২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
জীবনের পড়ন্ত বেলা-৩

বাবা-মার লাশ নিতেও সন্তান আসে না

বাবা-মার লাশ নিতেও সন্তান আসে না - ছবি : সংগ্রহ

রাজধানীর একটি অভিজাত এলাকার বাসিন্দা জামান (ছব্দনাম)। জীবনের পড়ন্ত সময়ে আশ্রয় নেন আগারগাঁওয়ের প্রবীণ নিবাস ‘বৃদ্ধাশ্রমে’। এখানে জীবনের শেষ ২০ বছর কেটেছে। আপনজনদের নিয়ে অসংখ্য স্মৃতি-কষ্টের ঝড় এতটা বছর একা একা বয়ে বেড়িয়েছেন। কিন্তু সন্তানরা এক দিনও দেখতে আসেনি। ফলে যে বয়সে নিজেকেই নিজের কাছে বোঝা মনে হয় সে বয়সে স্বজনহীন কষ্টের বোঝা বহন তার জন্য অসহ্য হয়ে গিয়েছিল। ফলে মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত কান্না-আহজারি ছিল তার একমাত্র সঙ্গী।

এ রকম অবস্থায় সম্প্রতি এই প্রবীণ বৃদ্ধাশ্রমেই মারা যান। নিয়মানুযায়ী তার স্বজনদের জানাতে প্রথমেই তার এক ছেলেকে ফোন দেয়া হলো। ফোন ধরে ছেলে জানাল তিনি তাবলিগ জামায়াতে আছেন। লাশ নিতে আসতে পারবেন না। তার পরও বৃদ্ধাশ্রম কর্তৃপক্ষ তাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেও বাবার লাশ নিতে রাজি করাতে পারলেন না। এবার মরহুমের আরেক ছেলেকে ফোন দেয়া হলো। ফোন ধরে একজন জানালেন তিনি দেশের বইরে। এ মুহূর্তে কিছু করার নেই। সর্বশেষে আরেক স্বজনকে ফোন দিয়ে লাশ নিতে বলা হলো। তাতে তিনি উল্টো রেগে গিয়ে বললেন এ বিষয়ে তাকে বিরক্ত না করতে। অবশেষে প্রবীণ নিবাস কর্তৃপক্ষ নিজেদের ব্যবস্থাপনায় তাকে দাফনের ব্যবস্থা করেন। পরদিন দেখো গেল দেশের একটি শীর্ষ দৈনিক পত্রিকায় বাবার জন্য শোক বার্তা দিয়ে সন্তানদের বিজ্ঞাপন। 

এ করুণ বর্ণনাটি প্রবীণ নিবাসের ইনস্টিটিউট অব জেরিয়েট্রিক মেডিসিনের (আইজিএম) ইনচার্জ ও বার্ধক্য বিশেষজ্ঞ ও ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক ডা: মহসীন কবির লিমনের। তিনি প্রবীণ বন্ধু ও হেলদি হোম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতাও। লিমন জানান, সন্তান হয়েও বাবা-মার লাশ না নিতে আসার এ রকম অসংখ্য ঘটনা আছে। যাতে আমরা অবাক ও শোকাহত হই। নিজেরাও নিজেদের সান্ত্বনা দিতে পারি না। কারণ এমন সন্তান কখন যে কার জীবনে অভিশাপ হয়ে আসে বয়স বাড়ার সাথে সে আশঙ্কাও বাড়ছে। 

ডা: মহসীন কবির লিমন জানান, ‘প্রবীণ বন্ধু’ নামে তাদের একটি সংগঠন আছে। যার মাধ্যমে তারা প্রবীণদের নিয়ে কাজ করেন। কাজের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, সন্তান হয়েও প্রবীণ নিবাসে থাকা বাবা কিংবা মায়ের খোঁজ বছরের পর বছর না নেয়া কিংবা মৃত্যুর পর লাশ নিতে না আসার এমন ঘটনা দেশের প্রায় প্রতিটি বৃদ্ধাশ্রমেই আছে। 

এর মধ্যে রাজধানীর উত্তরখানে আপন নিবাসেও এ রকম ঘটনা ঘটেছে। বৃদ্ধাশ্রমে কিছুদিন থাকার পর এক মা মারা গিয়েছিলেন। কিন্তু তার সন্তানরা লাশ নিতে চাননি। পরে নিজেদের উদ্যোগেই লাশ দাফনের ব্যবস্থা করে সেখানকার কর্তৃপক্ষ। তার মতে বৃদ্ধাশ্রমে থাকা অনেকের নাম-ঠিকানা বা সঠিক পরিচয় অনেক সময় জানা থাকে না। কিন্তু যাদের পরিচয় জানা আছে, তারা মারা গেলেও তার লাশ নিতে চায় না সন্তানরা। অনেকে বলেন, লাশ দাফন করার মতো জায়গা তাদের নেই।

বৃদ্ধাশ্রমের তত্ত্বাবধায়ক এসব ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ‘নানা কারণে আমাদেরই লাশ দাফনের ব্যবস্থা করতে হয়। এমনকি লাশ কাঁধে নেয়ার মতো লোকজনও পাওয়া যায় না। এসব কারণে কোনো সন্তান বৃদ্ধাশ্রমে মাকে দেখতে এলে তাদের নাম-ঠিকানা ও মুঠোফোন নম্বর লিখে রাখি। যাতে করে কোনো প্রবীণ মারা গেলে তার লাশ দাফন করার জন্য তার সন্তানদের সহযোগিতা পাওয়া যায়। কিন্তু তারপর অনেক সময় সন্তান হয়েও কেউ কেউ নিজের বাবা-মার লাশও গ্রহণ করতে আসেন না।


আরো সংবাদ



premium cement