আব্বা, আরজু ও আয়শাকে দেখে রেখো : শহীদ নয়ন
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৫:৪১
‘আব্বা আমার গুলি লেগেছে। আমি মনে হয় না আর বাঁচবো। তুমি আরজু ও আয়শারে দেখে রেখো। ওদের তুমি নিজের কাছে রেখো। তুমি ছাড়া ওদের আর কেউ নাই’- এটাই ছিল শহীদ নয়নের বাবার সাথে তার শেষ কথা।
রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর রসুলপুরের মেম্বার গলি এলাকার ভাড়া বাসায় এই প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে এ কথা বলেছেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদ মো: নয়নের বাবা নুরুল ইসলাম (৬১)।
গত ৫ আগস্ট সকাল ৮টার দিকে রাজধানীর নবাবগঞ্জ বড় মসজিদের ঢালে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন নয়ন (২৬)।
কান্নাজড়িত কন্ঠে সন্তানের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে নুরুল ইসলাম বলেন, ‘সকাল সোয়া ৮টার দিকে আমার কাছে নয়নের মোবাইল ফোন থেকে একটা কল আসে। ওপাশ থেকে বলা হয়, ‘এ ফোনের মালিক আপনার কে হয়? আমি বলি, সে আমার বড় ছেলে। তখন ওদিক থেকে জবাব আসে, নবাবগঞ্জ বড় মসজিদের ঢালে সে গুলি খেয়ে পড়ে আছে। তখন আমরা সেখানে গিয়ে রিকশায় করে নয়নকে ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে যাই। যাওয়ার সময় নয়ন আমাকে বলে, আব্বা আমি আর বাঁচবো না। আমাকে পুলিশ অনেকগুলো গুলি করেছে। আরজু ও আয়শাকে তুমি দেখে রেখো। ওদের তুমি তোমার কাছে রেখো।’ এই বলে সে মেয়ে আয়শার কপালে একটা চুমু খায়। এইটা ছিল আমার ছেলেটার শেষ কথা। এরপরে নয়ন আর কোনো কথা বলে নাই।’
নয়ন ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিত ছিলেন। স্ত্রী আরজু বেগম (২০) ও চার বছর বয়সী মেয়ে আয়শা মনিকে নিয়ে তার ছোট্ট একটি সংসার ছিল। নয়ন নিউমার্কেট এলাকার গাউছিয়া মার্কেটে লেবারের কাজ করতেন। তার গ্রামের বাড়ি ভোলা জেলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার মুলাইপত্তন গ্রামে। নয়নের বাবা নুরুল ইসলাম কখনো সেলাইয়ের কাজ করেন, আবার কখনো রিকশা চালান। মা মমতাজ বেগম (৫৯) গৃহিণী। নয়নের দু’টি ভাই রয়েছে। মেজ ভাই হাসনাইন (২৪) ও ছোট ভাই মহসিন (২৩)। দুই ভাইও সেলাইয়ের কাজের ফাঁকে রিকশা চালান, লেবারের কাজও করেন।
নয়নের মেয়ে আয়শা মনি বলে, ‘আমার বাবাকে পুলিশ গুলি করেছে। বাবা বিদেশ চলে গেছে, পরে আসবে বলেছে। গুলি লাগার পরে আমি আর আম্মু যখন হাসপাতালে যাই, তখন আব্বু আমাকে একটা চুমু দিয়েছিল।’
এদিকে শহীদ হওয়ার পরে তার স্ত্রী আরজু বেগমকে ছোট ছেলে মহসিনের সাথে বিয়ে দিয়েছেন নয়নের বাবা নুরুল ইসলাম।
এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘নয়ন যেহেতু আমাকে বলে গেছে, আরজু ও আয়শাকে তোমার কাছে রেখো। তাই আমি আমার ছোট ছেলে মহসিনের সাথে আরজুর বিয়ে দিয়েছি। নাতনির মুখের দিকে তাকিয়ে এই কাজ করেছি। আমার তিনটা ছেলে। কোনো মেয়ে নাই, তাই ওকে মেয়ে মনে করে ছোট ছেলের সাথে বিয়ে দিয়েছি।’
এ বিষয়ে নয়নের ভাই মহসিন বলেন, ‘পরিবারের সবাই আমাকে বিয়ের বিষয়ে বলেছে। আমি রাজি হয়েছি। কয়েক সপ্তাহ আগে বিয়ে করেছি।’
নয়ন গত ৫ আগস্ট গুলিবিদ্ধ হন। কিন্তু তিনি মারা গেছেন ৮ আগস্ট বিকেল ৫টার দিকে। গত ৯ আগস্ট সকাল ৯টার দিকে জানাজা শেষে ভোলার বোরহানউদ্দিনের হাফিজ ইব্রাহিম মিয়া কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
ওই দিনের ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দেন নুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘ঘটনার সময় আশপাশে তেমন কেউ ছিলেন না। এক চায়ের দোকানদার জানায়, পুলিশ নয়নকে পেছন থেকে গুলি করেছে। এতে নয়নের বুকে, ঘাড়ে ও পিঠের চার জায়গায় চারটা গুলি লাগে। সাথে সাথে নয়ন রাস্তায় পড়ে যায়।’
তিনি জানান, ‘ওই দিন সকালে নামাজ পড়ে কাজের জন্য বাসা থেকে বের হয়েছিল নয়ন। সকাল ৮টার দিকে তার শরীরে গুলি লাগে।’
তিনি বলেন, ‘সকাল সাড়ে ৮টার দিকে নয়নের ফোন থেকে আমার কাছে কল আসে। কল রিসিভ করলে ওপাশ থেকে বলে, এই ফোন যার সে আপনার কে হয়? আমি কি হয়েছে জানতে চাইলে বলে, নবাবগঞ্জ ঢালে তার গুলি লেগেছে। তারপরে সে কি বলেছে আমি তা আর শুনতে পাইনি।’
নয়নের পরিবার ঘটনাস্থল থেকে তাকে রিকশায় করে ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে যায়।
সেখানকার পরিস্থিতির কথা বর্ণনা করতে গিয়ে তার বাবা বলেন, ‘হাসপাতালে গিয়ে দেখি কোনো ডাক্তার নাই, নার্স নাই। শুধু রোগী আর রোগী। নয়নকে সে সময় ভর্তি না করে হাসপাতালের বারান্দায় সারাদিন ফেলে রাখা হয়। ফলে ওর প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। আগে থেকেই যদি চিকিৎসা শুরু করা যেত তাহলে ছেলেটা আমার বাঁচতো।’
নুরুল ইসলাম বলেন, ‘অনেক অনুরোধ করার পর রাত ১২টার পরে নয়নকে ভর্তি করানো হয়। তখন আর তার জ্ঞান ছিল না। পরের দিন নয়নের অপারেশন করে গুলি বের করা হয়। আমরা নয়নকে ছয় ব্যাগ রক্ত দেই। ৮ তারিখ দুপুরের দিকে ওর অবস্থার অবনতি হয়। তখন চিকিৎসকরা বলেন, নয়নের জন্য আইসিইউ লাগবে। কিন্তু ঢাকা মেডিক্যালে কোনো আইসিইউ বেড ওই সময় খালি ছিল না। তখন আমরা সাড়ে ৩টার দিকে নয়নকে ধানমন্ডির ম্যাক্স হাসপাতালে নিয়ে যাই এবং ওখানে ভর্তি করি। কিন্তু চিকিৎসা শুরু করার আগেই বিকেল ৫টার দিকে নয়নের মৃত্যু হয়।’
কামরাঙ্গীচরের রসুলবাগে নয়নের বাসায় গিয়ে দেখা গেছে, দ্বিতীয় তলায় একটি বাসায় ভাড়া থাকে নয়নের পরিবারের সবাই। ছোট তিনটা রুম। বাসায় আলো-বাতাস প্রবেশের তেমন কোনো পথ নেই। দিনের বেলায়ও বাসায় ঢুকতে হয় মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে। বাসার অবস্থা দেখলেই বোঝা যায় কী নিদারুণ কষ্টে সংসার চলে নয়নের পরিবারের।
সরকারি সহযোগিতা পেয়েছেন কি না এমন প্রশ্নে ক্ষোভ প্রকাশ করে নয়নের বাবা বলেন, ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী শুধু এক লাখ টাকা দিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে আমি কোনো সহযোগিতা পাইনি। শুধু বলে দেয়া হবে, কিন্তু কবে দেয়া হবে তা কেউ বলে না। আমি গরীব মানুষ। ধারদেনা করে চিকিৎসা করতে হয়েছে। গত ৮ তারিখ যখন ওকে ম্যাক্স হাসপাতালের আইসিইউতে নিয়ে যাই তখন ৪২ হাজার টাকার ওষুধ কিনতে হয়েছে। আমার এখনো লাখ টাকার বেশি ঋণ। আমার বয়স হয়েছে। তেমন কোনো কাজ করতে পারি না। আমি ঋণ পরিশোধ করবো নাকি সবাই মিলে খেয়ে পরে বাঁচবো?’
নয়নের স্ত্রী আরজু বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী খুবই ভালো মানুষ ছিলেন। নামাজ পড়তেন। আমাদের সংসারে অভাব থাকলেও সবাই মিলেমিশে থাকতাম। একটু ভালোভাবে চলার জন্য আমি নিজেও সেলাইয়ের কাজ করি। কিন্তু আল্লাহ আমার কপালে সুখ লিখে রাখেননি, তাই স্বামীকে অসময়ে হারাতে হয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘মেয়েটা সব সময় বলে আব্বু বিদেশে গেছে, ফিরে আসবে। নয়ন মারা যাওয়ার আগে আমাকে ও মেয়েকে আমার শ্বশুরের হাতে তুলে দিয়ে গেছে। বলে গেছে, ‘ওদের দেখে রেখো’। তাই আব্বার সিদ্ধান্তে আমি রাজি হয়েছি। আমার বাবার বাড়ির অবস্থাও ভালো না। আমি মেয়েকে নিয়ে কী করতাম। আমাদের জন্য, আমার মেয়েটার জন্য দোয়া করবেন।’
সরকারের প্রতি নয়নের বাবা আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘যে দেশের জন্য আমার ছেলে শহীদ হয়েছে, তার মেয়ের দিকে তাকিয়ে যেন তার পরিবারের জন্য কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়। যাতে আমরা সবাই খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে পারি।’
সূত্র : বাসস
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা