২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ইতালি থেকে আনা হচ্ছে সাগরে মারা যাওয়া বাংলাদেশীদের লাশ

ইতালি থেকে আনা হচ্ছে সাগরে মারা যাওয়া বাংলাদেশীদের লাশ - ছবি : সংগৃহীত

নৌকায় করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাবার পথে প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় জমে মৃত্যু হয়েছিল যে সাতজন বাংলাদেশীর। তাদের লাশ এখন দেশে আসার অপেক্ষায় রয়েছে।

মৃতদের একজন জয় তালুকদারের দেহ ১০ই ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় ইতালি থেকে পাঠানো হবে, আর তা ঢাকায় এসে পৌঁছাবে ১২ই ফেব্রুয়ারি ভোররাতে। এছাড়া কামরুল হাসান বাপ্পির লাশ ১১ই ফেব্রুয়ারি ইতালি থেকে পাঠানো হবে এবং তা ঢাকায় এসে পৌঁছবে ১৩ই ফেব্রুয়ারি।

‘কথিত বাংলাদেশী’ ও নিন্দার ঝড়

অবৈধভাবে ইটালি যাবার পথে ভূমধ্যসাগরে নৌকা ডুবে বাংলাদেশীদের মৃত্যুর ঘটনা নতুন কোন বিষয় নয়। কিন্তু ঠাণ্ডায় জমে মৃত্যুর ঘটনাটি অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাদের মৃত্যুর খবর গণমাধ্যমে আসার পর রোমে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস প্রথমে দায়িত্ব নিতে চায়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।

ইটালিস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস তাদের পরিচয় নিয়ে যে সন্দেহ প্রকাশ করেছিল, তাতেও নিন্দার ঝড় উঠেছিল প্রবাসী বাংলাদেশীদের মধ্যে।

সাত বাংলাদেশীর ঠাণ্ডায় জমে মারা যাবার খবরটি গণমাধ্যমে আসে গত ২৫শে জানুয়ারি। ২৮শে জানুয়ারি রোমে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের পক্ষ থেকে দেয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে মৃতদের ‘কথিত বাংলাদেশী’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছিল।

অথচ ইতালির ল্যাম্পাডুসার মেয়র সালভারোতে মারতেল্লো ঘটনার পরপরই বাংলাদেশীদের প্রাণহানির ঘটনা নিশ্চিত করেছিলেন। বাংলাদেশ দূতাবাসের বিবৃতিতে বলা হয়, প্রকৃত তথ্য অনুসন্ধান এবং যথোপযুক্ত করণীয় নির্ধারণের মাধ্যমে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে।

সে বিবৃতিতে আরো বলা হয়, ঘটনার পরদিনই অর্থাৎ ২৬শে জানুয়ারি দূতাবাসের শ্রম বিষয়ক কর্মকর্তা মো. এরফানুল হকের নেতৃত্বে দুই সদস্য বিশিষ্ট একটি দল ল্যাম্পাডুসা দ্বীপে পৌঁছায়।

‘কথিত বাংলাদেশী’ শব্দটি তীব্র ক্ষোভের জন্ম দেয় ইতালি-প্রবাসী বাংলাদেশীদের মধ্যে। এমন ভাষা ব্যবহারের কারণে দূতাবাসের কড়া সমালোচনা করেন তারা।

এ বিষয়টি নিয়ে যারা বেশ সোচ্চার ছিলেন, তাদের মধ্যে একজন ইটালি-প্রবাসী সাংবাদিক মো. ইউসুফ আলী। তিনি বলেন, বাংলাদেশি মারা যাবার খবর সংবাদমাধ্যমে আসার পরে দূতাবাস বিষয়টিকে তেমন একটা গুরুত্ব দিতে চায় না। আলীর অভিযোগ হচ্ছে, দূতাবাসের কর্মকর্তারা প্রবাসী বাংলাদেশীদের সমস্যা ও সংকটের বিষয়গুলোকে এমনিতেই কোন গুরুত্ব দেয় না।

‘প্রবাসীদের তারা অবজ্ঞার চোখে দেখে। এই 'কথিত বাংলাদেশি' লেখার মাধ্যমে সে বিষয়টির প্রতিফলন হয়েছে।’ ‘কথিত বাংলাদেশী’ হিসেবে বর্ণনা করে দূতাবাস তাদের দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে চেয়েছিল বলে মন্তব্য করেন আলী।

‘ইটালির স্থানীয় প্রশাসন মৃতদের পরিচয় নিশ্চিত হয়েছে। তাছাড়া নৌকা থেকে আরো অনেক বাংলাদেশী জীবিত অবস্থায় উদ্ধার হয়েছিল। তারাও লাশের পরিচয় নিশ্চিত করেছে। তাহলে দূতাবাস কেন তাদের পরিচয় নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলো?’

