নদীর প্রতি ভালোবাসার দৃষ্টান্ত দেখালো তিস্তা পাড়ের মানুষ
- অসীম আল ইমরান, তিস্তা পাড় থেকে
- ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:২০, আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:২৯

তিস্তা নদীর তীরে বসবাসকারী মানুষের জীবনে নদী শুধু জলধারা নয়, তাদের অস্তিত্বের সঙ্গী। নদীর সাথে তাদের সম্পর্ক শুধু অর্থনৈতিক বা ভৌগোলিক নয়, এটি এক গভীর আবেগের বন্ধন। সম্প্রতি তিস্তা পাড়ের মানুষের নদী রক্ষায় তাদের অকৃত্রিম ভালোবাসা ও সংগ্রামের একটি অনন্য দৃষ্টান্ত দেখালো। তিস্তা নদী উত্তরবঙ্গের জীবনরেখা, এই নদী কৃষি, মৎস্য চাষ ও দৈনন্দিন জীবনের জন্য অপরিহার্য।
মঙ্গলবার (১৮ ফ্রেব্রুয়ারি) তিস্তা রক্ষা আন্দোলন কমিটির ৪৮ ঘণ্টার কর্মসূচির সমাপনী দিন মশাল প্রজ্বলন, গান, নাট্যমঞ্চের মধ্যদিয়ে রাত ২টায় শেষ হবে।
এর আগে সকালে উত্তরাঞ্চলের পাঁচটি জেলার ১১টি পয়েন্টে লাখো মানুষ নিয়ে পদযাত্রা করেছে এ সংগঠনটি। তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন কমিটির প্রধান সমন্বয়কারী অধ্যক্ষ আসাদুল হাবীব দুলুর নেতৃত্বে পদযাত্রাটি তিস্তা সড়ক সেতু হয়ে তিস্তা রেলসেতু কাউনিয়া পয়েন্ট গিয়ে শেষ হয়। পদযাত্রা শেষে নদীতে নেমে প্লাকার্ড প্রর্দশন কর্মসূচি পালন করেন জনগণ। তিস্তা রেলসেতু লালমনিরহাট ও কাউনিয়া প্রান্তে লাখো মানুষ তিস্তা নদীতে নামেন। নানা বয়সের, নানা শ্রেণী পেশার, নানা ধর্মের মানুষ এতে অংশ নেন। হেঁটে হেঁটে নদীর মধ্যে দিয়ে এপার থেকে ওপারে যান তারা। কোথাও কোমর সমান পানি, কোথাও বুক সমান, কোথাও আবার হাঁটু সমান পানি। নদীর দু’ প্রান্ত আরো হাজার হাজার মানুষ দাঁড়িয়ে থেকে কর্মসূচিতে সামিল হন। পুরুষের সাথে এসেছেন নারীরাও। ছোট ছোট বাচ্চা এসেছেন। এ সময় তিস্তা নদী আমার মা-মরতে আমরা দেবো না, আমার নদী আমার মা-ভারতকে দেবো না, জিয়ার মতো কোদাল ধরো-তিস্তা নদী খনন করো, তোমার আমার ঠিকানা-তিস্তা তিস্তা, জাগো বাহে , তিস্তা বাঁচাইসহ নানা স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে তিস্তা পাড়।
এছাড়া দু’ রাত ধরে তাবু বসিয়েছে রাত্রিযাপন, দেশীয় সংগীত, নৃত্য, লোকজগান, দাড়িয়াবান্ধা, ফুটবলসহ নানা ধরনের কর্মসূচি পালন করেছে প্রতিবাদ হিসেবে।
স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলেন, ‘পতিত হাসিনা তার চেয়ার দখল রাখতে গিয়ে রংপুরের মানুষের কথা ভাবেনি। ভারত হয়তো তাকে বলেছিল, ‘ক্ষমতা চাও, না, পানি চাও’। শেখ হাসিনা হয়তো বলেছিলেন ‘ক্ষমতা চাই’। তাই ভারত এভাবে কষ্ট দেয়।
৬৫ বছরের বয়সী হাজের আলী এসেছেন তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলনে। সরেজমিন দেখা যায়, তিস্তার রেলসেতুর নিচে পানি নেমে ডুব দিয়ে দেখাচ্ছেন, পানি নাই তার তিস্তায়। কোমর পর্যন্ত পানি। দু’ দিনের কর্মসূচির মধ্যে এ অঞ্চলে মানুষ তিস্তায় পানি নেই তা আজ পানিতে নেমে দেখালো। সেইসাথে পদযাত্রা করে বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিয়েছি। পানি নেই এখানে, শুধু ধুঁধুঁ বালুচর। পানির হাহাকার। দীর্ঘ দিন রংপুরের মানুষ বঞ্চনার শিকার। আমরা কোনো কথা শুনতে চাই না। তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা ও মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়ন চাই।
স্থানীয় নৌকার মাঝি দলিত দাস বলেন, ‘তিস্তা আমাদের মা। আমরা এই নদীর পানিতেই বড় হয়েছি। আজ যদি আমরা এটাকে বাঁচাতে না পারি, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কী করবে?’ তার কথায় প্রতিফলিত হয় তিস্তা পাড়ের মানুষের নদীর প্রতি গভীর মমত্ববোধ।
ভারতের উদ্দেশ করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, ‘আমাদের ন্যায্য অধিকার না দিলে বিকল্প পথ আমাদের ভাবতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘ভারতের সাথে বাংলাদের ৫৪টি অভিন্ন নদী। এসব নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা কারো করুণার বিষয় নয়। আন্তর্জাতিক নদী আইন অনুযায়ী, পানি বাংলাদেশের প্রাপ্য। দেশের মানুষের প্রাপ্য। তিস্তা নদীর পানির জন্য আমাদের আন্দোলন করতে হচ্ছে। পানি বন্টন নিয়ে আমাদের প্রতিবেশী দেশে বাংলাদেশের মানুষের সাথে অপ্রতিবেশীমূলক আচরণ করেই চলেছে। ৫০ বছর যাবৎ ফারাক্কার অভিশাপ থেকে বাংলাদেশ মুক্তি পাই নাই। এখন আবার এসেছে তিস্তার অভিশাপ।’
মঙ্গলবার বিকেলে তিস্তা রক্ষা ও মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবিতে টানা ৪৮ ঘণ্টার কর্মসূচির সমাপনী দিনের প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যোগ দেন তিনি।
তারেক রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ মনে করে, প্রতিবেশী দেশের সাথে প্রয়োজনে সকল অসম, অন্যায্য, একতরফা সকল চুক্তি পুনর্মূল্যায়ন ও পুনর্বিবেচনা করা দরকার। সবার সাথেই বন্ধুত্ব, কারো সাথেই বৈরিতা নয়। আমাদের পররাষ্ট্র নীতির এটি হচ্ছে মূল স্লোগান বা মূল নীতি। কিন্তু সময়ের প্রয়োজনে এই স্লোগান বা নীতির পুনর্বিবেচনা করা দরকার। বর্তমান বিশ্বে স্থয়ী শত্রু বা মিত্র বলে কিছু নেই। একটি দেশের সাথে আরেকটি দেশের সম্পর্ক হবে পারস্পরিক স্বার্থ রক্ষায়, ন্যায্যতা, প্রয়োজনেন ভিত্তিতে। সম্পর্ক রক্ষায় নিজ দেশ ও জনগের স্বার্থ রক্ষায় হবে প্রথম অগ্রাধিকার। বন্ধুত্বের দোহাই দিয়ে বাংলাদেশের জনগণ ফেলানীর লাশ আর কাঁটাতারে দেখতে চায় না। সীমান্ত নিরীহ বাংলাদেশের রক্তাক্ত লাশ বাংলাদেশ আর দেখতে চায় না।’
তিনি বলেন, ‘ভারত যদি পানির ন্যায্য হিস্যা না দেয় বা দিতে যদি দেরি করে। তিস্তা চুক্তি করতে অনীহা দেখায় তাহলে দেশ ও জনগণের স্বার্থে, জনগণকে বাঁচাতে, কৃষি বাঁচাতে, কৃষক বাঁচাতে, নদী বাঁচাতে, নদীর নাব্যতা রক্ষা করতে তিস্তা সমস্যা সমাধানের জন্য আমাদেরকে বাঁচার বিকল্প পথ খুঁজে নিতে হবে। দেশ ও আন্তর্জাতিকভাবে সকল সম্ভাব্যকে কাজে লাগাতে হবে। এজন্য জাতিসঙ্ঘসহ সকল আন্তর্জাতিক ফোরামে জোড়ালোভাবে আমাদের দাবি তুলে ধরতে হবে। প্রতিবেশী দেশের সাথেও কূটনীতিক সম্পর্ক আবার নতুন করে শুরু করতে হবে বলে জানান তিনি।
ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘প্রতিবেশী দেশের অপ্রতিবেশী মূলক আচরণের কারণে আজকে তিস্তা পাড়ের লাখ মানুষ বন্যায় এবং খরায় অসহায় জীবনযাপন করছে। পানির অভাবে কোটি টাকার শস্য ক্ষতি হচ্ছে।’
তারেক রহমান বলেন, ‘বিএনপি ক্ষমতায় এলে তিস্তা রক্ষার বিষয়টি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেখবে। পাশাপাশি দেশের অন্যান্য যে সকল নদী আছে সেগুলোকে আমাদের পুনরায় সংস্কার এবং খনন করতে হবে। শহীদ জিয়ার মতো খাল খনন করব।’
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ‘স্বৈরাচার সরকার গত ১৫টি বছর নির্বাচনকে তামাশায় পরিণত করেছে। দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক, ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়ে একটি মাফিয়াতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল। স্বৈরাচার ৫ আগস্ট পালিয়ে যাওয়ার পর সম্ভাবনার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সরকারের কোনো হটকারী সিদ্ধান্তে বা আমাদের অসতর্কতায় যেন খুনি ফ্যাসিস্ট সরকারের কেউ যেন পুনর্বাসন হওয়ার সুযোগ না পায়, সেদিকে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘দু’দিন যাবৎ তিস্তা পাড়ের মানুষ যে আন্দোলন করছে এটা বৃথা যাবে না। তিস্তাকে রক্ষা করতে হলে তিস্তাবাসীকে একটি দায়িত্ব পালন করতে হবে। আর সেটি হচ্ছে, আগামী জাতীয় নির্বাচনে আপনাদেরকে আপনাদের পছন্দের দলকে সমর্থন দিবেন। ক্ষমতায় এলে সকলকে সাথে নিয়ে তিস্তার সমস্যা সমাধান করব।’
তিনি আরো বলেন, ‘বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দেখেছে মানুষের ঐক্যবদ্ধতা। কিভাবে তারা একটি সঙ্কটে নিজেদেরকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। আপনারা যেভাবে বলেছেন, জাগো বাহে তিস্তা বাঁচাও। একইভাবে আমাদের বাংলাদেশের সকলকে বলতে হবে, জাগো বাহে তিস্তা বাঁচাও, জাগো বাহে বাংলাদেশ বাঁচাও।’
কুড়িগ্রামে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘আজকের এই দাবি আমাদের প্রাণের দাবি। আন্তর্জাতিকভাবে ন্যায়নীতির ন্যায্য দাবি। প্রত্যেকটি দেশে এই ধরনের যখন নদী বিভিন্ন দেশ দিয়ে প্রবাহিত হয়, সেখানে এগুলো পরিচালনার জন্য সবগুলো দেশের সমন্বয় হয় ও ব্যবস্থাপনা থাকে। আজকের সেই ব্যবস্থপনা ব্যর্থ হয়েছে। আজকের এই দাবি হচ্ছে সকল ব্যবস্থপনা ফিরিয়ে আনার। তিস্তা নদীর পানি বাংলাদেশের মানুষের ন্যায্য দাবি। এই দাবি পূরণ করতে হবে।’
তিস্তা পাড়ের মানুষের এই উদ্যোগ শুধু তিস্তা রক্ষা আন্দোলন কমিটির নয়, সারা দেশের জন্য একটি অনুপ্রেরণা। নদী রক্ষার এই প্রচেষ্টা প্রকৃতির প্রতি দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তিস্তা পাড়ের মানুষের এই ভালোবাসা ও সংগ্রাম প্রকৃতির সাথে মানুষের মেলবন্ধনের এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
‘তিস্তা রক্ষার এ আন্দোলন সফল হবে, সেই সাথে রস ও রঙ্গে ভরা রংপুর , ফিরে পাবো’ এমন প্রত্যাশা উত্তরাঞ্চলবাসীর।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা