এমন কিছু করব, আমাকে নিয়ে গর্ব করবে তোমরা : মাকে বলতেন শহীদ আহনাফ
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০৪
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সরকারি বাহিনীর সহিংস আক্রমনে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান রাজধানীর বিএএফ শাহীন কলেজের ছাত্র শাফিক উদ্দিন আহমেদ আহনাফ। ২০২৪ সালে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার সরকারের পদত্যাগের একদফা দাবিতে চলমান আন্দোলনের সময় এই ঘটনা ঘটে। শহীদ আহনাফের বয়স হয়েছিল মাত্র ১৭ বছর।
তিনি তার পরিবারের সদস্যদের বলতেন, ‘বড় হয়ে আমি এমন কিছু করব, যার জন্য তোমরা আমাকে নিয়ে গর্ব করবে।’
গত ৪ আগস্ট রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বর ফায়ার সার্ভিসের সামনে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন আহনাফ। তাকে নিয়ে এখন গর্বিত পরিবারের সদস্যরা। তবে তার মৃত্যুর মাধ্যমে এভাবে তারা গর্বিত হতে চাননি। ওই দিন বিকেল ৫টা নাগাদ আহনাফ গুলিবিদ্ধ হন।
রাজধানীর মিরপুরের ১১ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্য পাইকপাড়ার বাসায় এই প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে আন্দোলনে শহীদ শাফিক উদ্দিন আহমেদ আহনাফের মা জারতাজ পারভীন এসব কথা জানান।
বিএএফ শাহীন কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন আহনাফ। ২০২৫ সালে তার এইচএসসি পরীক্ষা দেয়ার কথা ছিল। তিনি শুরু থেকেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে সোচ্চার ছিলেন। আন্দোলনে অংশ নিয়ে একবার টিয়ার গ্যাস ও রাবার বুলেটে আহত হয়ে বাসায় ফিরেন। পরিবারের সদস্যরা অনেক বুঝিয়েছিলেন আন্দোলনে না যাওয়ার জন্য, কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি।
আহনাফের গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জ জেলায়। তবে সেখানে কেউ না থাকায় তাদের যাওয়া হতো না। তার বাবা নাসির উদ্দিন আহমেদ (৪৮) একটি বেসরকারি কোম্পানিতে সেলসম্যানের চাকরি করেন। মা জারতাজ পারভীন (৩৮) গৃহিণী। একমাত্র ছোট ভাই ইফতেখার উদ্দিন আহমেদ (১৩) সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে।
আহনাফ ৪ আগস্ট শহীদ হলেও তাকে দাফন করা হয় ৫ আগস্ট রাজধানীর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে।
‘১৯৭১ সালে মায়েরা তোমাদের মতো হলে দেশ স্বাধীন হতো না’
আন্দোলনের শুরু থেকেই আহনাফ ছাত্রদের সাথে বের হতেন। কখনো নিষেধ মানতেন না। টিয়ার শেল ও রাবার বুলেটের আঘাতে আহত হয়েও আন্দোলনে যাওয়া বন্ধ করেননি। আন্দোলনে যেতে নিষেধ করলে তিনি মাকে বলতেন, ‘তোমাদের মতো ভীতু মায়েদের জন্যই ছেলে-মেয়েরা আন্দোলনে যেতে পারছে না। ১৯৭১ সালে মায়েরা তোমাদের মতো হলে দেশ স্বাধীন হতো না।’
জারতাজ পারভীন বলেন, ‘আন্দোলনে যেতে বাধা দিলেই আহনাফ বলত, সে সাঈদ-মুগ্ধ ভাইদের মতো সাহসী হতে চায়। তাদের মতো কিছু হলে তারা গর্ব করতে পারবেন।’
তিনি আরো বলেন, ‘গত ৪ আগস্ট ঘুম থেকে উঠেই বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করল। আমি বললাম, আজ তুমি কোনোভাবেই বের হতে পারবে না। কালকে লং মার্চে আমার সাথে যেও। কিন্তু সে বলল, আমি যাবই। দুপুরের পর চলে গেল।’
‘এখনো মনে হয় দরজায় নক করলে আহনাফ ফিরে আসবে’
আহনাফের মা বলেন, ‘১৭ বছরে একদিনও সে নিজের হাতে ভাত খায়নি। আমি না থাকলে ওর বাবা খাইয়ে দিত। এখন ভাত খেতে গেলেই আহনাফের কথা মনে পড়ে। মাঝে মাঝে বাসার দরজায় কেউ নক করলেই মনে হয়, এই বুঝি কলেজ থেকে আমার আহনাফ ফিরল।’
তিনি বলেন, ‘গিটার বাজানো ও ফুটবল খেলা ছিল তার শখ। ওই দিনও বাসায় ফিরে কাজিনের বাসায় গিয়ে গানের আড্ডা দেয়ার কথা ছিল। আমি ফোন দিয়ে খোঁজ নিতাম। আমার ছেলে বলেছিল, আমি ৬০ ফিট সড়কে আছি, নিরাপদে আছি। এর ৩০ মিনিট পর ফোন দিলে বলল, আমি মিরপুর-১০ নম্বরে। তখন বললাম, তুমি তো বলেছিলে যাবে না! একটু পর কারফিউ। তখনও সে বলল, আমি নিরাপদে আছি।’
‘হলুদ জুতা, প্রিয় গিটার, সব রেখে চলে গেছে আহনাফ’
পরিবারের সদস্যরা প্রতিবেদককে দেখালেন, ‘ওই যে ওর গিটার, ওর পড়ার টেবিল।’ আহনাফের একটি কালো বিড়াল ছিল, তার নাম ‘নিগ্গি।’
কলেজে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে ভর্তি হয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘ভবিষ্যতে চাকরি করবো না, ব্যবসা করবো।’ পাশাপাশি একটি গানের ব্যান্ড গড়ার স্বপ্ন দেখতেন আহনাফ।
নাসির উদ্দিন আহমেদ চোখ মুছতে মুছতে বলেন, ‘আমার ছেলেটা চলে গেছে, কিন্তু রেখে গেছে অনেক স্মৃতি।’ খাটের নিচ থেকে ছেলের হলুদ জুতা বের করে দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘এই জুতা পায়ে দিয়ে আহনাফ ফুটবল খেলত। আর গিটারটা ছিল ওর প্রাণ।’
আহনাফের ছোট ভাই ইফতেখার কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না, তার বড় ভাই আর নেই। ভাইয়ের গিটার বুকে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ফেলছিল সে।
‘আমার সন্তানের বিনিময়ে সুন্দর একটি দেশ চাই’
আন্দোলনকারীদের কেউ একজন একটি বড় জাতীয় পতাকা দিয়ে ঢেকে আহনাফকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন।
নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমাদের সন্তানদের রক্তের বিনিময়ে এখন শুধু সুন্দর একটি দেশ চাই। আমি দুনিয়ায় বেঁচে থাকতে আমার সন্তান হত্যার বিচার দেখে যেতে চাই।’
২০২৪ সালের ৪ আগস্ট রাজধানীর মিরপুর-১০ নম্বরে আহনাফের মৃত্যুর ঘটনায় ৩ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের বরাবর অভিযোগ দায়ের করেন তার মা জারতাজ পারভীন। সূত্র : বাসস