জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্ব নেতাদের প্রতি তরুণদের অনাস্থা, ‘ব্লা ব্লা ব্লা’ আর 'গ্রিনওয়াশ' স্লোগান
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ১০ নভেম্বর ২০২১, ২২:০৬
গ্রেটা থুনবার্গ সেপ্টেম্বরে ইতালির মিলানে এক সমাবেশে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ও ভারতের নরেন্দ্র মোদির বক্তব্যকে ফাঁকা বুলির সাথে তুলনা করতে বলেছিলেন 'ব্লা, ব্লা, ব্লা'।
আর এরপর থেকে ক্ষুদ্র এই শব্দটি জলবায়ু আন্দোলনের একটি জনপ্রিয় স্লোগান হয়ে উঠেছে।
শুক্রবার গ্লাসগোতেও তরুনদের বিক্ষোভ-সমাবেশে শব্দটি পুনরাবৃত্তি করেন জলবায়ু আন্দোলনের সুইডিশ তারকা থুনবার্গ। তিনি যখন বলেন যে কপ-২৬ ‘ব্লা-ব্লা-ব্লা রাজনীতিকদের দু’সপ্তাহের একটি উৎসব, এর সাথে জলবায়ু পরিবর্তনের কোনো সম্পর্ক নেই’, হাততালি আর শ্লোগানে ফেটে পড়ে সমাবেশ।
নতুন প্রজন্মের এ পরিবেশ সচেতন ছেলে-মেয়েরা পত্র-পত্রিকার খবরে দেখেছে পরিবেশ বাঁচানোর সম্মেলনে যোগ দিতে নেতা-কর্মকর্তা-ব্যবসায়ীরা ব্যাক্তিগত ও ভাড়া করা জেট বিমানে একের পর এক গ্লাসগো আর এডিনবারা বিমানবন্দরে এসে নামছেন। তারা এটাকে প্রবঞ্চনা বলে বিবেচনা করছেন।
শুক্র ও শনিবার গ্লাসগো আর বিশ্বের নানা শহরে পরিবেশবাদীদের বিক্ষোভ শোভাযাত্রায় বহু প্লাকার্ডে এ শব্দটি লেখা ছিল। জলবায়ু সম্মেলন নিয়ে আরো একটি শব্দ ও শ্লোগান উচ্চারিত হচ্ছে - 'গ্রিনওয়াশ', যার অর্থ করলে দাঁড়ায় মূল সত্য চাপা দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে।
গ্লাসগোর কপ-২৬ ভেন্যুর বাইরে দিনভর যে সব আন্দোলনকারী দাঁড়িয়ে থাকেন, শ্লোগান দেন, গান-বাজনা করেন, তাদের প্লাকার্ডে দেখা যাচ্ছে এবং মুখেও শোনা যাচ্ছে এ দু’শব্দ - ব্লা ব্লা ব্লা আর গ্রিনওয়াশ। শহরের বিভিন্ন জায়গা সাটা রয়েছে ব্লা-ব্লা ব্লা লেখা পোস্টার।
এর অর্থ হলো যে সম্মেলনের ভেতরের আলোচনায় বিভিন্ন দেশের নেতারা বিশ্বের তাপমাত্রা কমানোর জন্য যেসব বড় বড় প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, বক্তব্য দিচ্ছেন, তার প্রতি বহু মানুষ আস্থা রাখতে পারছেন না।
জলবায়ু আন্দোলনে তরুণরা কেন রাস্তায়?
গ্লাসগোতে পর পর দু'দিনের বিক্ষোভে অংশ নেয়া বহু মানুষকে জিজ্ঞেস করেছি, বিশ্বের নেতারা যেখানে ভরসা দিচ্ছেন যে তারা এখন থেকে সাধ্যমত করবেন, তারপরও কেন তারা রাস্তায় নেমেছেন?
জলবায়ু বিজ্ঞানী ড. সালিমুল হক মনে করেন, রাজনীতিকদের এ দুর্নাম সহ্য করতে হবে কারণ তারা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেই চলেছেন। ‘তাদের একটা অভ্যাস রয়েছে কথা দিয়ে কথা না রাখা। তারা যে ব্লা ব্লা ব্লা করেন, এটা একবারে সঠিক।’
জলবায়ু সম্মেলনের ঠিক আগে জাতিসঙ্ঘের দু’সংস্থা থেকে কার্বণ নিঃসরণ নিয়ে বড় দু’গবেষণা রিপোর্ট ছাপা হয়েছে, যাতে পরিষ্কার বলা হয়েছে যে এ শতাব্দীতে বিশ্বের তাপামাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখার যে বোঝাপড়া ছয় বছর আগে প্যারিসে হয়েছিল, সিংহভাগ দেশ তা অনুসরণ করে কাজ করছে না।
২০৩০ সাল পর্যন্ত কার্বন নিঃসরণ কমানোর যে লক্ষ্যমাত্রা লিখিতভাবে এ বছর দেশগুলো দিয়েছে, তাতে নিঃসরণ তো কমবেই না বরঞ্চ ২০৩০ সাল পর্যন্ত তা বাড়তেই থাকবে।
সবচেয়ে বড় কথা, যে প্রতিশ্রুতি দেশগুলো, বিশেষ করে প্রধান প্রধান নিঃসরণকারী দেশগুলো দিচ্ছে সেটাই তারা রাখবে কি-না, তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের মহলেই সন্দেহ ঢুকেছে। খোদ জাতিসঙ্ঘ একের পর এক রিপোর্ট বের করে পরোক্ষাভাবে সদস্য দেশগুলোকে বলছে তোমরা কথা রাখছ না।
ধনী দেশের প্রতিশ্রুতির বরখেলাপ
অনুন্নত দেশগুলো থেকে সম্মেলনে যোগ দিতে আসা লোকজন - তা ওই সরকারি প্রতিনিধি হোক আর পর্যবেক্ষক হোক - খোলা গলায় নানা ফোরামে, সংবাদ সম্মেলনে বলছেন শিল্পোন্নত দেশগুলো তাদের প্রতিশ্রুতি রাখছে না।
তাদের কথা, দীর্ঘ দিন ধরে যথেচ্ছভাবে কয়লা-তেল-গ্যাস পুড়িয়ে গুটিকতক ধনী দেশ বাকি বিশ্বকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে। এখন সাহায্যের সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি দিয়েও টালবাহানা করছে।
এসব ধনী দেশ কার্বন নিঃসরণ আদৌ প্রতিশ্রুতিমত কমাবে কি-না, তা নিয়েও দরিদ্র-উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে তীব্র অবিশ্বাস দেখা দিয়েছে।
জিরো এমিশনের (শূন্য কার্বন নিঃসরণ) বদলে নেট-জিরো এমিশনকে প্রাধান্য দেয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দিহান বাংলাদেশ থেকে আসা আমিনুল ইসলাম, যার সংস্থা কোস্ট জলবায়ু শরণার্থীদের কল্যাণে কাজ করে।।
আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘এসব দেশ ৩০-৪০-৫০ বছরের লক্ষ্যমাত্রা দিয়ে বলছে তারা এমন সব প্রযুক্তি আবিস্কার করবে, এত গাছপালা লাগাবে যে তাদের নিঃসরিত কার্বন পরিবেশে ঢুকবে না। এসব কথা বিভ্রান্তিকর। এসব প্রযুক্তি এখনো নেই। অর্থাৎ তারা এখনো বহুদিন নিঃসরণ চালিয়ে যাবে ... এটা শুভঙ্করের ফাঁকি।’
বেসরকারি পূঁজি
জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকানোর অর্থায়নে যেভাবে বেসরকারি পূঁজিকে নিয়ে আসার চেষ্টা ধনী দেশগুলো করছে, তার উদ্দেশ্য নিয়েও অনেকে সন্দিহান।
বাংলাদেশের জলবায়ু বিষয়ক গবেষণা সংস্থা সিপিআরডি-র শামসুদ্দোহা ভয় পচ্ছেন জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে এখন পশ্চিমা দেশগুলো ব্যবসা করার পরিকল্পনা করেছে।
তিনি বলেন, ‘তাদের অনেক উদ্বৃত্ত পূঁজি রয়েছে। কার্বনকে পণ্য করে এখন তারা গরীব দেশগুলোতে পূঁজি খাটাতে চাইছে। এক ধরণের কার্বন ক্যাপিটালিজম শুরু হচ্ছে বলে সন্দেহ হচ্ছে।’
সরকার ও নেতাদের ওপর এ সন্দেহ-অবিশ্বাস সহজে ঘুচবে বলে মনে হয় না।
সুতরাং শুক্রবার গ্লাসগো সম্মেলনের ঘোষণায় যত প্রতিশ্রুতি থাকুক না কেন, তার ভেতর যত সারবত্তাই থাকুক না কেন, গ্রেটা থুনবার্গ হয়তো সাথে সাথেই টুইট করবেন - 'আবারো একটি ব্লা ব্লা ব্লা সেশন হলো।'
সূত্র : বিবিসি