৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৬ পৌষ ১৪৩১, ২৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

পারিবারিক মসজিদটি পাকা করার স্বপ্ন আর পূরণ হলো না শহিদ সাজিদের

শহিদ ইকরামুল হক সাজিদ - ছবি : সংগৃহীত

নিজের হাতে গড়া পারিবারিক টিনের ছোট মসজিদটি পাকা করতে চেয়েছিলেন ইকরামুল হক সাজিদ। টিউশনি থেকে উপার্জিত অর্থ দিয়েই মসজিদের ইমামের বেতন দিতেন তিনি।

তিনি এলাকার সকলকে বলতেন, আমার লেখা-পড়া প্রায় শেষ। ভালো একটি চাকরি হলে মসজিদ পাকাকরণের কাজ শুরু করবো।

কিন্তু তা আর হলো না। স্বপ্ন পূরণ না করেই বড় অসময়ে তাকে পাড়ি জমাতে হলো পরপারে।

এদিকে শিক্ষার্থী শহিদ ইকরামুল হক সাজিদের স্মৃতিকে অমর করতে তার নামে টাঙ্গাইলের ধনবাড়ির নল্লা বাজার থেকে কদমতলী রাস্তার নামকরণ করেছে প্রশাসন।

পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, গণ-অভ্যুত্থানের সেই উত্তাল সময়ে গত ৪ আগস্ট ঢাকার মিরপুরে সাহালী প্লাজার সামনে কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্র-জনতা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ চলছিল। এ সময় সাজিদও (২৫) সকলের সাথে আন্দোলনে অংশ নেয়। বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে হঠাৎ পুলিশের একটি বুলেট সাজিদের ডান চোখে লেগে মাথার পেছন দিক দিয়ে বেরিয়ে যায়। রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে সাজিদ। মূহুর্তের মধ্যে পিচ ঢালা রাস্তা রক্তাক্ত হয়ে যায়। পরে গুরুতর আহত অবস্থায় সাজিদকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তির পর তার শরীরে অপারেশন করা হয়। প্রায় ১০ দিন সিএমএইচে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। এরপর গত ১৪ আগস্ট দুপুর ২ টায় সিএমএইচেই মারা যান সাজিদ।

পরের দিন ১৫ আগস্ট বৃহস্পতিবার সকালে টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলার বীরতারা ইউনিয়নের বিলকুকড়ি গ্রামে তার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এতে অন্তবর্তীকালীন সরকারের বর্তমান তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম এবং স্থানীয় এলাকাবাসীর সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ অংশ নেন। জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে সাজিদের গড়া সেই মসজিদের পাশেই তাকে দাফন করা হয়।

সম্প্রতি সরেজমিনে টাঙ্গাইলের ধনবাড়ি উপজেলার বিলকুকড়ি গ্রামে গিয়ে সাজিদের বাড়ি কোনটা জানতে চাইলে এলাকার লোকজন সেখানে নিয়ে যায় এ প্রতিবেদককে। সাংবাদিক এসেছেন শুনে আবেগাপ্লত হয়ে পড়েন সাজিদের দাদা। কিছু সময়ের মধ্যে তার বাড়িতে এসে ভিড় জমায় এলাকাবাসী। বাড়িতে গিয়েই প্রথমে দেখা হয় সাজিদের চাচা আকবর আলীর সাথে।

তিনি জানান, আমার ভাই বিমানবাহিনীতে চাকুরি করার সুবাদে ঢাকার মিরপুর ১০ নম্বরে থাকতো। যার কারণে সাজিদও ঢাকায় লেখা-পড়া করতো। সাজিদ ছুটিতে যখন দেশের বাড়িতে আসতো তখন গ্রামের সবাইকে মাতিয়ে রাখতো। গ্রামের মানুষের আপদে বিপদে সব সময় পাশে থাকতো। তাই গ্রামের মানুষ ওকে খুব ভালবাসতো।

তিনি আরো জানান, সাজিদের হাত দিয়ে গড়ে উঠেছে আমাদের পারিবারিক মসজিদটি। কেবলমাত্র টিনের ছাপড়া দিয়ে মসজিদটি তৈরি করা হয়েছে। নিজে টিউশনি করে সেই উপার্জিত অর্থ দিয়ে মসজিদের ইমামের বেতন দিতো সাজিদ। ওর স্বপ্ন ছিল পড়াশুনা শেষ করে ভাল চাকুরি হলে মসজিদটি পাকা করে দেবে। সেই সাথে এলাকার গরীব ও অসহায় মানুষের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত রাখবে। সেই সময় তো আর পেল না ও। আল্লাহতালা ওকে নিয়ে গেল। আল্লাহ যেন সাজিদকে শহিদ হিসেবে কবুল করে জান্নাতবাসী করেন এ দোয়া করি সব সময়। এলাকাবাসীর পক্ষে আমাদের একটাই দাবি সাজিদের স্বপ্নের মসজিদটি যেন সরকার পাকা করার ব্যবস্থা করে দেয়।

শহিদ সাজিদের চাচাতো ভাই শামছুল আলম রতন বলেন, সাজিদ এই রাস্তা দিয়েই বাড়িতে যেতো। তিনি এই আন্দোলনে শহিদ হয়েছেন। আমার ভাইয়ের এই আত্মত্যাগ কখনোই ভুলে যেতে পারি না। আজ আমার ভাই সাজিদ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তার স্মৃতি আমাদের মাঝে এখন আছে। তাই আমরা তার নামানুসারে এই রাস্তার নামকরণের জন্য জেলা প্রশাসন ও ধনবাড়ী উপজেলা প্রশাসনের কাছে আবেদন করেছিলাম। এ ব্যাপারে আমাদের সাথে একমত পোষণ করে সেটা বাস্তবায়ন করে দিয়েছে প্রশাসন। এ জন্য তাদের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞতা জানাই।

সাজিদের একমাত্র বড় বোন ফারজানা হক বলেন, আমার ভাই ছিল অত্যন্ত সাহসী ও ধার্মিক। ছাত্র হিসেবে ছিল মেধাবী। সে অন্যায়ের সাথে কখনো আপোস করতো না। সেটা হোক ঘরে বা বাইরে। প্রথম দিকে আমরা সাজিদকে আন্দোলনে যেতে বাধা দিলেও পরে আর দেইনি।

তিনি ঘটনার দিনের বর্ণনা দিয়ে বলেন, সেদিন ৪ আগস্ট সকালে যখন আমি অফিসে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হই তখন সাজিদ ঘুমিয়ে ছিল। ওই দিন আর সাজিদের সাথে সামনাসামনি কথা বলার সুযোগ হয়নি। তবে অফিসে বসে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ রাখতাম সব সময়। সে দিন সর্বশেষ বিকেল ৫টায় যখন ওকে ফোন দিয়ে ছিলাম তখন ফোনটি বন্ধ পেয়েছি। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে সাজিদের এক বন্ধু আমাকে ফোন দিয়ে জানায়, সাজিদের গুলি লেগেছে। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি আছে। এর পর আমরা সবাই ছুটে যাই সেখানে। সিএমএইচএ চিকিৎসাধীন অবস্থায় আমার ভাই এই দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়। এখনও আমার বিশ্বাস হয় না যে আমার ভাই বেঁচে নাই।

তিনি আরো বলেন, সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে ঢাকার কাফরুল থানায় ৭৩ জনকে আসামী করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করি। ভাই হত্যার বিচার পাব কি না জানি না। তবে যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন আমাদের পরিবারের আর কোন সদস্য যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। সরকার যেন আমাদের দিকে একটু খেয়াল রাখে।
সাজিদের বাবা জিয়াউল হক বলেন, বিমান বাহিনীর মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার হিসেবে চাকুরি করার সুবাদে আমাকে ঢাকায় থাকতে হতো। বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত। আমার দুই ছেলে-মেয়ের মধ্যে সাজিদ ছিল সবার ছোট। সে লেখাপড়ায় ছিল অত্যন্ত মেধাবী। ২০১৬ সালে বিএনএফ শাহীন স্কুল এন্ড কলেজ থেকে এসএসসি এবং ২০১৮ সাথে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে এইচএসসি অত্যন্ত সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হয়। সর্বশেষ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একাউন্টিং এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের মাস্টার্স শেষ সেমিস্টারের ছাত্র ছিলো সাজিদ। আমার ছেলে দেশের একজন যোগ্য নাগরিক হতে পারতো। সিএমএ পাস করে বের হলে হয়তো মাসিক দেড় থেকে দুই লাখ টাকা বেতনে চাকুরি করতে পারতো। আমি কখনই ভাবিনি সাজিদ এত কম বয়সে আমাদের ছেড়ে চলে যাবে। পুলিশের গুলি আমার ছেলের জীবন কেড়ে নিয়েছে। নৃশংস এ হত্যাকাণ্ড আমাদের সব স্বপ্ন ধূলিস্যাৎ করে দিয়েছে। সরকারের কাছে আমি আমার এক মাত্র ছেলে হত্যার বিচার চাই। আপনারা সবাই সাজিদের জন্য দোয়া করবেন আল্লাহ যেন ওকে ক্ষমা করে জান্নাতবাসী করেন।

সাজিদের মা নাজমা খাতুন লিপি বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শুরু থেকেই সক্রিয় ছিল আমার একমাত্র ছেলে সাজিদ। লেখা-পড়ার পাশাপাশি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতো। আর বলতো কবে লেখা পড়া শেষ হবে, ভাল একটা চাকুরি করবো। এরপর গ্রামের বাড়ির মসজিদটি পাকা করার কাজ ধরবো। সেই ইচ্ছা আর পূরণ করতে পারলো না সাজিদ। রাজপথের আন্দোলনে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে প্রথম ওকে বারণ করলেও আমাদের কথা শোনেনি। যেদিন আন্দোলনে যেতে দিতাম না, সেদিন সারাক্ষণ বাসায় থাকতো। কিন্তু আমি লক্ষ্য করতাম বাসায় থাকলেও ওর মন পড়ে থাকতো আন্দোলনে। তারপর আর আন্দোলনে যেতে বারণ করিনি। শুধু বলতাম আন্দোলনে যাচ্ছো ভাল কথা, নিজের প্রতি খেয়াল রেখো। ও আমাকে বলতো আল্লাহ ভরসা, দেখো মা আমার কিছু হবে না।

সাজিদের মা কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, সেদিন ৪ আগস্ট দুপুরে মসজিদ থেকে যোহরের নামাজ আদায় করে বাসায় আসে সাজিদ। বলে মা ভাত দাও, খেয়ে বের হতে হবে। ওকে আমি ভাত দেই। খাওয়া দাওয়া শেষ করে সাজিদ আন্দোলনে যাওয়ার জন্য রেডি হয়। আমি আর না করিনি। তখন আমি বলি আন্দোলনে যাচ্ছো দুই রাকাত নফল নাম পড়ে যাও। ও আমার কথামতো বাসায় দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করে। যাওয়ার সময় ওকে আয়াতুলকুসরি পড়ে ফুঁ দিয়ে দেই। যাওয়ার সময় সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলে আমার জন্য দোয়া করো মা, আমার কিছুই হবে না। এটাই ছিল আমার সাথে ছেলের শেষ কথা। ছেলেকে তো হারিয়েছি, তাকে আর পাবো না। এ ছেলেই ছিল আমাদের একমাত্র অবলম্বন। সাজিদের বাবা চাকুরি থেকে অবসর নিয়েছে। তারও বয়স হচ্ছে। সরকার যেন আমাদের পরিবারের পাশে থাকে সেটাই আমাদের এক মাত্র চাওয়া।

তিনি আরো বলেন, আগে আমার বড় মেয়ে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করতো। এ ঘটনার পর সরকার আমার মেয়ে ফারজানা হককে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে জুনিয়র প্রোগ্রামার হিসেবে চাকুরির ব্যবস্থা করে দিয়েছে। আর্থিক সহযোগিতা পেয়েছেন কিনা এ প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন এর পক্ষ থেকে ৫ লাখ টাকা, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে ২ লক্ষ টাকা, কেন্দ্রীয় বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ফকির মাহবুব আনাম স্বপন (স্বপন ফকির) ৫০ হাজার টাকা, উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৪০ হাজার টাকা অনুদান পেয়েছেন তারা।

ধনবাড়ী উপজেলার নির্বাহী অফিসার মো: আবু সাঈদ বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ধনবাড়ি উপজেলার ২ জন শহিদ এবং মোট ৭ জন আহত হয়েছে। আমরা প্রত্যেককে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২৫ হাজার টাকা করে অনুদান দিয়েছি। সাজিদ ধনবাড়ী উপজেলার গর্ব। সে দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে। সাজিদ আমাদেরই অকুতোভয় বীর সন্তান। আমরা কেউই তাকে এইভাবে হারিয়ে গর্বিত হতে চাইনি। তবে সে যেন পরপারের জীবনেও ভালো থাকে তার জন্য দোয়া করি।

জেলা প্রশাসক শরিফা হক বাসসকে বলেন, আজ শহিদ সাজিদ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তার স্মৃতি রয়ে গেছে। শহিদ ইকরামুল হক সাজিদের স্মৃতি ধরে রাখতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তার নামে নল্লা বাজার থেকে কদমতলী রাস্তার নামকরণ করে দেওয়া হয়েছে ‘সাজিদ সড়ক’।

তিনি বলেন, সাজিদের পরিবার যে কোন প্রয়োজনে আমাদের কাছে আসলে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করব তাদের পাশে থাকার।

সূত্র : বাসস


আরো সংবাদ



premium cement