যুদ্ধের অদৃশ্য সব হুমকি মোকাবেলার কৌশল ঠিক করা হচ্ছে যেখানে
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১০:৪৫
গত সেপ্টেম্বর মাসে বাল্টিক সাগরে ডেনমার্ক ও সুইডেনের উপকূলের মাঝামাঝি জায়গায় এক বিস্ফোরণে নর্ড স্ট্রিম গ্যাস পাইপলাইনে বড় ছিদ্র তৈরি হয়।
সাগরের নিচে হঠাৎ রহস্যজনক বিস্ফোরণ, নাম না জানা সূত্র থেকে সাইবার হামলা, অথবা পশ্চিমা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে খাটো করতে অনলাইনে সুচতুর প্রচারণা- এমন সব ‘হাইব্রিড হুমকি’ যুদ্ধের বড় অস্ত্র হয়ে উঠছে।
আর এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে ন্যাটো সামরিক জোট এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
‘নিজের স্বার্থ সিদ্ধিতে তথ্যপ্রবাহকে ব্যবহার করা, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোতে হামলা,’ হাইব্রিড যুদ্ধ ঠিক কী সে প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে বলেন টিজা টিলিকাইনেন।
ইউরোপিয়ান সেন্টার অব একসেলেন্স ফর কাউন্টারিং হাইব্রিড থ্রেট (হাইব্রিড সিওই) নামক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক তিনি। ছয় বছর আগে এই সেন্টারটি প্রতিষ্ঠিত হয় ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিঙ্কিতে।
মিজ টিলিকাইনেন বলেন, এসব হুমকি এতটাই অস্পষ্ট, অদৃশ্য এবং অকস্মাৎ যে- কোনো দেশের পক্ষেই এসব হুমকি মোকাবেলা অত্যন্ত জটিল এবং কঠিন কাজ।
কিন্তু এসব হুমকি কোনো কল্পকথা নয়, একবারেই বাস্তব।
গত সেপ্টেম্বর মাসে বাল্টিক সাগরে ডেনমার্ক ও সুইডেনের উপকূলের মাঝামাঝি জায়গায় এক বিস্ফোরণে নর্ড স্ট্রিম গ্যাস পাইপলাইনে বড় ছিদ্র তৈরি হয়। রুশ গ্যাস জার্মানিতে নিতে এই পাইপলাইন তৈরি হয়।
বিস্ফোরণের সাথে সাথেই রাশিয়া বলে তারা এর পেছনে নেই। কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলোর দৃঢ় বিশ্বাস ইউক্রেন যুদ্ধে ইউরোপের অবস্থানের কারণে তাদের শায়েস্তা করতে রাশিয়াই এই কাণ্ড ঘটিয়েছে যাতে ইউরোপ জ্বালানি সঙ্কটে নাজেহাল হয়ে পড়ে। তারপর রয়েছে নির্বাচনে গোপন হস্তক্ষেপ।
খুব কম মানুষই তা অনুধাবন করতে পেরেছে, কিন্তু ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন প্রক্রিয়া তদন্ত করে দেখা গেছে রাশিয়া সুপরিকল্পিতভাবে নির্বাচনে মাথা গলিয়েছে। তাদের লক্ষ্য ছিল হিলারি ক্লিনটনের বিজয়ের সম্ভাবনা কমানো। তদন্তের এই ফলাফল মস্কো অবশ্য সবসময় অস্বীকার করেছে।
অভিযোগ রয়েছে, অনলাইনে ‘বটস’ ব্যবহার করে এ কাজ করেছে রাশিয়া।
সেন্ট পিটার্সবার্গে বসে সরকার সমর্থিত অনলাইন অ্যাকটিভিস্টরা সোশ্যাল মিডিয়াতে ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলে ক্রমাগত হিলারি ক্লিনটনকে ট্রল করে গেছে।
অন্য কৌশলটি হলো- কোনো বিষয়ের বা ঘটনার একটি কাল্পনিক, ভুয়া এবং উদ্দেশ্যমূলক ব্যখ্যা তৈরি করে তা ক্রমাগত প্রচার করে যাওয়া। জনগণের একাংশ এসব ব্যাখ্যায় প্রভাবিত হয়।