‘কথিত বাংলাদেশী লেখার পরে বিষয়টা ভাইরাল হয়ে যায়। ইতালিতে বসবাসকারী হাজার হাজার বাংলাদেশী ফেসবুকে বিষয়টির নিন্দা করেছে।’

ঘটনার চারদিন পরে অর্থাৎ ২৯শে জানুয়ারি বাংলাদেশ দূতাবাসের পক্ষ থেকে সাত বাংলাদেশীর নাম পরিচয় দিয়ে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়।

সেখানে জানানো হয়, রোম দূতাবাসের শ্রম বিষয়ক কাউন্সিলর এরফানুল হক এর নেতৃত্বে দুই সদস্যদের প্রতিনিধি দল নৌকা থেকে উদ্ধার হওয়া অন্যদের সাথে কথা বলেন। ইটালির ল্যাম্পাডুসা দ্বীপে অবস্থিত ক্যাম্পে ইটালি পুলিশের উপস্থিতিতে তাদের সাথে কথা বলেন বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা।

বিবৃতিতে বলা হয়, মৃতদের সাথে সনাক্তকারী কোন ডকুমেন্ট না থাকায় সনাক্তকরণে জটিলতা দেখা দেয়। ঘটনার ১০ দিন পরে ইতালিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শামীম আহসান সিসিলিতে যান। সেখানে গিয়ে মৃতদের কফিনের সামনে দাঁড়ানো রাষ্ট্রদূতের ছবি প্রকাশ করা হয় দূতাবাসের ফেসবুক পেইজে।

‘কথিত বাংলাদেশী’ শব্দটি কেন ব্যবহার করা হলো, সেটি নিয়ে দূতাবাসের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।

রাষ্ট্রদূত শামীম আহসানের সাথে চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে বাংলাদেশ দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেছেন, প্রথম দিকে যখন পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি তখন ইংরেজি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ‘রিপোর্টেড বাংলাদেশী’ বলা হয়েছিল, যেটি বাংলায় লেখা হয়েছিল ‘কথিত বাংলাদেশী’।

মাদারীপুর জেলার পিয়ারপুর গ্রামের জয় তালুকদারের বয়স ছিল মাত্র ১৬ বছর। এলাকায় তিনি রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। গ্রামের আরো অনেক মানুষকে তিনি ইতালি যেতে এবং যাবার পর রাতারাতি তাদের পরিবারে আর্থিক সচ্ছলতা আসতে দেখেছেন।

একারণে জয় তালুকদারের মনে ইতালি যাবার প্রবল ইচ্ছা তৈরি হয়েছিল। তার বাবা পলাশ তালুকদার বিবিসিকে বলেন, জায়গা-জমি বিক্রি করে এবং বিভিন্ন জনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে তিনি আট লাখ টাকা জোগাড় করেন ছেলেকে ইতালি পাঠানোর জন্য।

গত ২৮শে নভেম্বর ঢাকা থেকে দুবাই যান জয় তালুকদার। এরপর দুবাই থেকে লিবিয়া। লিবিয়ায় গিয়ে একমাস বাইশ দিন অপেক্ষা করেন ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালিতে ঢোকার জন্য।

জানুয়ারি মাসের ২৪ তারিখে আরো ২৮০ জন অভিবাসন প্রত্যাশীর সাথে ইতালি যাবার জন্য নৌকায় ওঠেন জয় তালুকদার। কিন্তু তার আর ইটালিতে পৌঁছানো হয়নি। নৌকায় করে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে ইতালিতে যাবার ঝুঁকি কতটা তা জানতেন তারা, কিন্তু সেটি তাদের থামাতে পারেনি।

পলাশ তালুকদার বলেন, তার ছেলের সাথে তাদের আত্মীয়-স্বজন আরো পাঁচজন ছিলেন। একমাত্র তার ছেলেই মারা গেছে, বাকিরা ইতালি পৌঁছেছে বলে তিনি জানান।

‘এইভাবে অনেক মানুষ যাইতেছে। মনে করছি যাইব গা। এহন একটা একসিডেন্ট হইয়া গেছে। সব কপালের দোষ,’ বলেন পলাশ তালুকদার। এলাকার যে দালাল অবৈধ পথে ইতালিতে পাঠানোর আয়োজন করেছিলেন - তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই পলাশ তালুকদারের।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement