২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

আল-কায়েদার পরের নেতা কে

সায়েফ আল-আদেল : ২০০১ সালে এফবিআইএর প্রকাশিত ছবি। - ছবি : বিবিসি

আল-কায়েদার নেতা আয়মান আল-জাওয়াহিরির মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্রের আক্রমণে নিহত হবার ঘটনাটি ছিল একেবারেই আকস্মিক। এরপর স্বাভাবিকভাবেই যা নিয়ে কৌতুহল তৈরি হয় তা হলো- কে হতে যাচ্ছেন এই সংগঠনটির নতুন নেতা?

আরো একটি প্রশ্ন- আল-কায়েদার এখন কি হবে এবং ২০২২ সালে এই সংগঠনটি আর প্রাসঙ্গিক আছে কিনা।

তবে মনে করা হচ্ছে, আল-কায়েদার পরের নেতা হবার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি এমন একজনের- যাকে অনেকে দেখেন একজন রহস্যময় ব্যক্তি হিসেবে।

আল কায়েদার মিশন
আল-কায়েদার লক্ষ্য হচ্ছে, সারা বিশ্বে পশ্চিমা স্বার্থের ওপর আক্রমণ চালানো এবং এশিয়া ও আফ্রিকায় নানা দেশের সরকারের পতন ঘটানো। যারা তাদের মতে, পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে অতি ঘনিষ্ঠ এবং যথেষ্ট ইসলামিক নয়।

তারা যে শুধু ধর্মদ্রোহী সরকারগুলোকে উৎখাত করার জন্যই লড়ছে তাই নয়, বর্তমানে ইসলামিক স্টেটের মতো অন্য জিহাদি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধেও তাদের লড়াই করতে হচ্ছে।

আফ্রিকার সাহেল অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে ও সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমে এখনো বেশ জোরদার উপস্থিতি আছে আল-কায়েদার। তাদের গোপন আশ্রয়গুলোতে মার্কিন ও বিশেষ বাহিনীগুলো প্রায়ই ড্রোন হামলা চালিয়ে থাকে।

বিবিসির নিরাপত্তা বিশ্লেষক ফ্র্যাংক গার্ডনার বলছেন, আল-কায়েদা মূলত একটি মধ্যপ্রাচ্য-ভিত্তিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। বিন লাদেন একজন সৌদি, আল-জাওয়াহিরি একজন মিশরীয়। তাদের সিনিয়র নেতৃত্বের প্রায় সবাই আরব।

আল-জাওয়াহিরি নিহত হবার পর আল-কায়েদা হয়তো চাইবে- একজন নতুন নেতা ও নতুন কৌশল নিয়ে তাদের সুদিন আবার ফেরানোর চেষ্টায় নামতে। সম্ভাব্য এই পরবর্তী নেতা কে হতে পারেন- তার প্রতি আগ্রহের কারণ সেটাই।

সবচেয়ে বেশি শোনা যাচ্ছে, সায়েফ আল-আদেলের নাম। যার কথা সবচেয়ে বেশি শোনা যাচ্ছে, সেই রহস্যময় ব্যক্তিটির নাম সায়েফ আল-আদেল।

মিশরে জন্ম নেয়া এই সায়েফ আল-আদেল হচ্ছেন, আল-কায়েদার সেই পাঁচজন পুরোনো সদস্যদের একজন, যাদেরকে এক সময় আল-জাওয়াহিরির ডেপুটি হিসেবে দেখা হতো। ওই পাঁচজনের মধ্যে একমাত্র এই আল-আদেলই বেঁচে আছেন।

মনে করা হচ্ছে, তিনিই হয়তো হবেন আল-কায়েদার পরবর্তী নেতা, তবে এক্ষেত্রে একটা সমস্যা আছে। সেটা হলো, আল-আদেল এখন বাস করছেন ইরানে এবং তিনি সেখানে নানা ধরণের বিধি-নিষেধের অধীন।

তা ছাড়া, শিয়া-প্রধান ইরান হচ্ছে এমন একটি দেশ যাকে আল-কায়েদা তাদের ঘোর শত্রু হিসেবে দেখে থাকে। প্রবীণ জিহাদি আল-আদেলকে দেখা হয় একজন রহস্যময় ব্যক্তি হিসেবে।

আল-কায়েদার প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একজন তিনি। তা ছাড়া ওসামা বিন লাদেনের একজন বিশ্বস্ত সহযোদ্ধা এবং জিহাদি আদর্শের একজন সম্মানিত প্রবীণ নেতা।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষের কাছে আল-আদেল একজন পার্সন অব ইন্টারেস্ট। অর্থাৎ যার ওপর তারা নজর রাখে। এফবিআইয়ের মোস্ট ওয়ান্টেড টেরর লিস্টে তার নাম আছে এবং তার ব্যাপারে তথ্য দেবার জন্য এক কোটি ডলারের পুরস্কার ঘোষণাও করা হয়েছে।

আল-কায়েদার বোমা হামলায় সংশ্লিষ্টতা
সায়ফ আল-আদেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি তানজানিয়া ও কেনিয়ায় ১৯৯৮ সালে মার্কিন দূতাবাসে চালানো দু’টি বোমা হামলার সাথে জড়িত ছিলেন- যাতে ২২০ জন নিহত হয়েছিল।

কিন্তু বিভিন্ন রিপোর্টের খবর হলো, ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্ক ও ওয়াশিংটনে যে আক্রমণ চালানো হয়, তার বিরোধী ছিলেন এই আল-আদেল।

ওয়েস্ট পয়েন্ট নামে যুক্তরাষ্ট্রের মিলিটারি অ্যাকাডেমির গবেষকরা ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত এক দলিলে এমনটাই দাবি করেছিলেন।

এতে বলা হয়, আল-আদেল ও অন্য আরো কয়েকজন সিনিয়র আল-কায়েদা নেতা আশঙ্কা করেছিলেন যে, আমেরিকার মাটিতে বড় আকারের হামলা চালানো হলে আমেরিকার দিক থেকে কড়া প্রতিক্রিয়া হবে এবং এর অংশ হিসেবে তারা আল-কায়েদার লোকদের নিরাপদ আশ্রয় আফগানিস্তানেও আক্রমণ চালাতে পারে। পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ বলে দেয়, আল-আদেলের আন্দাজ ছিল নির্ভুল।

এ ছাড়াও নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা তথ্য, যুদ্ধ ও বিপ্লব ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বিস্তারিত লেখালিখি করেছেন আল-আদেল। আল-কায়েদায় যোগ দেবার আগে সায়েফ আল-আদেলের জীবন কেমন ছিল, সে সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়।

এফবিআইয়ের তথ্য মতে, সম্ভবত ১৯৬৩ সালের ১১ এপ্রিল অথবা তার তিন বছর আগে আল-আদেলের জন্ম। আল-কায়েদায় তার অবস্থান উচ্চ হলেও তিনি খুব পরিচিত ছিলেন না এবং এই গোষ্ঠীটির প্রচার-প্রচারণাতেও তার উপস্থিতি খুব কমই দেখা যায়।

তার আসল নাম নিয়েও সংশয় আছে। মনে করা হয়, সায়েফ আল-আদেল (যার অর্থ ন্যায়বিচারের তরবারি) হয়তো একটি ছদ্মনাম।

অনেকের ধারণা, আল-আদেল আসলে হচ্ছেন মিশরীয় বিশেষ বাহিনীর একজন সাবেক কর্নেল মোহাম্মদ ইব্রাহিম মাক্কাওই। কিন্তু ওয়েস্ট পয়েন্টের গবেষকরা মনে করেন, এ ধারণা ভুল। তিনি ১৯৮০’র দশকে আফগানিস্তানে ওসামা বিন লাদেনের পাশাপাশি সোভিয়েত দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। সেটা আল-কায়েদা প্রতিষ্ঠানের একেবারে প্রথম দিকের কথা।

আল-আদেল এরপর সোমালিয়ায় চলে যান এবং সেখানকার গৃহযুদ্ধে মার্কিন হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত জঙ্গীদের প্রশিক্ষণে ভুমিকার রাখেন।

একটি ঘটনার জন্য ওই যুদ্ধ বিখ্যাত হয়েছিল। সেটি হলো- এক রকেট হামলায় দু’টি আমেরিকান এমএইচ-সিক্স জিরো ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টার ভূপাতিত হওয়া। এই ঘটনা নিয়ে পরে ২০০১ সালে একটি ব্লকবাস্টার হলিউড সিনেমা হয়েছিল, যার নাম ব্ল্যাক হক ডাউন।

ধারণা করা হয়, এর মধ্যে একটি রকেট নিক্ষেপ করেছিল আল-আদেলের যোদ্ধাদেরই একজন তিউনিসিয়ান সদস্য। এরপর ১৯৯০-এর দশকে আফগানিস্তানে ফিরে আসেন আল-আদেল। সেটা এমন এক সময় যখন তালেবান সারা আফগানিস্তান জুড়ে তাদের দখল সংহত করছে।

১১ সেপ্টেম্বরের হামলার পর ২০০১ সালে যখন মার্কিন বাহিনী আফগানিস্তানে আক্রমণ চালায়, তখন আল-আদেলের নেতৃত্বে একদল আল-কায়েদা সদস্য নিরাপদ আশ্রয়ের একটি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ইরানে চলে যায়।

তবে ধারণা করা হয়, ২০০৩ সালে তাকে গ্রেফতার করে ইরানী কর্তৃপক্ষ। এর ১২ বছর পর এক বন্দী বিনিময়ের চুক্তির অধীনে আল-আদেল এবং আরো কয়েকজন আল-কায়েদা সদস্য মুক্তি পান। দীর্ঘ সময় অন্তরীণ অবস্থায় থাকলেও আল-কায়েদার ভেতরে একজন প্রভাবশালী নেতা ছিলেন আল-আদেল।

আল-কায়েদার নেতা ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করে আমেরিকান বাহিনী ২০১১ সালের মে মাসে - পাকিস্তানের এ্যাবোটাবাদ শহরে এক আক্রমণ চালিয়ে। এর পর খুব দ্রুতই আল-কায়েদা তাদের নতুন নেতা নির্বাচন করে বিন লাদেনের তার ঘনিষ্ঠ পার্শ্বচর আয়মান আল-জাওয়াহিরিকে।

আল-কায়েদার নেতা হিসেবে জাওয়াহিরির অবস্থান সুদৃঢ় করার কাজেও সহায়তা করেন আল-আদেল। তবে কিছু বিশেষজ্ঞের মতে, ইরানে আল-আদেলের অবস্থানের বিষয়টি পরিস্থিতিকে একটু কঠিন করে তুলেছে।

সন্ত্রাসবাদ বিশেষজ্ঞ কলিন পি ক্লার্ক দাবি করেন, আল-আদেল এখনো ইরানেই আছেন এবং তিনি সেখানে আধা-গৃহবন্দী হিসেবে জীবন কাটাচ্ছেন। এ ব্যাপারটি আল-কায়েদার নেতা হিসেবে তার অভিষেকের পথে একটা বাধা হয়ে উঠতে পারে।

প্রথমত, একটি শিয়া রাষ্ট্রে নানা বিধিনিষেধের মধ্যে বাস করে তিনি কার্যকরভাবে একটি বৈশ্বিক জিহাদি সংগঠনের নেতৃত্ব দিতে পারবেন, এ ব্যাপারটা প্রায় অকল্পনীয়।

দ্বিতীয়ত, নিরাপত্তার প্রশ্নটি।

আল-কায়েদার আরেকজন শীর্ষস্থানীয় সদস্য ছিলেন আবু মুহাম্মদ আল-মাসরি, যিনি ২০২০ সালে তেহরানে নিহত হন।

অভিযোগ করা হয় যে, এক গোপন অপারেশনে তাকে হত্যা করেছিল ইসরায়েলি কম্যান্ডোরা।

আল-কায়েদার নেতার পদে অন্য প্রার্থীর তালিকা খুব একটা বড় নয়।

কারণ, সংগঠনটির সিনিয়র নেতাদের মধ্যে অনেকেরই আল-জাওয়াহিরির মতই পরিণতি হয়েছে।

এটাও হতে পারে যে, সোমালিয়ার আল-শাবাব, ইয়েমেনের একিউএপি, বা মালির জেএনআইএম-এর মতো তাদের আঞ্চলিক সংগঠনগুলোতে যে প্রধানরা রয়েছে, তাদের কেউ একজনকেও করা হতে পারে আল-কায়েদার শীর্ষ নেতা।

সে ক্ষেত্রে এটা হবে এক নজিরবিহীন ঘটনা। কিন্তু তা হয়তো খুব বিস্ময়কর কিছু হবে না। কারণ, আল-জাওয়াহিরির সময় থেকেই আল-কায়েদায় এরকম বিকেন্দ্রীকরণের প্রবণতা বাড়ছিল। যেমন, ২০১৩ সালে একিউআইএম-এর নেতা নাসির আল-উহাইশিকে জাওয়াহিরির ডেপুটি হিসেবে নিয়োগ করা হয় বলে খবর বেরিয়েছিল।

এতে আভাস পাওয়া যায় যে, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ভূমিকাতেও আঞ্চলিক নেতাদের নাম বিবেচনা করা হচ্ছে। তবে আল-উহাইশির সে সুযোগ হবে না। কারণ, তিনি ২০১৫ সালেই এক মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত হয়েছেন।

তালেবান নেতা হিবাতুল্লাহ আখুনজাদা ও আল-জাওয়াহিরি। তালেবানের আশ্রয়েই কাবুলে ছিলেন।

তাই, ভবিষ্যৎ আল-কায়েদা নেতা যিনিই হন, তাকে আল-জাওয়াহিরির মতো একই অসুবিধার সম্মুখীন হতে হবে। তাকে লো প্রোফাইল রেখে চলতে হবে। অর্থাৎ আমেরিকান আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হবার ঝুঁকি কমাতে তাকে হতে হবে কম দৃশ্যমান।

আল-কায়েদা এক সময় একটি ছোট এবং কেন্দ্রীভূত সংস্থা ছিল । কিন্তু এখন এটি একটি বৈশ্বিক ফ্রাঞ্চাইজে পরিণত হয়েছে। এক সময় ঘরে ঘরে এর নাম শোনা যেতো, আর পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে তারা ছিল এক নম্বর নিরাপত্তা হুমকি।

কেন? কারণটা হচ্ছে, সে সময় তারা একের পর এক সাহসী, জটিল ও সফল সন্ত্রাসী আক্রমণ চালাতে সক্ষম হয়েছিল এবং তাদের অনুসারীরাও এ সংগঠনে যোগ দিতে আরো বেশি করে অনুপ্রাণিত হচ্ছিল।

এসব আক্রমণের মধ্যে আছে কেনিয়া ও তানজানিয়ায় ১৯৯৮ সালে মার্কিন দূতাবাসের ওপর চালানো বোমা আক্রমণ, ২০০০ সালে এডেনে মার্কিন রণতরী ইউএসএস কোলে বিস্ফোরকভর্তি স্পিডবোট দিয়ে আক্রমণ। আর ২০০১-এর ১১ সেপ্টেম্বরের হামলা, আর তার পর যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ তো এক কথায় পুরো দুনিয়াকেই পাল্টে দিয়েছে।

বিবিসির বিশ্লেষক ফ্র্যাংক গার্ডনার বলছেন, - ৯/১১-র আক্রমণ ছিল মার্কিন গোয়েন্দা ব্যবস্থার এক চরম ব্যর্থতার নিদর্শন।

বর্তমানে আল-কায়েদার সবচেয়ে বড় এবং শক্তিশালী শাখা হচ্ছে আল-শাবাব। কিন্তু এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আফগানিস্তান থেকে গত বছর মার্কিন সৈন্যদের পুরোপুরি প্রত্যাহারের পর- আল-কায়েদার জন্য নতুন নতুন সুযোগ খুলে গেছে।

আল-জাওয়াহিরি যেভাবে কাবুল শহরে বাস করছিলেন তাতে বোঝাই যায় যে, আল-কায়েদার সাথে সম্পর্ক ভাঙার কোনো ইচ্ছাই তালেবানের নেই। পৃথিবীর বহু জায়গায়, বিশেষতঃ প্রশাসন নেই বা থাকলেও যা খুবই দুর্বল, এমন জায়গাগুলোতে তাদের অনুসারী গোষ্ঠী আছে।

যেমন আফ্রিকার সোমালিয়াতে তাদের সহযোগী আল-শাবাব হচ্ছে সবচেয়ে বড় জিহাদি গোষ্ঠী। আফ্রিকা ও সিরিয়ায় আল-কায়েদা ও সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো এখনো সক্রিয়।

কাজেই পশ্চিমা গোয়েন্দা সূত্রগুলো নিশ্চয়ই আল-কায়েদার হুমকি শেষ হয়ে গেছে, এমনটা ভাবার মতো বোকামি করবে না।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement