ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ নিয়ে বিপাকে ধনী দেশগুলো
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৭:২১
করোনাভাইরাস সংক্রমণ মোকাবেলায় বিশ্বের ধনী দেশগুলো দ্রুতই টিকা সরবরাহ ও নিজ নাগরিকদের টিকা দিতে সক্ষম হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের পূর্বাভাসের চেয়ে দেশের অর্থনীতির মারাত্মক পতনের মধ্যেই দেশগুলো নিজেদের নাগরিকদের বেশিরভাগকেই টিকার আওতায় নিয়ে এসেছে।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে সারাবিশ্ব যখন একত্রে মোকাবেলা করছে, বিশ্বজুড়ে করোনা প্রতিরোধে টিকার বিষয়টি তখন আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে।
বিভিন্ন দাতা দেশের সহায়তা সত্ত্বেও ঝুঁকিতে থাকা সাধারণ লোকের কাছে টিকা কখন পৌঁছাবে তা এখনো অনিশ্চিত।
যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড কলেজ পার্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক শবনম কালেমলি-ওজজান বলেন, ‘কোনো অর্থনীতিই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারবে না যদি সমানভাবে দ্রুত বিশ্বের সব অঞ্চলে সাশ্রয়ী মূল্যে টিকার সরবরাহ না হয়।’
বিশ্বজুড়ে টিকা সরবরাহে অর্থনীতির পরিস্থিতি বিষয়ে ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্সের (আইসিসি) রিসার্চ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে সাম্প্রতিক এক গবেষণার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কোনো এক দেশের অর্থনীতিই নিরাপদ থাকতে পারে না যদি প্রতিটি দেশের অর্থনীতি নিরাপদ না থাকে।’
অধ্যাপক কালেমলি-ওজজান বলেন, ‘উন্নয়নশীল দেশগুলোকে এখনো এর চড়া মূল্য দিতে হলেও শুধু ধনী দেশগুলোই টিকার সুবিধা পাচ্ছে।’
তিনি জোর দিয়ে বলেন, সামগ্রিক অর্থনীতির পতন উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোর জন্য বোঝা হিসেবে কাজ করবে যদি উদীয়মান বাজারের দেশগুলোতে পর্যাপ্তভাবে টিকা সরবরাহ করা না হয়।
তিনি বলেন, ‘চার ট্রিলিয়ন ডলারেরর বৈশ্বিক ব্যয়ের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ এবং উন্নত অর্থনীতির দেশগুলো যদি ২০২১ সালের গ্রীষ্মের মধ্যেও তাদের সব নাগরিককে টিকা দিতে সক্ষম হয়, তা হলেও এই ব্যয়ের অর্ধেকেই তাদেরকে বহন করতে হবে।’
কালেমলি-ওজজান বলেন, এর চেয়ে ভয়াবহ চিত্রে টিকার ঘাটতিতে উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলোতে লকডাউনের ফলে পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহ প্রচণ্ড ধাক্কা খাবে যা বৈশ্বিক অর্থনীতির নয় দশমিক দুই ট্রিলিয়ন ডলার হারানোর ঝুঁকি তৈরি করবে।’
গবেষণায় দেখানো হয়, অর্থনীতির এই অবস্থায় ধনী দেশগুলো তাদের সব নাগরিককে টিকা দিতে সক্ষম হলেও বিশ্বের অন্য দেশগুলোর সাথে এই বিষয়ে সহযোগিতায় ব্যর্থ হলেও তাদের অর্থনীতিও ঝুঁকির মুখোমুখি হবে।
এই ঝুঁকি মোকাবেলায় বিশ্বের সব অঞ্চলের মানুষের কাছে টিকা সহজলভ্য করার মাধ্যমে এই ঝুঁকি কমতে পারে।
বিশ্বব্যাপী টিকা সরবরাহে এখন যে খরচ হবে, তা পরে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতির অচলাবস্থায় টিকা দেয়ার চেয়ে কমই হবে জানান কালেমলি-ওজজান।
