১২ জানুয়ারি ২০২৫, ২৮ পৌষ ১৪৩১, ১১ রজব ১৪৪৬
`

গুলিতে বাঁকা হয়ে গেছে পা, তারপরও অটোরিকশার স্টিয়ারিং ধরার স্বপ্ন সেলিমের

- ছবি : বাসস

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নিয়ে পা ও কোমরে এক শ’-এরও বেশি ছররা গুলিতে বিদ্ধ হয়েছেন সিএনজি অটোরিকশার চালক মো: সেলিম। অনেকটা অবশ হয়ে বেঁকে গেছে ডান পায়ের পাতা। কোনো রকমে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কয়েক কদম হাঁটাচলা করলেও পেছনে সাপোর্ট ছাড়া স্থির হয়ে বসতে পারেন না। বউ বাচ্চাদের মুখে দু’মুঠো ভাত তুলে দেয়ার একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি সেলিম গত পাঁচ মাস ধরে হাসপাতাল আর গৃহবন্দি অবস্থায় জীবন কাটাচ্ছেন। ভাড়ায় চালানো সিএনজি অটোরিকশাটিও মালিক অন্যজনকে দিয়ে দিয়েছেন। ইতোমধ্যে আত্মীয়দের সহযোগিতা ও নিজের জমানো টাকাও ফুরিয়ে গেছে চিকিৎসা আর খাবারের ব্যয়ে। বেঁকে যাওয়া পা কখন সোজা হবে, আর সুস্থ হয়ে আবারো সিএনজি অটোরিকশার স্টিয়ারিং ধরবেন সে স্বপ্ন দেখছেন দারিদ্র্যের সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকা আহত সেলিম। কারণ এটাই তার পেশা ও বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন।

সম্প্রতি এই প্রতিবেদকের সাথে কথা বলার সময় সেলিমের চোখেমুখে দেখা গেছে রাজ্যের হতাশার ছাপ।

মো: সেলিম (৫০) চট্টগ্রাম নগরীর বহদ্দারহাট খাজা রোডের পাক্কার দোকান এলাকার কামাল চেয়ারম্যান বাড়ির মরহুম নূরুল ইসলামের তৃতীয় সন্তান। প্রবাসী বড় ভাই ও পাইপ ফিটার মিস্ত্রি মেঝ ভাইয়ের সংসার আলাদা। ছোট ভাই এখনো বেকার। বিবাহিত তিন বোন যার যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত।

স্ত্রী হীরা আক্তার (৩২), মেয়ে স্থানীয় তাজুল ইসলাম উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী তামান্না আক্তার (১৩) ও ছেলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র মো: আরিফ চৌধুরীকে (১২) নিয়েই সেলিমের সংসার।

ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করা মো: সেলিম বলেন, সিএনজি চালানোর কারণে এলাকার ছাত্র ভাইদের সাথে আমার পরিচিতি গড়ে ওঠে। দেশে যখন স্বৈরাচার হাসিনার পতনের জন্য তুমুল আন্দোলন শুরু হয় তখন আমি অনেক ছাত্র ভাইকে সিএনজিতে করে দিয়ে এসেছি নানা স্থানে। কখনো তাদের সাথে ভাড়ার জন্য দর দাম করি নাই। যা দিয়েছেন তা হাসিমুখে নিয়েছি। প্রতি মূহূর্তে খবর পাচ্ছিলাম ঢাকা-চট্টগ্রামসহ সারাদেশে নির্বিচারে গুলি করে ছাত্র-জনতাকে হত্যা করছে পুলিশ ও সরকারি দলের গুণ্ডারা। এসব শুনে স্বৈরাচারি হাসিনার পতনের আন্দোলনে শরিক হতে আমার মধ্যেও ইচ্ছে জাগে।

তিনি বলেন, গত ২ আগস্ট নগরীর মুরাদপুরে পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের সন্ত্রাসীদের সাথে ব্যাপক সংঘর্ষ হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার সাথে। নিজের সিএনজিটা নিরাপদ স্থানে রেখে ছাত্র-ভাইদের সাথে সেখানে আন্দোলনে অংশ নিই।

সেলিম জানান, তিনি ৪ আগস্ট সকাল বেলা গাড়ি চালিয়ে বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে চট্টগ্রাম নগরীর বহদ্দারহাট সংলগ্ন চান্দগাঁও থানার মোড়ে ছাত্র-জনতার সাথে আন্দোলনে অংশ নেন। এ সময় বহদ্দারহাট এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। পুলিশ এবং ছাত্রলীগ-যুবলীগের সন্ত্রাসীরা দু’দিক থেকে মুহুর্মুহু গুলি ছুঁড়তে থাকে। হঠাৎ তিনি দেখেন, তার সামনে ফাঁকা রাস্তায় এক ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হয়ে সড়কে কাতরাচ্ছে। তখন তিনি তাকে উদ্ধার করতে যান। এ সময়ে দু’জন পুলিশ তাকে লক্ষ্য করে ছররা গুলি ছোঁড়ে। অনেকগুলো গুলি তার শরীরে বিদ্ধ হয় এবং তার কোমর থেকে নিচের দিক ঝাঁঝরা হয়ে যায়।

সেলিম বলেন, কয়েক মিনিটের মধ্যেই দেখি রক্তে ভিজে গেছে পরনের প্যান্ট। শরীরের নিচের অংশে ব্যথা আর যন্ত্রণার সাথে অবশভাব অনুভব করি। একপর্যায়ে মাথা ঘুরে ডান পা মচকে সড়কে পড়ে যাই। এরপর পরিচিত রুবেল ও নূরুল ইসলাম আমাকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে নিয়ে যায়। তারা আমার স্ত্রীকে খবর দেয়।

সেলিমের স্ত্রী হীরা আক্তার জানান, বিকেল ৫টার দিকে সেলিমকে হাসপাতালে নেয়া হলেও তার চিকিৎসা শুরু হয় সন্ধ্যা ৭টার পর। এরই মধ্যে রক্তক্ষরণে তার শরীর অনেকটা নিস্তেজ ও অজ্ঞান হয়ে পড়েন তিনি। চিকিৎসকের পরামর্শে তাৎক্ষণিক দুই ব্যাগ রক্ত দেয়ার প্রায় দু’ঘণ্টা পর তার জ্ঞান ফেরে। তিনি ৪ থেকে ১৪ আগস্ট পর্যন্ত চমেক হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। সেখানে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, চিকিৎসকরা তার এক্স-রে রিপোর্ট দেখে জানিয়েছেন, কোমরের পেছনে ও পায়ে এক শ’টির মতো ছররা গুলি লেগেছে, তাই অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়েছে। পায়ের নার্ভ ও রগের মধ্যে কয়েকটি ছররা গুলি বিদ্ধ হবার কারণে ডান পায়ের পাতা এখন বাঁকা হয়ে গেছে। যার কারণে তাকে এখন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হয়। কিছুক্ষণ দাঁড়ালে পা অবশ হয়ে যায়। পেছনে বালিশ কিংবা নরম কিছুর সাপোর্ট ছাড়া সোজা হয়ে বসতে পারে না। কারো সহযোগিতা ছাড়া একা কিছুই করতে পারে না।

হীরা আক্তার আক্ষেপ করে বলেন, ঘটনার পাঁচ মাস পেরিয়ে যাচ্ছে। স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে। নতুন সরকার ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু যারা আন্দোলন সংগ্রামে নিজেদের জীবন বিপন্ন করেছে তাদের তেমন কোনো খবর নিচ্ছে না নতুন সরকার।

তিনি আরো বলেন, গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে থাকাবস্থায় চান্দগাঁওয়ের সাবেক কাউন্সিলর মাহবুব আলম পাঁচ হাজার টাকা এবং চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহ তিন হাজার টাকা সহযোগিতা করেছেন। এছাড়া কয়েকজন আত্মীয় ও প্রতিবেশিরা মিলে চিকিৎসার জন্য ১০ হাজার টাকার মতো দিয়েছেন। এ পর্যন্ত সরকারিভাবে কোনো সহযোগিতা আমরা পাইনি। অথচ টেলিভিশনে দেখি আন্দোলনে নিহত ও আহতদের দায়িত্ব সরকার নেয়ার কথা বলছে।

হীরা আক্তার চোখের পানি মুছতে মুছতে বলেন, আমার দুই ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যত অন্ধকার হয়ে গেল। চিকিৎসকের পরামর্শে প্রতিদিন ওষুধ খেতে হচ্ছে, সবই দামি ওষুধ। কিছুদিন পরপর হাসপাতালে নিয়ে চেকআপ করাতে হয়। চিকিৎসার পেছনে অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে। ধার দেনা করে তার চিকিৎসা, ওষুধ ও পরিবারের খরচ যোগাতে হচ্ছে। অথচ আমাদের খবর কেউ নিচ্ছে না। স্বামীর পৈত্রিক বাড়িতে থাকি বলে বাসা ভাড়া দিতে হয় না। মাথা গোঁজার ব্যবস্থাটা আছে। কিন্তু চিকিৎসা আর পেট তো চালাতে হবে। এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে কখনো ভাবিনি।

এ সময় বিছানায় হেলান দিয়ে বসে থাকা মো: সেলিম বলেন, এখন অনেকটাই ভাইদের সাহায্যে চলছে পরিবার। কতদিনই বা তারা সহযোগিতা করতে পারবে। প্রথম দু’মাস তো বিছানা থেকে উঠতেই পারিনি। এখন একটু অবস্থার উন্নতি হলেও কখন সিএনজি নিয়ে বের হতে পারবো, সেই চিন্তাই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। নিজে গাড়ি চালাতে না পারলে তো আমার বউ-বাচ্চাকে না খেয়ে থাকতে হবে। এখন ছেলে-মেয়েদের ভালো কিছু খাওয়াতে পারি না। বছরের প্রথম মাসে বাচ্চাদের নতুন ভর্তি ও পড়ালেখার খরচ যোগাতে না পারলে তাদের ভবিষ্যতটা অন্ধকার হয়ে যাবে। কথা বলতে বলতে কণ্ঠ ভারি হয়ে ওঠে তার। একপর্যায়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেন সেলিম। তার চোখে মুখে ভেসে ওঠে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ছায়া।

তিনি বলেন, আমরা একটি বৈষম্যহীন ও হানাহানিমুক্ত বাংলাদেশ চাই। যেখানে আমি আপনি সবাই নিরাপদে বসবাস করতে পারবো। সারাদেশে যারা কোটাবিরোধী আন্দোলনে নির্বিচারে হামলা ও গুলি চালিয়েছে তাদের যেন কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়।

সূত্র : বাসস


আরো সংবাদ



premium cement