এখনো স্বজনদের খুঁজে বেড়াচ্ছেন তারা, কমিশন কী বলছে
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৭:৪১
প্রায় এক যুগ ধরে নিখোঁজ ঢাকার বংশালের ছাত্রদল নেতা মাহফুজুর রহমান সোহেল। তার অপেক্ষায় দিন গুনে চলেছেন স্ত্রী শিল্পী রহমান।
২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে শাহবাগ থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেয়ার পর থেকে আর কোনো খবর পাওয়া যায়নি সোহেলের।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মধ্যে দিয়ে স্বামীর সন্ধান মিলবে- এমনটা আশা করেছিলেন শিল্পী রহমান। অন্তর্বর্তী সরকারের চার মাসের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও নিখোঁজ স্বামীর সন্ধান না পেয়ে খানিকটা হতাশা ভর করেছে শিল্পী ও তার পরিবারের ওপর। শিল্পী রহমানের প্রশ্ন, আর কত অপেক্ষা করতে হবে তাদের।
‘এখন আমরা পাবো না কেন? আর কত অপেক্ষা করলে আমার স্বামীর খোঁজ পাবো?’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন শিল্পী রহমান।
’আয়নাঘর’ থেকে কয়েকজন ফেরত আসায় গুমের শিকার অনেক পরিবার আশাবাদী হয়ে ওঠে। ২০১৩ সাল থেকে নিখোঁজ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র আল-আমিনের স্বজনরা সেরকমই বলছিলেন বিবিসি বাংলার কাছে।
বসুন্ধরা এলাকা থেকে র্যাব পরিচয়ে আল-আমিনকে তুলে নেয়ার পর থেকে অপেক্ষায় আছেন তার মা-বাবা ও ভাই-বোনেরা। সরকার পতনের চার মাস পরে গুম কমিশনের প্রতিবেদনের প্রসঙ্গ টেনে নতুন করে হতাশার সুর তাদের কথায়।
কমিশনের প্রতিবেদনে গুমের শিকার অনেকের সাথে বর্বর হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনার তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু কোনো পরিবারই সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ ছাড়া তাদের স্বজন আর বেঁচে নেই, সেটি মানতে চান না।
আল-আমিনের ভাই রুহুল আমিন বলেন, ‘আমাকে সবাই ফোন দেয়, কী রে আলামিনের কোনো খোঁজ হয় না? যদি মারা যায় আমাদের লাশ দেখাক। কবরস্থান দেখাক। আমার ভাইকে কোন কবরস্থানে কবর দিছে ওইটা দেখতে চাই। হাড্ডিগুলা চাই। তাহলে বিশ্বাস করব, আমার ভাই মারা গেছে।’
অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত গুম সম্পর্কিত কমিশন সম্প্রতি তাদের প্রতিবেদন দিয়েছে, যার আংশিক প্রকাশ করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে আওয়ামী লীগ সরকার আমলে সরকারি বাহিনী কিভাবে গুম করে অত্যাচার নির্যাতন এবং হত্যা করেছে তার বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে সুনির্দিষ্ট করে কোনো নিখোঁজ ব্যক্তির বিষয়ে বলা হয়নি।
গুমের শিকার পরিবারগুলোর সংগঠন ‘মায়ের ডাক’-এর সংগঠক সানজিদা ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেন, এই রিপোর্টের পর ভিকটিম পরিবারের অনেকেই ফোন করছেন, জানতে চাইছেন। কিন্তু সুনির্দিষ্ট কিছু না থাকায় কাউকে কিছু বলতে পারছেন না।
তিনি বলেন, ‘এই রিপোর্টটা নিয়ে কোনো স্পেসিফিক তথ্য কোনো ফ্যামিলিকে দিতে পারতেছি না। প্লাস তাদের যে রোডম্যাপটা জানালো যে একবছর মেয়াদি লংটার্মে কাজ করবেন। কিন্তু প্রায়োরিটিটা কী হওয়া উচিত? প্রায়োরিটিটা তো আমার মনে হয় আরো ডিফরেন্ট হওয়া উচিত।’
‘স্পেসিফিক্যালি পরিবারকে জানানো যে তাদের স্বজনদের আসলে কী করা হয়েছে। তাদের স্বজন কই, কারা নিয়ে গিয়েছিল, কোন সিক্রেট ডিটেনশন সেলে ছিল, তাদের সাথে কী করা হয়েছে- এই জিনিসটা আমার মনে হয় খুবই ম্যান্ডেটরি এবং সেটার জন্যেই কিন্তু আমাদের আন্দোলন।’
বছরের পর বছর নিখোঁজ রয়েছেন এমন শত শত পরিবার অপেক্ষায় দিন গুনছে। গুম কমিশনের কার্যক্রম নিয়ে সানজিদা ইসলাম বলেন, তাদের প্রথম দায়িত্বটা ছিল চিহ্নিত করে পরিবারগুলোকে জানানো। পুরো সত্যটা সামনে আনতে হবে।
কমিশনের পুরো রিপোর্ট মায়ের ডাক সংগঠনের সাথে শেয়ার করা হয়নি বলেও উল্লেখ করেন সানজিদা ইসলাম।
তিনি বলেন, ‘ভিকটিমরা তো প্রতিদিন ফোন করছে এবং সাফার করছে। আসলে কী হচ্ছে? আপনি একটা সামারি করলেন, আবার এক বছরের জন্য সময় চাচ্ছেন। তাহলে কি ফ্যামিলিগুলো বসে থাকবে? এই ১২ বছর বসে থাকাটা এনাফ হয় নাই? আরো প্রতিদিন যাইতে হবে ট্রমার মধ্যে দিয়ে এবং জানার জন্য এখনো ওয়েট করতে হবে। আমরা কি এই প্রক্রিয়াধীন কমিশন চাইছিলাম কি না?’
নিখোঁজদের সুনির্দিষ্ট তথ্য পেতে বিলম্ব কেন
গুম কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ১৫ বছরে নিখোঁজ ৭৩ শতাংশ ভিকটিমের খোঁজ মিলেছে। এখনো ২৭ শতাংশের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি।
মানবাধিকারকর্মী এবং গুম কমিশনের অন্যতম সদস্য নূর খান লিটন বলছেন, এই নিখোঁজদের সন্ধানে তদন্ত অব্যাহত আছে কমিশনের। এখনো গুমের শিকার কমপক্ষে দুই শ’ মানুষের কোনো হদিস নেই বলে উল্লেখ করেন তিনি।
নূর খান লিটন বলেন, ‘আমাদের অনুসন্ধান কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছি এবং চেষ্টা করছি যে তাদের অন্ততপক্ষে শেষ পরিণতিটা জানার। তারা বেঁচে আছেন, না কি হত্যা করা হয়েছে বা তাদের ভারতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে, আমরা এই শেষ অবস্থান সম্পর্কে জানার চেষ্টা করছি। এটা সম্পর্কে বলা খুব কঠিন। আমি একটা লাশ না পাওয়া পর্যন্ত বা কারো স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি না পাওয়া পর্যন্ত কিন্তু বলতে পারছি না যে ওই ব্যক্তিটি নেই।’
কমিশনের প্রতিবেদনে গুমের শিকার ব্যক্তিদের নির্যাতন ও হত্যার ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও জিজ্ঞাসাবাদ ও তদন্তের মাধ্যমে কমিশন গুমের পর তাদের পরিণতি সম্পর্কে এসব তথ্য জেনেছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
মানবাধিকারকর্মী নূর খান বলেন, ‘কবর কতজনকে দেয়া হয়েছে জানি না। তবে অনেককে বুড়িগঙ্গায় ফেলা হয়েছে, বিভিন্ন সেতুর ওপর থেকে হত্যা করে ফেলে দেয়া হয়েছে, বস্তাবন্দি করে ফেলা হয়েছে, হত্যা করে ট্রেনের তলে ফেলা হয়েছে যাতে লাশ বিকৃত হয়ে যায়। এই ধরনের অপরাধ কিন্তু এই খুনি বাহিনী করেছে।’
এখনো নিখোঁজ ব্যক্তিদের সুনির্দিষ্ট তথ্য জানতে আরো কতদিন সময় লাগবে সেটি স্পষ্ট করে বলতে পারেননি নূর খান লিটন। প্রত্যেকের আলাদা আলাদা তথ্য বের করা কাজটি ‘জটিল এবং কঠিন’ বলে উল্লেখ করেন তিনি।
‘রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তি যেখানে সম্পৃক্ত, বাহিনীর প্রধানদের অনুমোদন নিয়ে যখন নিচের দিকে ঘটায় তখন এটা কতটা গোপনীয়তা অবলম্বন করতে পারে! পুলিশ উঠিয়েছে, পরবর্তীতে র্যাবের হাতে দিয়েছে, জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। পরবর্তীতে ডিজিএফআইয়ের কাছে হস্তান্তর করেছে, জিজ্ঞাসাবাদ করেছে, টর্চার করেছে। মানে এরকম একটা সিস্টেমেটিক ওয়েতে তারা এই কাজগুলো করেছে।’
গুম করে ভারতে পাঠিয়ে দেয়ার ঘটনাও রয়েছে উল্লেখ করেন নূর খান বলেন, ‘সালাউদ্দিন সাহেবের কেস, সুখরঞ্জন বালির কেস তো আমরা জানি। এরকম আরো কিছু ঘটনা জেনেছি যে এখান থেকে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে, তারপর তাকে নির্যাতন করা হয়েছে, নিপীড়ন করেছে। জিজ্ঞাসাবাদের নামে দীর্ঘদিন তাদের এই গোপন সেলে রেখেছে। তারপর বাংলাদেশ থেকে আমাদের ফোর্স বর্ডারে হস্তান্তর করেছে ভারতীয় কোনো সংস্থার হাতে। টিএফআই নামে এরকম একটা সংস্থার নামও আমরা শুনেছি। কারো কারো নামে অবৈধ অনুপ্রবেশের মামলা হয়েছে। কারো কারো জঙ্গি তকমা লাগিয়ে বিচার চলছে ভারতের আদালতে।’
এসব গুম খুনের সাথে জড়িত কর্মকর্তারা পাওয়ারফুল এবং এখনো বিভিন্ন পদে বহাল রয়েছেন। তবে গুমের প্রতিটি ঘটনার হদিস বের করতে কমিশন বদ্ধপরিকর বলে জানান তিনি।
নূর খান বলেন, ‘দেখেন এইটা বের করার জন্য যে সময়টা দরকার, আপনাদের কিন্তু সেই সময়টা দিতে হবে। কারণ কেউ তো দেবে না স্বীকারোক্তি যে হ্যাঁ আমি তাকে উঠিয়েছি এবং তারপর আমি তাকে গুলি করে মেরেছি। এ কথাটা এই মুহূর্ত পর্যন্ত কেউ বলার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। আমরা কিছু কেস আছে যেগুলো খুব স্পেসিফিক ধরে ধরে এগুচ্ছি এবং আমরা নিশ্চিত, আমরা সফল হবো।’
সানজিদা ইসলাম গুমের শিকার পরিবারগুলোর দাবি তুলে ধরে বলেন, সরকার পরিবর্তনের পর এখন গোপন সেলগুলোর সব প্রকাশ্যে আনতে হবে। এরকম যেন আর কারো সাথে না হয়, সেজন্য এগুলো ভেঙে ফেলতে হবে। তথ্য প্রমাণসহ দায়ীদের বিচার করতে হবে।
তিনি বলেন, ‘মায়ের ডাক ১২ বছর ধরে আন্দোলন করে এসেছে, এখনো করতে হচ্ছে। এখনো বলতে হচ্ছে, তথ্যটা আপনারা দেন না কেন। আগের সরকারকে বলেছি, এখনো আবার বলতে হচ্ছে।‘
সূত্র : বিবিসি