২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

মানসিক বিকাশ হচ্ছে না গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্তানের

আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবসে বাবাকে ফিরে পেতে এক শিশুর কান্না। ছবিটি গত ৩০ আগস্ট জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে থেকে তোলা - সংগৃহীত

বিভিন্ন সময়ে গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্তানের মানসিক বিকাশ হচ্ছে না। অনেকে দীর্ঘ সময় বাবাকে কাছে না পেয়ে রীতিমতো অস্বাভাবিক আচরণও করছে। যশোরের এক শিশুপুত্র বাবার আদর না পেয়ে অভিমানে আত্মহত্যা করেছে। বাবা গুম হওয়ার পর ঢাকার তেজগাঁওয়ের এক শিশুকন্যার অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ করে এক বছর ধরে তার মা মোহাম্মদপুরের একটি মানসিক বিকাশ কেন্দ্রে মেয়ের কাউন্সেলিং করাচ্ছেন। নয়া দিগন্তের অনুসন্ধানে গুম হওয়া ব্যক্তির অবর্তমানে তাদের এমন অনেক শিশুসন্তানের খোঁজ মিলেছে যারা মানসিকভাবে অসুস্থ। এসব শিশুসন্তানদের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাও করাচ্ছেন তাদের স্বজনেরা।

২০১১ সালের ৩১ অক্টোবর ঢাকার তোপখানা রোডের নিউ ইয়র্ক হোটেলের নিচ থেকে নিখোঁজ বা গুম হয় নড়াইলের ব্যবসায়ী আমিনুল ইসলাম লিটন। লোহাগড়ার লুটিয়া গ্রামের মৃত শেখ তারামিয়ার ছয় ছেলের মধ্যে লিটন ছিল দ্বিতীয়। নয়া দিগন্তের পক্ষ থেকে গুম হওয়া লিটনের পরিবারের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে কথা হয়েছে। লিটনের ভাই শেখ ফিরোজ আলম জানিয়েছেন, লিটনের ফিরে আসার দীর্ঘ অপেক্ষার পরেও বাবার আদর আর ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়ে অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করেছিল ছোট্ট ছেলে আকাশ। চাওয়ার আগেই বাবার কাছে সবই পেত সে। কিন্তু দীর্ঘ দিন বাবার আদর না পেয়ে ২০১৪ সালের ২৬ অক্টোবর মায়ের সাথে অভিমান করে গলায় দড়ি দেয় বাবার স্নেহবঞ্চিত আকাশ। ঘরের সিলিং ফ্যানের সাথে দড়ি বেঁধে আত্মহত্যা করে সে।

২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর গুম হন রাজধানীর তেজগাঁও এলাকার শাহিনবাগের সাজেদুল ইসলাম সুমন। দীর্ঘ দিন ধরে বাবার আদর না পেয়ে সুমনের দুই মেয়ের জীবনও যেন অনেকটা ছন্নছাড়া। বাবা গুম হওয়ার পর বড় মেয়ে হাফসা ইসলাম রায়তার পড়াশোনা এক বছর সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল। শাহীন স্কুলের মেধাবী ছাত্রী রায়তার পরীক্ষার ফলাফলে আসে চরম বিপর্যয়। পরিবার তার মানসিক অবস্থাটি বুঝতে পেরে ইংলিশ মিডিয়াম পরিবর্তন করে বাংলা মাধ্যমে আবার ভর্তি করিয়েছে তাকে। রায়তার ছোট বোন আরোয়া ইসলামের মানসিক অবস্থা আরো করুণ। স্থানীয় উত্তরণ প্রিপারেটরি স্কুলে পড়াশোনা করছে সে। কিন্তু বাবার আদর না পেয়ে মানসিক বিকাশ হচ্ছে না তার। আরোয়ার মা মোহাম্মদপুরের কিডস্ ক্লাবে নিয়মিত কাউন্সেলিং করাচ্ছেন তাকে।

২০১৩ সালে ২ ডিসেম্বর রাজধানীর তেজগাঁও থেকে গুম হন কায়সার নামে একজন প্রাইভেটকার চালক। ঘরে তখন তার তিন বছর বয়সের মেয়ে মীম। মীম এখন ক্লাস টুতে পড়ছে। কিন্তু প্রতিক্ষণেই মীম যেন তার বাবার অভাব অনুভব করছে। মানসিকভাবেও বিষন্ন থাকে সব সময়। মীমের মা মিনু বেগম জানান, মেয়ে আমার ঠিকমতো খাওয়া দাওয়াও করে না। ডাক্তারের কাছে বেশ কয়েকবার নিয়ে গেছি। ডাক্তার বলেছেন কোনো রোগ নেই। তারপরও মেয়ে আমার সুস্থভাবে বেড়ে উঠছে না।

ছয় বছর আগে শাহবাগ থেকে গুম হন বংশালের চঞ্চল। চঞ্চলের একমাত্র ছেলে আহাদ। আহাদের বয়স এখন ৯ বছর। বাবা গুম হওয়ার পর আহাদ বড় ধরনের একটি মানসিক আঘাত পায়। তার মধ্যে বেশ কিছু পরিবর্তন লক্ষ করছে তার পরিবার। আহাদের মা জানান, ছেলের বয়স ৯ বছর হলেও শারীরিক কিংবা মানসিক কোনোভাবেই সে বেড়ে উঠছে না। তার ওজন এখনো মাত্র ১৫ থেকে ১৬ কেজি। যদিও স্বাভাবিকভাবে এই বয়সে ওজন থাকার কথা ২৮ থেকে ৩০ কেজি।

আহাদের মা আরো জানান, ওর বড় সমস্যা হলো পড়াশোনা কিছুই মনে রাখতে পারে না। সকালের কথা দুপুরেই ভুলে যায়। স্মৃতিশক্তি খুবই দুর্বল। মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে গিয়ে কয়েকবার দেখিয়েছি। সবাই বলেছে বাবার কথা বেশি চিন্তা করছে সে। এই বয়সে বাবাকে কাছে না পাওয়া ওর জন্য বড় আঘাত।

২০১৩ সালে নিখোঁজ হওয়া বংশালের ছাত্রদল নেতা পারভেজ হোসেনের সাত বছরের মেয়ে হৃদির মানসিক বিকাশ হচ্ছে না। হৃদির মা জানান, আমার মেয়ে সাত বছর ধরেই রাতে ঘুমাতে পারে না। মেয়ের একটাই দাবি, পাপার বুকে আমি ঘুমাতে চাই। পাপা তো আসে না। প্রতিদিন আমি পাপার জন্য অপেক্ষায় থাকি। কোথায় গিয়েছে পাপা?

পরিবারের প্রধান তথা বাবার অবর্তমানে এসব শিশুর মানসিক বিকাশের প্রতিবন্ধকতা কিভাবে দূর করা যায় সেই বিষয়ে নয়া দিগন্তের এই প্রতিবেদকের সাথে কথা বলেছেন রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক ও অধ্যাপক ডা: এম এ মোহিত (মোহিত কামাল)। তিনি বলেন, গুমের বিষয়ে আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই। কাজেই এ বিষয়ে আমার কোনো বক্তব্যও নেই। তবে পরিবারের বাবা অথবা মায়ের আদরবঞ্চিত হলে যেকোনো শিশুর মনেই একটা বিরূপ বা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। ওই শিশু অন্যের দ্বারা সহজে প্রভাবিত হবে। বিশেষ করে বাবার আদর না পেলে শিশুরা জীবনে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে পারে না। তাদের মধ্যে সহনশীলতাও কমে যায়।

তবে পরিবারের অন্য সদস্যরা যদি এই শিশুদের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে তাদেরকে আত্মবিশ্বাসী হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন তাহলে তাদের মধ্যে কোনো হতাশা থাকবে না বলেও জানান এই মনোবিজ্ঞানী।


আরো সংবাদ



premium cement