শহীদ দেলোয়ারের কবর ছুঁয়ে প্রতিদিনই আর্তবিলাপ করেন মা
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:০৮
‘ও-রে আমার বা-জান, তুই আমারে ছাইরা কই গেলি। কত্তদিন তোরে আমি দেহি না। আমি তোর দু:খিনী মা। তুই ফিইরা আয় বা-জান। আমি তোরে নিজ আতে ভাত মাখায়া খাওয়ামু। ওরা কয় তোরে নাকি কারা মাইরা হালাইছে। তুই নাই, এইডা মিত্যা কতা।’
হৃদয়বিদারক এমন আহাজারি করে ছেলে দেলোয়ারের কবর ছুঁয়ে প্রতিদিনই আর্তবিলাপ করে আঁচল ভিজাচ্ছেন মা জিন্নাতুননেছা। ছেলেহারা মায়ের এমন আহাজারিতে শোকে নিস্তব্ধ হয়ে আছে কাচিয়া গ্রামের জনপদ।
তথ্যমতে, গত ২১ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে ভোলা সদর উপজেলার কাচিয়া ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মো: দেলোয়ার হোসেন (৩৫) নিহত হন। দেলোয়ারের মৃত্যুর প্রায় আড়াই মাস চলে গেলেও এখনো কান্না থামেনি ৬৯ বছর বয়সী তার বৃদ্ধা মা জিন্নাতুন নেছার। বাড়ির পাশের ছেলের কবরের পাশে ছুটে গিয়ে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। পাঁচ ছেলের মধ্যে দেলোয়ার আর্থিকভাবে স্বচ্ছল থাকায় বৃদ্ধ বয়সে ঢাকায় ছেলের কাছেই থাকতেন স্বামীহারা জিন্নাতুন নেছা। খাওয়া-দাওয়া ও চিকিৎসা থেকে শুরু করে মায়ের পুরো খরচ চালাতেন আদরের ছেলে দেলোয়ার। কিন্তু পুলিশের গুলিতে দেলোয়ার নিহত হওয়ায় এখন ভোলায় দিনমজুর অপর ছেলে আনোয়ারের কাছে থাকেন তিনি। অর্থের অভাবে কোনো মতে তিনবেলা ভাত খেতে পারলেও নিয়মিত ওষুধ জোটে না তার।
এদিকে, গত ১৯ জুলাই মিরপুর ১০ নম্বর পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত হলে দেলোয়ারকে শ্যামলী সিটি কেয়ার জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করানো হয়। সেখানে তার পেটে অস্ত্রোপাচার করা হয়। এরপরও তাকে বাঁচানো যায়নি। তিনদিন হাসপাতালের আইসিইউতে থেকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন দেলোয়ার। চিকিৎসায় প্রায় চার লাখ টাকার বেশি খরচ হয়ে যায়। তবু তাকে বাঁচানো যায়নি। দেলোয়ার নেই। কিন্তু পরিবারের কাঁধে তার জন্যে ব্যয় করা প্রায় পাঁচ লাখ টাকার ঋণের বোঝা রয়ে গেছে। এ নিয়েই দুশ্চিন্তায় রয়েছেন দেলোয়ারের স্ত্রী লিজা বেগম।
স্ত্রী লিজা বেগম বলেন, ‘তার স্বামী গত ১৯ আগস্ট বিকেল ৪টার দিকে একটি কাজে ঢাকার মিরপুর-১০ নম্বরে যান। পরে সেখানকার গোল চত্বরে শিক্ষার্থীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষের মধ্যে পড়েন। এ অবস্থায় তার তলপেটে তিনটি গুলি বিদ্ধ হলে তিনি গুরুতর আহত হন। একপর্যায়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। পথচারীরা তাকে উদ্ধার করে একে একে তিনটি হাসপাতালে নিলেও কোথাও কেউ তাকে চিকিৎসা দিতে রাজি হননি। এতে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয় তার। পরে তাকে শ্যামলী সিটি কেয়ার জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করানো হয়। ওই দিন রাতেই তার পেটে অস্ত্রোপচার করা হয়। কিন্তু ২১ জুলাই সকাল সাড়ে ৭টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। পরে তার লাশ ওই দিন সন্ধ্যার পর গ্রামের বাড়িতে এনে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।’
লিজা আরো বলেন, ‘তার স্বামীর হাসপাতালে চিকিৎসা, ওষুধ, অপারেশন, লাশ অ্যাম্বুলেন্সে করে ভোলায় আনাসহ সব মিলিয়ে প্রায় চার লাখ টাকার মতো খরচ হয়েছে। পুরো টাকাই ধার দেনা করে সংগ্রহ করা হয়েছিল। এখন ওই টাকা কিভাবে পরিশোধ করবেন সেটি নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। ইতোমধ্যে তিনি দেলোয়ারের ঢাকার ফার্নিচারের দোকানটি ছেড়ে দিয়েছেন। বর্তমানে তিনি ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলে রাব্বি হাসান (১৩), ছয় বছরের মেয়ে হাসনুর ও ১৮ মাস বয়সী ছেলে হোসাইনকে নিয়ে আর্থিক সঙ্কটে রয়েছেন।’
তিনি জানান, জামায়াতে ইসলামী থেকে তাদের মাত্র এক লাখ টাকা অনুদান দেয়া হয়েছে। এছাড়াও আর সরকারি বা বেসরকারি কোনো অনুদান পাননি তিনি। তাই সরকারিভাবে দেলোয়ারের জন্যে ব্যয় হওয়া ঋণ পরিশোধ ও সংসার চালানোর মতো ব্যবস্থার দাবি জানান স্বামীহারা লিজা বেগম।
ওই দিকে গণমাধ্যমকর্মী আসার সাথে সাথেই আর্তচিৎকার দিয়ে দেলোয়ারের মা জিন্নাতুন নেছা বলেন, তার পাঁচ ছেলের মধ্যে দেলোয়ার ছিল চার নম্বর। প্রায় ২৬ বছর আগে দেলোয়ারের বাবা সুলতান আহমেদ মাল আরেকটি বিয়ে করেন। তাই তিনি শ্বশুর বাড়িতে থেকে অনেক সংগ্রাম করে ছেলেদের লালন-পালন করেছেন। একটু বড় হওয়ার পর দেলোয়ার ঢাকায় গিয়ে ফার্নিচারের দোকানে কর্মচারীর কাজ নেয়। গত কয়েক বছর আগে মিরপুর-১২ নম্বরে ইস্টার্ণ হাউজিং এলাকায় নিজেই একটি ছোটখাটো ফার্নিচারের দোকান দেয় এবং স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে সেখানে বাসা ভাড়া করে থাকতেন। তিনিও সেখানে ছেলের সাথেই থাকতেন। ছেলেদের মধ্যে দেলোয়ারই অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল ছিল। অন্য ছেলেরা দিনমজুর, জেলে, কাঠমিস্ত্রি ও কৃষি কাজ করে কোনো মতে সংসার চালায়। তাই দেলোয়ারই তার দেখভাল করতেন। তার শরীরে নানাবিধ রোগে বাসা বেঁধেছে। ছেলে মারা যাওয়ায় ওষুধ কিনেও খেতে পারছেন না। তার আদরের ছেলেকে কেন হত্যা করলো? এখন কে তাকে ওষুধ কিনে দিবে, কার কাছে থাকবেন তিনি, এসব কথা বলেই অঝোরে কেঁদে ওঠেন বৃদ্ধা জিন্নাতুন নেছা।
তিনি বলেন, ‘আমি মৃত্যুর আগে আমার ছেলে হত্যার বিচার দেখে যেতে চাই।’
সূত্র : বাসস