০২ জানুয়ারি ২০২৫, ১৮ পৌষ ১৪৩০, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৫
`

খেতে চাওয়ায় গরুর গোশত রেঁধে অপেক্ষায় ছিলেন মা, ছেলে আর ফিরলো না

- ছবি : বাসস

প্রায় ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসন থেকে দেশকে মুক্ত করার লক্ষ্যে গত ৫ আগস্ট ঐতিহাসিক ‘মার্চ টু ঢাকা প্রোগ্রাম’-এ যোগ দেন মানসিক প্রতিবন্ধী ২২ বছরের যুবক আব্দুল রাকিব।

ওই দিন বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে তিনি তার বিধবা মা অজিফা খাতুনের কাছে অনুরোধ করেছিলেন, ‘মা, আজ গরুর গোশত রান্না করো। আমি দেশ স্বাধীন করে বাড়ি ফিরে গরুর গোশত দিয়ে ভাত খাবো।’

দেশের রাজনৈতিক সঙ্কট সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকলেও তিনি তার চারপাশের লোকদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। মা অজিফা খাতুনকে বলেছিলেন, ‘আমি আমার রক্তের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন করবো।’

স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনাকে উৎখাত করতে ওই আন্দোলন সফল হয়েছে। মা তার ছেলের জন্য গরুর গোশত রান্না করে অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু রাকিব আর তার মায়ের কাছে ফিরে আসেননি।

স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনার পতনের পর বিজয় মিছিলে যোগদানের সময় যাত্রাবাড়ী থানার সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত রাকিব তার মা আজিফার প্রতি দায়িত্বশীল ছিলেন।

রাজধানীর যাত্রাবাড়ির রায়েরবাগ এলাকার রইছনগরের ভাড়া বাসায় বসে এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে শোকাহত অজিফা তার হৃদয়বিদারক মুহূর্তের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন।

তিনি বলেন, ‘আমি গরুর গোশত এবং ভাত রান্না করে আমার ছেলের ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু রাত ৮টার দিকে কিছু লোক আমার কাছে এসে বলে যে আমার ছেলেকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে।’

রাকিব স্থানীয় একটি মসলা মিলে কাজ করে তার মাকে সাহায্য করতেন। তার মৃত্যুর পর থেকে তিনি এক রুমের টিনশেড ঘরে একাই বসবাস করছেন।

রাকিবের মনে এক অন্ধ বিশ্বাস ছিল যে, কেউ তার কোনো ক্ষতি করবে না। আন্দোলনে যেতে নিষেধ করায় তিনি তার মাকে বলেছিলেন, ‘আমি প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি। সবাই আমাকে ভালোবাসে। কেউ আমাকে কিছু করবে না।’

কিন্তু রাকিবের সে বিশ্বাসকে মিথ্যা প্রমাণিত করে মর্মান্তিকভাবেই তার দিনটি শেষ হয়। যাত্রাবাড়ীতে বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশ গুলি চালায়। আর রাকিব বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন।

অজিফা জানান, পরে তার এক মেয়ে ও এক ছেলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে গিয়ে বেশ কিছু লাশের মধ্যে রাকিবের প্রাণহীন দেহ মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখেন।

রাকিবের স্মৃতি সারাক্ষণ অজিফাকে তাড়া করে। তিনি রাতে ঘুমাতে পারেন না। ছেলের শোকের সাথে ঠাণ্ডা-কাশিতে দুর্বল অজিফা বেদনাদগ্ধ কন্ঠে বলেন, ‘আমার ছেলে রাতে বাসায় ফিরে গেটে নক করত। তাকে ঘরের ভেতরে ঢুকতে দিতে বলতো। এখন আর কেউ দরজায় ধাক্কা দেয় না।’

কাঁদতে কাঁদতে অজিফা বলেন, রাকিবের মৃত্যুর পর থেকে ধীরে ধীরে আমার স্বাস্থ্যের অবনতি হচ্ছে। আল্লাহ আমার ছেলেকে শহীদি মর্যাদা দান করুন এবং তাকে জান্নাতুল ফেরদৌসে স্থান করে দিন।’

কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার ভূমিহীন ও গৃহহীন ইদন মিয়া কয়েক বছর আগে মারা যান। তার পাঁচ ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে রাকিব সবার ছোট। তার বড় ভাই মো: লিটন (৪৬) রিকশা-ভ্যান চালক, মো: আমিন (৩৬) রিকশাচালক, মো: রাসেল (৩৪) ফটোগ্রাফার এবং মো: হানিফ (৩০) গার্মেন্টসকর্মী। তারা সবাই রাজধানী শহরে নিজ নিজ পরিবার নিয়ে আলাদা এলাকায় বসবাস করছেন। তার একমাত্র বোন রাবেয়া খাতুন (৩৮) শহরের উত্তর বাড্ডা এলাকায় স্বামীর সাথে থাকেন।

রাকিবের বোন রাবেয়া দুঃখ ভারাক্রান্ত স্বরে বলেন, ‘আমার অন্য ভাইয়েরা আলাদা বাড়িতে বসবাস করছে এবং নিজেদের দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে। তাই আমার মা সবার ছোট রাকিবের সাথে থাকতেন। রাকিবই তার একমাত্র অবলম্বন ছিলেন। তার মৃত্যুর পর থেকে আমার মা খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছেন।

তিনি জানান, রাকিব ৫ আগস্ট সকাল ১১টার দিকে রায়েরবাগ এলাকায় ‘মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচিতে যোগ দেয়। পরে স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনার পতনের পর বিজয় মিছিলেও যোগ দেয়। আমরা একটি ভিডিওতে দেখেছি, আমার ভাই যাত্রাবাড়ী এলাকায় হাজার হাজার লোকের সাথে শ্লোগান দিচ্ছে। পরে অন্য একটি ভিডিওতে আমার ভাইয়ের প্রাণহীন দেহকে কিছু লোক নিয়ে যাওয়ার হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখতে পাই’ বেদনার্ত কন্ঠে ভাইয়ের কথাগুলো বলার সময় তার চোখের পানি দু’গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল।

রাবেয়া বলেন, ‘প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা ও ভিডিও ফুটেজ অনুযায়ী আমরা নিশ্চিত হয়েছি যে, ৫ আগস্ট দুপুর আড়াইটার দিকে যাত্রাবাড়ী থানার সামনে উল্লসিত জনতাকে লক্ষ্য করে পুলিশ নির্বিচারে গুলি ছুঁড়লে রাকিব সেখানেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়।’

সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া আরেকটি ভিডিওতে দেখা গেছে, যাত্রাবাড়ী থানা থেকে সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী বেরিয়ে আসছে এবং রাস্তায় আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি ছুঁড়ছে।

রাবেয়া জানান, খবর পেয়ে তারা ঢামেক হাসপাতালের মর্গে গিয়ে দেড় ঘণ্টা ধরে সারি সারি লাশের মধ্যে খোঁজাখুঁজি করে রাকিবের প্রাণহীন দেহ শনাক্ত করেন। পরে দুপুর ২টার দিকে কয়েকজন শিক্ষার্থীর সহায়তায় ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ উদ্ধার করে তারা।

রাবেয়া বলেন, ‘আন্দোলনরত ছাত্ররা হাসপাতাল থেকে লাশ আনতে আমাদের সাহায্য করেছিল। আমাদের কাছে টাকা না থাকায় ছাত্ররাই আমার ভাইয়ের লাশ আনার জন্য একটি অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করে দেয়। লাশ পাওয়ার পর আমরা আমার ভাইয়ের বুকে একটি বুলেটের ক্ষত দেখতে পাই।’

গত ৬ আগস্ট সকাল ১০টার দিকে মাতুয়াইল কবরস্থানে রাকিবকে দাফন করা হয়। রাকিব মানসিক প্রতিবন্ধী হওয়ায় এলাকার মানুষ তাকে বিশেষ স্নেহ করত।

রাবেয়া বলেন, ‘আমার ভাই মানসিকভাবে অক্ষম হওয়ায় সে সম্পর্কগুলো বুঝতে পারত না। তাই সে প্রায়ই আমাকে আপু না বলে ভাবী বলে ডাকতো। তার প্রতি আমরা সবসময়ই বাড়তি মনোযোগ দিতাম। সে আমার মায়ের সবচেয়ে আদরের ছিল। আমরা কখনই ভাবিনি যে তাকে এভাবে হত্যা করা হবে।’

রাকিবসহ অসংখ্য মানুষকে হত্যার জন্য পরিবারের পক্ষ থেকে অপরাধীদের সুষ্ঠু বিচারের দাবি জানানো হয়।

রাকিব যেখানে কাজ করতেন সেই মসলা তৈরির মিলের মালিক মো: কবির জানান, রাকিব তাকে কাজে সাহায্য করতেন।

তিনি বলেন, ‘সে খুব ভালো ছেলে ছিল। আমি তাকে প্রতিদিন ১০০ টাকা দিতাম, যেটা ছিল তাদের আয়ের প্রধান উৎস। অনেকেই তার সংসার চালানোর জন্য আর্থিক সহায়তা দিতেন।’

সূত্র : বাসস


আরো সংবাদ



premium cement