২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

টাইটানিকের নতুন অদেখা ভিডিও ও ছবি প্রকাশ

সাত লাখের অধিক ছবি দিয়ে এই থ্রিডি স্ক্যান তৈরি করা হয়েছে - ছবি : বিবিসি

বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত জাহাজ দুর্ঘটনায় টাইটানিক নামের যে বিলাসবহুল জাহাজটি সমুদ্রে ডুবে গিয়েছিল এই প্রথম তার একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া গেছে।

এসব ছবি আটলান্টিকের তিন হাজার ৮০০ মিটার (১২ হাজার ৫০০ ফুট) নিচে ডুবে থাকা জাহাজটির ধ্বংসাবশেষের প্রথম ডিজিটাল স্ক্যান যা 'গভীর সমুদ্র ম্যাপিং' পদ্ধতি ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে।

এর ফলে পুরো টাইটানিকের ত্রিমাত্রিক বা থ্রিডি অর্থাৎ দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং উচ্চতা! এই তিন মাত্রার দৃশ্য পাওয়া যাচ্ছে যা আগে কখনো দেখা যায়নি।

ছবিগুলো দেখলে মনে হয় আটলান্টিক থেকে সব পানি সরিয়ে যেন সমুদ্রের তলদেশে পরিত্যক্ত বিশাল আকারের এই জাহাজটির দৃশ্য ধারণ করা হয়েছে।

আশা করা হচ্ছে ১৯১২ সালে ডুবে যাওয়া এই জাহাজটিতে মূলতই কী ঘটেছিল এসব দৃশ্য থেকে সে সম্পর্কে নতুন কিছু জানা যাবে। জাহাজটি তার উদ্বোধনী যাত্রায় সমুদ্রে ভাসমান বিশালাকৃতির বরফ বা আইসবার্গের সাথে ধাক্কা খাওয়ার পর ডুবে গিয়েছিল। এই দুর্ঘটনায় দেড় হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়।

টাইটানিক যুক্তরাজ্যের সাউদাম্পটন থেকে যাত্রা শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে যাচ্ছিল।

'অনেক প্রশ্ন'
টাইটানিক বিশেষজ্ঞ পার্কস স্টিফেনসন বলেন, ’জাহাজটির বিষয়ে এখনো অনেক প্রশ্ন আছে, মৌলিক কিছু প্রশ্ন। যেসবের উত্তর জানা প্রয়োজন।’

তিনি বলেন, ‘টাইটানিকের বিষয়ে জল্পনা-কল্পনার ওপর ভিত্তি করে কোনো গবেষণা নয়, বরং তথ্যপ্রমাণ-ভিত্তিক গবেষণাকে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য এই মডেল বড় ধরনের প্রথম কোনো পদক্ষেপ।’

সমুদ্রের তলদেশে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষের প্রথম সন্ধান পাওয়া যায় ১৯৮৫ সালে। এর পর থেকে জাহাজটি নিয়ে ব্যাপক গবেষণা হয়েছে। কিন্তু এটি এতো বিশাল ও সমুদ্রের গভীরে এতো অন্ধকার যে ক্যামেরা দিয়ে এতদিন এর যেসব ছবি তোলা হয়েছে সেগুলোর সবই ছিল এই ক্ষয়িষ্ণু জাহাজের কিছু অংশের ছবি বা স্ন্যাপশট। তবে কখনোই ডুবে যাওয়া পুরো জাহাজের ছবি পাওয়া যায়নি। এখন এই নতুন অনুসন্ধানে সমগ্র টাইটানিকের ছবি পাওয়া গেল।

সমুদ্রের তলায় যেভাবে পড়ে আছে
দেখা যাচ্ছে সমুদ্রের তলায় জাহাজটি দুটো অংশে ভাগ হয়ে পড়ে আছে। জাহাজের অগ্রভাগ যেখান থেকে বাঁকা হতে শুরু করে ওই অংশ এবং জাহাজের পশ্চাদভাগ।

এই দুটো অংশের মধ্যে দূরত্ব ৮০০ মিটার (দুই হাজার ৬০০ ফুট)। ভেঙে যাওয়া জাহাজটির আশপাশে প্রচুর ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে।

২০২২ সালের গ্রীষ্মকালে ম্যাগেলান লিমিটেড নামের একটি ডিপ-সি ম্যাপিং কোম্পানি এবং আটলান্টিক প্রোডাকশন্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান যারা এ বিষয়ে একটি তথ্যচিত্র তৈরি করছে তারা যৌথভাবে এসব ছবি তুলেছে।

নিমজ্জনযোগ্য একটি বিশেষ জাহাজে করে এক দল কর্মী এই জরিপ পরিচালনা করেছে যা রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ মিলিয়ে পুরো টাইটানিকে ছবি তুলতে তারা ২০০ ঘণ্টারও বেশি সময় ব্যয় করেছে।

নিমজ্জিত জাহাজের প্রত্যেকটি কোণ থেকে তারা সাত লাখেরও বেশি ছবি তুলেছে যেগুলোর সাহায্যে পুরো টাইটানিকের একটি ত্রিমাত্রিক বা থ্রিডি ছবি তৈরি করা হয়েছে।

এই অভিযানের পরিকল্পনায় নেতৃত্ব দিয়েছেন ম্যাগেলান লিমিটেডের গেরহার্ড সেফার্ট। তিনি বলছেন, এখনো পর্যন্ত পানির নিচে ছবি তোলার যতো প্রকল্প তিনি পরিচালনা করেছেন তার মধ্যে এটিই সবচেয়ে বড়।

তিনি আরো বলেন, ‘গভীরতা প্রায় চার হাজার মিটার। আমাদের সামনে ছিল এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। একইসাথে সেখানে পানির স্রোতও আছে। আমাদের কোনো কিছু স্পর্শ করার অনুমতি ছিল না, যাতে জাহাজের ধ্বংসাবশেষের আরো ক্ষতি না হয়। আরেকটি চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আপনাকে প্রত্যেক বর্গসেন্টিমিটারের ম্যাপিং করতে হবে। এমনকি জাহাজের যেসব অংশ আগ্রহ-উদ্দীপক নয় সেগুলোরও। যেমন যেখানে ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে সেখানকার মাটির ছবি। কারণ জাহাজের বিভিন্ন অংশকে জোড়া দেওয়ার জন্য এগুলোও ছবি প্রয়োজন।’

টাইটানিকের যা কিছু দেখা যাচ্ছে
এসব ছবিতে টাইটানিকের বিশালত্বের পাশাপাশি এই জাহাজের একটি প্রপেলারের সিরিয়াল নম্বরের মতো ছোটখাটো বিষয়ও ধরা পড়েছে। জাহাজটির সম্মুখভাগে মরিচা ধরে ঢাকা পড়ে গেছে। তার পরেও শতাধিক বছর আগে ডুবে যাওয়া এই জাহাজটিকে চেনা যায়। এর ওপরেই রয়েছে জাহাজের ডেক যেখানে একটি গর্ত রয়েছে। সেখান থেকে একটা শূন্যতা দেখতে পাওয়া যায় যেখানে একসময় ছিল জাহাজের বিশাল সিঁড়ি।

আর জাহাজের পশ্চাদভাগে বিভিন্ন ধাতব পদার্থের জঞ্জাল। জাহাজের এই অংশটি সমুদ্রের তলদেশে পড়ে যাওয়ার সাথে সাথে ধসে পড়ে। টাইটানিকের আশপাশে বিভিন্ন জিনিস ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। এসবের মধ্যে রয়েছে জাহাজ থেকে খসে পড়া অলঙ্কৃত ধাতব বস্তু, মূর্তি এবং মুখ খোলা হয়নি এরকম শ্যাম্পেনের বোতল। সেখানে ব্যক্তিগত জিনিসপত্রও রয়েছে। ছবিতে দেখা যায় সমুদ্রের তলানির ওপর অসংখ্য জুতা পড়ে আছে।

পার্কস স্টিফেনসন, যিনি বহুবছর ধরে টাইটানিকের ওপর গবেষণা করছেন। তিনি বলছেন, ‘এসব ছবি প্রথমবার দেখে তিনি ‘বিস্মিত’ হয়েছিলেন। আপনি জাহাজের এমন ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাচ্ছেন যা কখনও দেখা সম্ভব হয়নি। এবং আপনি ডুবন্ত পুরো জাহাজটিকে দেখতে পাচ্ছেন। আশপাশের পরিবেশসহ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আপনি এটাকে দেখতে পাচ্ছেন। আপনি যা দেখতে পাচ্ছেন এটাই এখন এই জাহাজের সত্যিকারের অবস্থা।’

তিনি বলেন, ‘এসব ছবি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখলে ১৯১২ সালের ওই ভয়াবহ রাত্রিতে টাইটানিকের ক্ষেত্রে মূলতই কী ঘটেছিল ওই বিষয়ে নতুন কিছু ধারণা পাওয়া যেতে পারে। আইসবার্গের সোথে কেমন করে সংঘর্ষ হয়েছিল ওই বিষয়ে মূলত আমাদের ধারণা নেই। আমরা এও জানি না, সিনেমাতে যেমন দেখানো হয়েছে সেরকম করে জাহাজের সামনের একপাশের সাথে সংঘর্ষ হয়েছিল কি না। জাহাজের পেছনের অংশ গবেষণা করলে টাইটানিক কিভাবে সমুদ্রের তলদেশে আঘাত হেনেছিল সেবিষয়েও ধারণা পাওয়া যেতে পারে ‘

সমুদ্রের পানিতে ডুবে যাওয়া জাহাজের ক্ষয় অব্যাহত রয়েছে। পানিতে থাকা অণুজীব বা জীবাণু ক্রমশই এটিকে খেয়ে ফেলছে। এছাড়াও এর বিভিন্ন অংশ ক্রমশই আলাদা হয়ে খসে পড়ছে।

সমুদ্রে এরকম একটি দুর্ঘটনার কারণ বুঝতে সময় যে ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে ইতিহাসবিদরা এবিষয়েও সচেতন। কিন্তু এখন যেসব ছবি পাওয়া গেল, সেখান থেকে জাহাজের খুঁটিনাটি বিষয়ও বিশেষজ্ঞরা পরীক্ষা করে দেখতে পারবেন। আশা করা হচ্ছে যে এখন হয়তো টাইটানিকের আরো অনেক গোপন বিষয় বের হয়ে আসবে।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement