঘটছে? কেন ঘটছে?

মানুষের প্রতিক্রিয়ায় ছিল ক্ষোভ, ছিল বিভ্রান্তির সুর, ন্যাটোর উদ্দেশে তাদের মনে ছিল নানা প্রশ্ন।

‘তোমরা সাধারণ মানুষের ওপর বোমা ফেলছ! ন্যাটো তো মিলোশেভিচের ওপর বোমা ফেলছে না! এটা তো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে,’ বলেন বেলগ্রেডের এক বাসিন্দা।

‘তোমরা প্রসিডেন্ট বদলাতে চাও? তা নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই। মিলোশেভিচকে ক্ষমতা থেকে নামাতে চাও? আমি সবার আগে তোমাদের পাশে দাঁড়াব। কিন্তু তোমরা তো তা করছ না। তোমরা মানুষের মন বিষিয়ে দিচ্ছো। সবাই এখন তোমাদের ঘৃণা করছে,’ বলেন আরেক ব্যক্তি।

ক্রুদ্ধ এক নারী বাসিন্দা বলেন, ‘আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি আমাদের মানুষ, আমাদের বাচ্চারা প্রতিদিন কিভাবে মরছে!’

‘প্রতিদিন তখন শহরের ওপর বোমা পড়ছে।’ বলছিলেন হং শ্যেন। ‘প্রতিদিন বোমার শব্দ, প্রতিদিন রাত ৮টায় বিমান আক্রমণের সাইরেন বাজে। আমি সবে একটা নতুন মার্সেডিজ গাড়ি কিনেছি। এক দিন বাবা আমাকে ফোন করে বললেন তুমি নতুন গাড়িটা দূতাবাসের ভেতর পার্ক করে রেখো। তাহলে গাড়িটা বোমাবর্ষণ থেকে রক্ষা পাবে।’

চীনা দূতাবাসে ব্যাপক ধ্বংসলীলা
হং শ্যেন বলছিলেন, ওই দিন রাত ৮টায় বিমান হামলার কোনো সঙ্কেত সাইরেন বাজেনি। যেটা তাকে খুবই অবাক করেছিল।

‘আমার এক বন্ধু চীনা দূতাবাসের পাশের বাসাতেই থাকতেন। তিনি আমাকে ফোন করে বলেন যে দূতাবাস চত্বরে বিশাল একটা বিস্ফোরণ হয়েছে। আমি বলেছিলাম, অসম্ভব- এটা হতেই পারে না।

তিনি বললেন, ঘটনা সত্যি। এই মুহূর্তে সেখানে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। আমি গাড়ি নিয়ে ছুটলাম বেলগ্রেডের নতুন অংশে, সে পাড়াতেই চীনা দূতাবাস ভবন।’

বোমার আওয়াজ এতটাই তীব্র ছিল যা বেলগ্রেডে অনেক দূর পর্যন্ত শোনা গেছে।

‘আমি যখন পৌঁছলাম, দেখলাম দূতাবাসের ভবনের বাঁদিকটা গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভেতরে আগুনের লেলিহান শিখা। ডানদিকে দেখলাম ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছে,’ বলছিলেন হং শ্যেন।

সে রাতে দূতাবাস ভবনের ভেতরে ছিলেন তার দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

‘যারা ছিলেন তাদের সবাই আমার পরিচিত। ভেতরে দু’জন সাংবাদিক ছিলেন, তাদের সবে বিয়ে হয়েছে। আমি পুরুষ সাংবাদিককে খুব ভালোভাবে চিনতাম। খুব সাদাসিধে মানুষ। আমার খুব ভালো বন্ধু ছিলেন তিনি। তারা নিরাপত্তার কারণে ওই রাতে দূতাবাসের ভেতর থাকবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কী দুর্ভগ্যজনক!’ ক্ষোভ ঝরে পড়ছিল হং শ্যেন-এর কণ্ঠে।

নব বিবাহিত ওই সাংবাদিক দম্পতি বোমা বর্ষণে মারা যান। প্রাণ হারান আরো একজন সাংবাদিক। আহত হন ২০ জনের ওপর।

‘তাদের মৃত্যুর খবর আমি পাই পরের দিন। বেলগ্রেডে আমরা যে চীনারা ছিলাম, আমরা একটা বাজারে দেখা করি। আমরা সিদ্ধান্ত নিই প্রতিবাদ দেখাতে আমরা রাস্তায় নামব,’ বলেন হং শ্যেন।

তারা জড়ো হতে শুরু করার পর ধ্বংসলীলার ব্যাপকতা পরিষ্কার হতে শুরু করে। জনতা সেখানে জড়ো হতে থাকে।

বেলগ্রেডে বসবাসরত চীনাদের সংখ্যা ছিল ব্যাপক। তারা ন্যাটোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ দেখাতে বিপুল সংখ্যায় রাস্তায় নামেন।

ক্ষিপ্ত চীন ও চীনের মানুষ
‘আমিও ওই বিক্ষোভে সামিল হই। আমিও রাস্তায় নেমে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সরব হই,’ বিবিসিকে বলছিলেন চীনা ব্যবসায়ী হং শ্যেন।

‘বিক্ষোভের শুরুতে সেখানে আমরা ছিলাম এক হাজার মানুষ। দিনের শেষে বিক্ষোভকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় তিন হাজারে। আমার মনে আছে আমি তখন রাগে ফুঁসছি।

এক থেকে দুমাস পর্যন্ত সেই রাগ আমার যায়নি। রাগটা ছিল একটা বিশাল মনস্ত্বাত্তিক আঘাতের বহিঃপ্রকাশ। একটা গভীর মর্মপীড়া। আমার সম্মান, আমার মর্যাদাকে যেন কেউ ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে।’

জনরোষ উপছে পড়েছিল চীনের মূল ভূখণ্ডে। ন্যাটোর এই বোমা হামলার বিরুদ্ধে বিশাল ও ক্ষুব্ধ প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠল ক্ষিপ্ত চীনা জনগণ।

প্রতিবাদ হলো চীনের বড় বড় শহরে। বেইজিংয়ে দূতাবাস পাড়ায় চড়াও হলো এক লাখ মানুষ। তাদের ক্ষোভের মূল লক্ষ্য হল আমেরিকানরা।

হামলা কি দুর্ঘটনা?
চীন ও পশ্চিমের মধ্যে সম্পর্কে বিশাল ফাটল ধরল- সম্পর্ক ক্রমে গিয়ে পৌঁছাল তলানিতে।

ন্যাটো এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন জোড়াতালি দিয়ে সম্পর্ক উন্নত করতে উদ্যোগী হলেন।

ন্যাটো স্বীকার করল চীনা দূতাবাসের ওপর হামলার জন্য দায়ী গোয়েন্দা তথ্যের ত্রুটি। ঘটনার জন্য নানাভাবে দুঃখ প্রকাশ করা হলেও ন্যাটো স্পষ্ট জানিয়ে দিলো তাদের বোমা হামলা অব্যাহত থাকবে।

বিল ক্লিন্টন বললেন, ‘এটা একটা মর্মান্তিক ভুল। আমি চীনের প্রেসিডেন্ট এবং চীনা জনগণের কাছে গভীরভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি এবং আমার গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। তবে একইসাথে একথাও মনে করিয়ে দিতে চাই যে স্পষ্টতই নিরীহ সাধারণ মানুষের প্রাণহানি এড়াতে আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। কেন এই বিমান হামলা চালানো জরুরি সেটা মনে রাখাও গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি।’

তবে ন্যাটো, বিল ক্লিন্টন এবং ব্রিটিশ সরকার এই হামলাকে নিছক একটা দুর্ঘটনা বলে যে ব্যাখ্যা দেন সেটা কিভাবে নিয়েছিলেন চীনা ব্যবসায়ী হং শ্যেন?

‘আমি মনে করি না চীনের কোনো মানুষ তাদের এই ব্যাখ্যাকে বিশ্বাস করেছিলেন। চীনের তরুণ প্রজন্ম সেসময় কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতি ঝুঁকতে শুরু করেছিল। তাদের মধ্যে পশ্চিমের প্রতি একটা পছন্দের মনোভাব গড়ে উঠছিল। কিন্তু ওই বোমা হামলা তাদের সেই মানসিকতাকে সম্পূর্ণ ভেঙে দেয়। ওই হামলার পর চীনের কোনো তরুণ আর বিশ্বাস করতো না যে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো রকম মানবিকতা বোধ আছে।’

ন্যাটো, যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন এই ঘটনাকে ‘গোয়েন্দা তথ্যে ত্রুটিজনিত দুর্ঘটনা’ আখ্যা দিলেও ঘটনার কয়েক মাস পর লন্ডনের অবজারভার এবং অন্য কিছু পত্রপত্রিকা একটি তদন্তে গোপন সূত্রে পাওয়া তথ্য উদ্ধৃত করে লেখে যে ওই হামলা ছিল ‘ইচ্ছাকৃত’। যদিও ব্রিটিশ এবং মার্কিন সরকার এই তথ্য ‘বানোয়াট’ বলে নাকচ করে দেয়।

চীন ও পশ্চিমের সম্পর্কে টানাপোড়েনের অনুঘটক
হং শ্যেন এখনো বেলগ্রেডে থাকেন। চীনা দূতাবাসের হামলায় নিহতদের স্মরণে সেখানে স্মৃতিসৌধ আছে।

‘বেলগ্রেড সরকার সেখানে একটি স্মৃতিসৌধ স্থাপন করেছে। ১৯৯৯র সেই মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের স্মরণে আমি প্রতি বছর ৭ মে সেখানে যাই। প্রতি বছর।’

হং শ্যেনের বন্ধু সাংবাদিক দম্পতি- ঝু শিংঘু এবং জু ইয়েং-এর নাম ওই স্মৃতিস্তম্ভের গায়ে খোদাই করা আছে।

ইউগোস্লাভিয়ায় ন্যাটোর বোমা হামলা চলেছিল ৭৮ দিন ধরে। কসোভো থেকে ইউগোস্লাভিয়া সেনা প্রত্যাহারে সম্মত হওয়ার পর ১৯৯৯ সালের ১০ জুন এই হামলার পরিসমাপ্তি ঘটে।

পরের বছর ২০০০ সালে ইউগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট স্লোবোদান মিলোশেভিচকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় এবং তার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মামলা চলাকালীন ২০০৬ সালে কারাগারে তার মৃত্যু হয়।

চীন এবং পশ্চিমের মধ্যে দূরত্ব তৈরির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটা অনুঘটক ছিল বেলগ্রেডে চীনা দূতাবাসের ওপর ন্যাটোর ওই বোমা হামলা। দুই পক্ষের মধ্যে সম্পর্কে টানাপোড়েনের ক্ষেত্রে ৭ মে ১৯৯৯ ছিল মোড় ঘোরানো একটা সন্ধিক্ষণ।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement