২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
বৃদ্ধাশ্রমে প্রবীণেরা যেন জীবন্ত লাশ

ইফতারের কথা বলতেই চোখ দিয়ে পানি পড়তে শুরু করল

বৃদ্ধাশ্রমে প্রবীণেরা যেন জীবন্ত লাশ - ছবি : সংগ্রহ

সংসার সন্তান-সন্তুতি, টাকা, বাড়ি-গাড়ি তাদের সবই ছিল। কিন্তু আজ তাদের কিছুই নেই। সব চেয়ে নিঃসঙ্গ। পরিবার-পরিজন বাড়ি-গাড়ি সবই এখন স্মৃতি। নিজের চিরচেনা পরিবার সবার কাছে এখন একেবারে অচেনা। কারণ নানা অজুহাতে সন্তানরা বাড়ি থেকে তাদের সরিয়ে দিয়েছে। অনেকটা নচিকেতার আলোড়ন তোলা সেই গানের মতো। যাতে তিনি বলেছিলেন ‘ছেলে আমার মস্ত মানুষ মস্ত অফিসার। মস্ত ফ্লাটে যায় না দেখা এপার-ওপার। নানা রকম জিনিস আর আসবাব দামি দামি। সবচেয়ে কমদামি ছিলাম একমাত্র আমি। ছেলের আমার প্রতি অগাধ সম্ভ্রম। আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম’। ফলে জীবনের শেষ বয়সে এসে বৃদ্ধাশ্রমই তাদের শেষ আশ্রয়। 

এখানে একেজন প্রবীণ যেন স্বজনবিহীন জীবন্ত লাশ। এদের প্রত্যেকের মধ্যেই অভিমান। তারপরও জানি কারো অপেক্ষায় দিনভর বারান্দার গ্রিল ধরে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন অনেকে। দীর্ঘশ^াসে কারো কারো দুচোখ বেয়ে নেমে পড়ে নোনা জল। প্রতিটি দীর্ঘশ^াস যেন অতীত জীবনের একেকটি করুণ গল্প। কিন্তু তারপরও সন্তান-স্বজনের বিরুদ্ধে কারো অভিযোগ নেই। পেছনে ফেলে আসা দিনগুলোর আনন্দের স্মৃতির চেয়ে, ব্যর্থতার দায় যেন সারাক্ষণই তাদের বিষন্ন করে তোলে। এটি আগারগাঁওয়ের প্রবীণ নিবাস ‘বৃদ্ধাশ্রমে’ থাকা প্রবীণদের জীবনচিত্র।

রোববার সেখানে গিয়ে দেখা গেল এক ভিন্ন চিত্র। রমজানে নেই কোনো কোলাহল, কারো মাঝে নেই ইফতার নিয়ে বাড়তি কোনো আয়োজন। এরই মধ্যে এখানে বসবাসরতদের অনেকে ফেলে আসা দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করেছেন। যাদের মধ্যে এমনও আছেন, যারা নামীদামি বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিক্ষক ও চাকরিজীবী ছিলেন। বর্ণাঢ্য ছিল যাদের জীবন। বৃদ্ধ বয়সে এসে নিজ সন্তানদের অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হয়েছেন এসব বাবা-মা। 

এরা সন্তানদের ওপর মান অভিমানের কথা বলতে গিয়ে অজোরে কেঁদেছেন। কেউ বা আবার কোনো কথা না বলে নীরব থেকে চোখের পানি ফেলেছেন। আবার কেউ থেমে থেমে একেকটি দীর্ঘশ^াসে জীবনের ফেলে আসা একেকটি করুণ চিত্র তুলে ধরেছেন। এত কিছুর পরও কথার ইতি টানার আগে প্রত্যেকেই নিজ নিজ সন্তানের মঙ্গল চেয়েছেন। বলেছেন ‘আমাদের যা হওয়ার হয়েছে, সন্তান ভালো থাকুক’। আশ্রম কর্তৃপক্ষের অনুরোধে প্রত্যেকের ছব্দনাম ব্যবহার করা হয়েছে। 

তাদেরই একজন জহুর আলী (৭০)। ২০ বছর ধরে এ আশ্রমে আছেন। জানালেন রাজধানীর লালমাটিয়ায় একটি কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন। সাংবাদিকতাও করতেন। অধুনালুপ্ত অবজারভারসহ একাধিক পত্রিকায় ইংরেজিতে কলাম লিখতেন। কথা বলে বুঝলাম অনেক সিনিয়র সাংবাদিককেও চেনেন। বাড়ি যশোর হলেও রাজধানীতে তার নিজের বাড়ি আছে। যদিও এখন তা ছেলের দখলে। এক ছেলে এক মেয়ে। দুইজনই উচ্চপদে চাকরি করছেন। রোজার দিনের উৎসবমুখর পরিবেশ স্ত্রী-স্বামী-সন্তান নিয়ে ইফতার সাহারির স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন ‘রমজানে যখন ইফতারের সময় হতো স্ত্রী, নানী নাতনী ছেলে ও বউমাকে নিয়ে একসাথে বসতাম। আবার সাহরিতে উঠতে নাতি-নাতনীদের অবদার’, থেমে গেলেন। চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিল। কিছুক্ষণ পর আবার কথা শুরু করলেন। বললেন, ‘ঢাকা শহরে আমার বাড়ি আছে। ছেলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বড় পদে চাকরি করে। মেয়েও স্বামী সন্তান নিয়ে ভালো আছে। আমার স্ত্রী মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত মোটামুটি ভালোই চলছিল। কিন্তু সে চলে গিয়ে আমাকে ভাসি দিয়ে গেল’। থেমে গেলেন। চোখ ছলছল করছিল। আবারো শুরু করলেন। ‘কি আর বলব। এরপর থেকেই ছেলে ও ছেলের বউয়ের বুঝা হয়ে গেলাম। ছেলের বউয়ের নানান আচরণ সহ্য করেও বাসায় থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আর হলো না। ছেলে একদিন বলল তোমাকে এখানে দেখার কেউ নেই। তোমার বউমারও তোমার কারণে অসুবিধা হয়। বরং তুমি কোথাও আলাদা চলে যাও। খরচ আমি দেবো। একথা শোনার পর থেকে আমার ঘরটিই আমার কাছে একটি জাহান্নাম মনে হলো। সিদ্ধান্ত নিলাম আর এখানে থাকব না। হোক সে আমারই বাড়ি তবুও সম্মান বাঁচাতে বের হয়ে আসলাম। এখন এটাই আমার বাড়ি’। 

হাজেরার বয়স ৭৫ পেরিয়ে গেছে। সংসার, ছেলে, ছেলের বৌ, নাতি-নাতনি সবই আছে তারপরও তিনি একা। জানালেন একসময় রাজধানীর স্কলাসটিকা স্কুলের শিক্ষিকা ছিলেন। চার বছর হলো বৃদ্ধাশ্রমে আছেন। ছেলেমেয়ে দুইজন। নিজের বাড়ি রাজধানীর রামপুরায়। কেমন আছেন জানতে চাইলে বললেন ‘এখানে ভালো থাকতে এসেছি তাই ভালো আছি’। আসার কারণ জানতে চাইলে রেগে গেলেন। তার বক্তব্য ‘অতীত জানতে চাইবে না। তা নিয়ে কিছু বলতে চাই না। কষ্ট ভুলতে এখানে এসেছি। তাই সন্তান, পরিবার এসব বিষয়ে কিছু বলব না’। এরপর চোখ মুছতে মুছতে চলে গেলেন। 

বারান্দার চেয়ারে বিষণœ মনে বসে ছিলেন আরেক বৃদ্ধ। তার কাছে বসে কেমন আছেন জানতে চাইলাম। জানালেন ভালো আছেন। এরপর একে একে সবই বললেন। কথা মধ্যে একাধিকবার কান্নাও করলেন। বললেন মনটা মানতে চায় না। সন্তান স্বজন ছেড়ে এখানে খুব মানসিক যন্ত্রণায় আছি। কিন্তু কি করব। সন্তান থেকেও নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছি। সব বলব না। তবে আমার ব্যক্তিজীবন ও কর্মজীবন ছিল বর্ণিল। সন্তানদের পড়ালেখা করে মানুষ করেছি। তারা দেশে-বিদেশে ভালো চাকরি কেউ ব্যবসায় করছে। কিন্তু আজ আমি তাদের কাছে বুঝা। বছর ধরে বৃদ্ধাশ্রমে আছি। কিন্তু আজো সন্তানরা আমার খোঁজ নেয়নি। 

বাবা মারা যাওয়াতে পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে স্কুল জীবনেই সংসারের হাল ধরেন ছোটন মিয়া। অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ছোট ভাইবোনদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। কিন্তু বিয়ে না করায় আজ তিনি বড় একা। যাদের তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছেন আজ তারাও তার পর। কেউই তার একাকীত্বের ভাগিদার হতে চায় না। অবশেষে বৃদ্ধাশ্রমই তার ঠিকানা। কিন্তু এখানেও বিপত্তি। থাকা-খাওয়া খরচ বাকি। কিন্তু তা পরিশোধের কেউ নেই। 

শাহনাজ বেগম (৭০)। স্বামী নেই। ঢাকার নারিন্দা ছেলের সাথে বসবাস করতেন। কিন্তু হঠাৎ ছেলে ফ্লাট বিক্রি করে বউকে নিয়ে অন্যত্র চলে গেছে। সর্বশেষ তার জায়গা হয়েছে এখানে। অশ্রুসিক্ত নয়নে তিনি বলেন, ‘মাকে একটু জায়গা দিলে ওদের কী এমন অসুবিধা হতো! তারপরও আমি তো মা। সব সময় চাই আমার ছেলে ভালো থাকুক।


আরো সংবাদ



premium cement