ইউক্রেনে হামলার পর অনলাইনে এ ধরনের প্রচারণা বেড়েছে। নিজের নিরাপত্তার জন্য এই হামলা অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছিল বলে মস্কোর যে ব্যাখ্যা তা শুধু রাশিয়ায় নয় পুরো ইউরোপের বহু মানুষ বিশ্বাস করে।
এসব হুমকি যাতে পশ্চিমা দেশগুলো চিহ্নিত করতে পারে এবং নিজেদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে পারে সে লক্ষ্যে ন্যাটো জোট এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ফিনল্যান্ডে হাইব্রিড সিওই প্রতিষ্ঠা করেছে।
১৯৪০ সালের শীতকালে রাশিয়ার সাথে সংক্ষিপ্ত এক যুদ্ধে হারার পর কয়েক দশক ধরে থেকে ফিনল্যান্ড ইউরোপের সামরিক রেষারেষিতে নিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করেছে।
রাশিয়া ও ফিনল্যান্ডের মধ্যে ১৩০০ কি.মি. সীমান্ত রয়েছে। কিন্তু দেশটি ধীরে ধীরে পশ্চিম ইউরোপের ঘনিষ্ঠ হচ্ছে এবং গত বছর তারা ন্যাটো জোটে সদস্যপদের জন্য আবেদনও করেছে।
তিনি বলেন, শীতের এক সকালে আমি যখন হাইব্রিড সিওইতে যাই তখন হেলসিঙ্কিতে কনকনে ঠান্ডা এবং তুষারপাত হচ্ছিল। সেন্টারটি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছেই একটি অফিস ব্লকে। রুশ দূতাবাস এখান থেকে বেশি দূরে নয়।
ন্যাটো এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের বেশ কতগুলো দেশের ৪০ জনের মতো বিশেষজ্ঞ এখানে কাজ করেন। ব্রিটেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজনও রয়েছেন সেখানে।
তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন টেইজা টিলিকাইনেন। তিনি বলেন, বর্তমানে তারা আর্কটিক অঞ্চলের দিকে মনোনিবেশ করেছেন। সেখান সম্ভাব্য ‘হাইব্রিড হুমকি’ চিহ্নিত করা হয়েছে।
‘অঞ্চলটিতে জ্বালানির মজুত রয়েছে, তিনি বলেন। ‘শক্তিধর দেশগুলো যে এখানে তাদের স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করবে সে সম্ভাবনা প্রবল। তথ্য নিয়ে কারসাজি শুরু হয়েছে।
‘রাশিয়া বলে আর্কটিক একটি বিশেষ অঞ্চল যা বিরোধপূর্ণ এলাকার বাইরে। এখানে খারাপ কিছু হচ্ছে না। কিন্তু তারপরও রাশিয়া সেখানে তাদের সামরিক শক্তি জোরদার করছে।’
হাইব্রিড এসব হুমকির একটি হলো- সাগরের নিচে বিস্ফোরণ যা নিয়ে এ অঞ্চলের দেশগুলো ক্রমেই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছে।
হাইব্রিড হুমকি চোখে দেখা যায় না। কেউ এখানে অস্ত্র হাতে নিয়ে গুলি চালায় না। কিন্তু অদৃশ্য এসব হুমকির ভয়াবহতা একেবারেই কম নয়। কে বা কারা এই হুমকির পেছনে রয়েছে তা খুঁজে বের করাও খুবই কঠিন।
যেমন, ২০০৭ সালে এস্তোনিয়ায় ব্যাপক মাত্রার সাইবার হামলা কে ঘটিয়েছিল তা এখনো অস্পষ্ট। গত বছর বাল্টিক সাগরের নিচে বিস্ফোরণের হোতা সম্পর্কেও শতভাগ নিশ্চিত হওয়া যায়নি। হামলাকারী খুব কমই তথ্য-প্রমাণ ফেলে যায়।
সরাসরি যুদ্ধ না করেও কোনো দেশ বিভিন্ন উপায়ে অন্য দেশকে মহাবিপদে ফেলতে পারে।
সাগরে কী কী ধরনের হাইব্রিড হুমকি তৈরি হতে পারে তা নিয়ে হাইব্রিড সিওই একটি হ্যান্ডবুক তৈরি করেছে। তাতে কাল্পনিক কিন্তু খুবই সম্ভাব্য ১০টি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- সাগরের নিচে গোপনে কিছু অস্ত্র ব্যবহার, একটি দ্বীপের চারদিকে নিয়ন্ত্রিত এলাকা ঘোষণা, একটি সংকীর্ণ প্রণালীতে অবরোধ তৈরি।
ইউক্রেনে হামলা শুরুর আগে আজভ সাগরে রুশ তৎপরতা নিয়ে এই সেন্টারে গবেষণা হয়েছে। ২০১৮ সালের অক্টোবর মারিউপোল এবং বারদিয়ানস্ক বন্দর ছাড়ার পর এবং বন্দরে যাওয়ার আগে ইউক্রেনীয় জাহাজগুলোকে রুশ কর্মকর্তাদের পরিদর্শনের জন্য কার্চ প্রণালীতে দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হতো।
এজন্য জাহাজগুলাকে অনেক সময় দু'সপ্তাহ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। এর ফলে, ইউক্রেনের অর্থনীতির ওপর তা মারাত্মক বিরূপ প্রভাব ফেলতে শুরু করেছিল বলে জানান ওই সেন্টারের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
তবে সেন্টারের বিশেষজ্ঞরা সবচেয়ে বিস্মিত হয়েছেন তথ্য নিয়ে কারসাজির ফলাফল দেখে। ইউরোপ জুড়ে বিভিন্ন জনমত জরীপ বিশ্লেষণ করে তারা দেখতে পেয়েছেন বেশ কতগুলো ন্যাটো দেশে তথ্য যুদ্ধে রাশিয়া এগিয়ে রয়েছে। জনগণের বিরাট অংশ যুদ্ধ নিয়ে রুশ ব্যাখ্যায় বিশ্বাসী।
যেমন, জার্মানি। ন্যাটো জোটের উসকানির কারণেই ইউক্রেনে হামলা করতে রাশিয়া বাধ্য হয়েছে বলে যে ব্যাখ্যা মস্কো দিয়েছে তা সে দেশে অনেকেই গ্রহণ করেছে।
স্লোভাকিয়ায় ৩০ শতাংশেরও বেশি মানুষ বিশ্বাস করে ইউক্রেনে যুদ্ধের মূল কারণ পশ্চিমা উসকানি।
হাঙ্গেরিতে ১৮ শতাংশ মানুষ বিশ্বাস করে ইউক্রেনে জাতিগত রুশদের ওপর নির্যাতনের কারণেই যুদ্ধ শুরু হয়।
ওই সেন্টারে কর্মরত চেক গবেষক জেকব কালেনস্কি মস্কোর এই প্রচারণা ঠেকানোর প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে গিয়ে পানির উদাহরণ টানেন।
‘আমি মনে করি না রুশ এই প্রচারণা খুব ক্ষুরধার। বার্তা কতটা আকর্ষণীয় সেটা বড় কথা নয়, কিন্তু তারা সাফল্য পাচ্ছে সংখ্যা দিয়ে। বিশাল সংখ্যক মানুষ ব্যবহার করে ব্যাপকহারে এই তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ার প্লাটফর্মগুলোতে এই মানুষগুলোকে জায়গা দেয়ার কোনো কারণ নেই। সবাই সুপেয় পানির জলাধারে যেতে চায়, কিন্তু ওই জলাধারে কেউ বিষ ছড়াতে শুরু করলে তা হতে দেয়া যায় না,’ বলেন তিনি।
মিজ টিলিকাইনেন বলেন, এসব হাইব্রিড হুমকির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া তাদের সেন্টারের কাজ নয়। তাদের কাজ হচ্ছে বাস্তব পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করা এবং তারপর সেই হুমকি কিভাবে মোকাবেলা করা যায় তা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ এবং পরামর্শ দেয়া।
সূত্র : বিবিসি