বৈশ্বিক সহযোগিতার অনুপস্থিতিতে বাণিজ্যিক শক্তি ও উৎপাদানের জন্য বিভিন্ন দেশের আন্তঃসম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে ধনী দেশগুলোর অর্থনৈতিক ব্যয় দুই শ’ তিন বিলিয়ন ডলার থেকে তিন ট্রিলিয়ন ডলারে পরিবর্তিত হতে পারে বলে গবেষণায় দেখানো হয়।
অধ্যাপক কালেমলি-ওজজান বলেন, এর আগে প্রকাশিত জরিপের চেয়ে এই সংখ্যা আরো বেশি।
সারাবিশ্বের সব দেশ টিকা পাওয়ার ভিত্তিতে বেলজিয়াম, ফ্রান্স, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড, ব্রিটেন ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলো তাদের মোট জিডিপির তিন দশমিক নয় ভাগ পর্যন্ত হারাতে পারে।
বিভিন্ন দেশের সরকারের টিকা সরবরাহের বর্তমান ব্যবস্থাপনার সমালোচনা করে তিনি সতর্ক করে বলেন, উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোতে টিকার সরবরাহ বন্ধের বিষয়টিও ত্রুটিপূর্ণ।
অধ্যাপক শবনম কালেমলি-ওজজান বলেন, ‘আমরা এই বিষয়ের পরামর্শ দিচ্ছি না, বরং বলছি সরবরাহ বাড়ানোর, টিকা তৈরিতে এখনোই বিনিয়োগের।’
তিনি বলেন, ‘টিকার সরবরাহ এখন সীমাবদ্ধ। এটিই বৃহত্তম সমস্যা।’
টিকার এই লক্ষ্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) দ্যা এক্সেস টু কোভিড-১৯ টুলস(এসিটি) অ্যাকসেলেরেটর পরিকল্পনার অংশ। টিকা না দেয়ার কারণে পরিস্থিতির অবনতির আগেই টিকার উন্নয়ন, ক্রয় ও সরবরাহে বিনিয়োগই এই পরিকল্পনার উদ্দেশ্য।
হু-এর তথ্যানুসারে, এই কার্যক্রমের সহায়তায় ও সাফল্যের জন্য কাজ করতে বাড়তি অর্থায়ন ত্রুটিপূর্ণ।
এসিটি-অ্যাকসেলেরেটরের জন্য বর্তমানে ছয় বিলিয়ন ডলারের অর্থ সংগ্রহের অঙ্গীকার করা হয়েছে। সাথে সাথে অতিরিক্ত আরো চার বিলিয়ন ডলার সংগ্রহের প্রত্যাশা করা হচ্ছে। তা সত্ত্বেও ২৭ দশমিক দুই বিলিয়ন ডলারের অর্থ ঘাটতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে বাড়তি অর্থায়ন সম্ভব হলে এই ঘাটতি কমে ২৩ দশমিক দুই বিলিয়ন ডলারে নামতে পারে।
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সাথে সব অংশীদারের একত্রে কাজের বিষয়ে জোর দিয়ে শবনম কালেমলি-ওজজান বলেন, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্ব ব্যাংকসহ বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে টিকা সারাবিশ্বে নায্যভাবে বণ্টনে হু-কে সহায়তা করা।
তিনি বলেন, যদিও বিশ্বায়নের ফলে মহামারীর প্রকোপ বেড়েছে, তা সত্ত্বেও তা মহামারী প্রতিরোধের উত্তম সহায়ক।
কালেমলি-ওজজান বলেন, যদি বহুজাতিক বৈশ্বিক সংস্থাগুলো এগিয়ে আসলেই এই বিষয় মোকাবেলা করা যেতে পারে।
টিকার নায্য বণ্টনের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি আশাবাদী কিন্তু মহামারীর এই পরিস্থিতি আমাদের যে শিক্ষা দিয়েছে, তার সারসংক্ষেপ হলো, উত্তমের জন্য আশা করা কিন্তু শোচনীয় অবস্থার জন্য প্রস্তত থাকা।’
তিনি বলেন, ‘আমি আশা করি, সব দেশ এগিয়ে এসে বিশ্বজুড়ে টিকা সরবরাহের প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নেবে।’
সূত্র : ইয়েনি শাফাক