৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

সন্তান জন্মের সময় স্ত্রীর পাশে থাকা হবে না আহত আনোয়ারের

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আহত আনোয়ারে - ছবি : বাসস

আর দেড় থেকে দুই মাস পর ভূমিষ্ঠ হবে বহু কাঙ্ক্ষিত সন্তান। এসে দেখবে নতুন পৃথিবী। নতুন দেশ। কিন্তু এমন খুশির সময় স্ত্রী-সন্তানের পাশে থাকা হবে না আনোয়ার হোসেনের। এমনকি এই জীবনে সুস্থ হয়ে চলাফেরা করা নিয়েও সংশয় তার।

জুলাই-আগস্টের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে পুলিশের গুলিতে আহত হন আনোয়ার হোসেন। এখন তিনি রাজধানীর জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটে চিকিৎসাধীন।

সম্প্রতি রাজধানীর জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটের শয্যায় বসে কথা হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে আহত আনোয়ার হোসেনের।

সরেজমিনে হাসপাতালে দেখা গেছে, আনোয়ারের মাথায় পানি দিচ্ছেন তার মা। আর তার স্ত্রী কাপড় ভিজিয়ে গা মুছে দিচ্ছেন।

অন্য রোগীরা জানায়, ওই ওয়ার্ডে ভর্তি গুরুতর তিনজনের মধ্যে আনোয়ারের অবস্থা বেশি খারাপ।

১৯৯৩ সালের ২০ নভেম্বর আনোয়ার হোসেন রাজবাড়ী জেলার পাংশা উপজেলার কলিমোহর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মকবুল হোসাইন মারা গেছেন অনেক আগেই। মা আনোয়ারা বেগম (৬০) জীবিত থাকলেও বয়সের কারণে অনেকটাই অসুস্থ। আনোয়ার থাকেন রাজধানীর বাড্ডার শাহজাদপুর এলাকায়। দুই বছর আগে বিয়ে করেছেন। স্ত্রী আকলীমা আক্তার (২২) আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তিনি মানিকগঞ্জ নার্সিং কলেজে বিএসসি করছেন। সেখানেই হোস্টেলে থাকতেন। কিন্তু স্বামী আহত হওয়ার পর থেকে হাসপাতালেই দিন কাটছে তার। আনোয়ারের একটি বোন রয়েছে। তারও বিয়ে হয়েছে অনেক আগেই। মা থাকতেন গ্রামে। আহত হওয়ার পর তিনিও চলে এসেছেন ছেলের কাছে।

আনোয়ার সোনারগাঁও ইউনিভার্সিটিতে বিএসসি ইন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে লেখাপড়া করেন। পাশাপাশি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে খন্ডকালীন চাকরি করতেন। জুলাই মাসের মাঝামাঝিতে আন্দোলনে যুক্ত হন। ১৯ জুলাই শাহজাদপুর কনফিডেন্স টাওয়ারের সামনে তিনি গুলিবিদ্ধ হন।

আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আগামী দেড় থেকে দুই মাস পর ভূমিষ্ঠ হবে আমাদের কাঙ্ক্ষিত সন্তান। এসে দেখবে নতুন পৃথিবী। নতুন দেশ। কিন্তু এমন খুশির সময় স্ত্রী-সন্তানের পাশে আমার থাকা হবে না। ভূমিষ্ঠের পর কোলেও নিতে পারবো না নিজের সন্তানকে। কারণ আমার শরীরের নিচের অংশ অবশ হয়ে গেছে। হাঁটা-চলা তো দূরের কথা, বসারও শক্তি নেই আমার। এমনকি প্রস্রাব বা টয়লেটের বেগ এলে তা বলতেও পারি না।’

তিনি বলেন, ‘দেখেন ভাই স্ত্রী প্রায় আট মাসের অন্তঃস্বত্ত্বা। কোথায় আমি তার একটু সেবা করবো। কিন্তু আমি এখন নিজেই চলতে পারি না। সেই আমার পাশে থেকে এই অবস্থায় আমার সেবা করছে।’

ওই দিনের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘ওই দিন দুপুর ২টার দিকে আন্দোলনে যোগ দেই। সেখানে তিন শতাধিক ছাত্র-জনতা উপস্থিত ছিল। পুলিশ-বিজিবি গুলি চালাচ্ছিল। মাথার ওপর ঘুরছিল হেলিকপ্টার। আবার বিভিন্ন দিকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। আমেরিকান দূতাবাসের সামনে থেকে গুলি চালাচ্ছিল পুলিশ-বিজিবি। আমি ছিলাম কনফিডেন্স টাওয়ারের সামনে। পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট মারতে মারতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে রওনা দেই বাসার দিকে। আর ঠিক তখনই গুলি এসে লাগে আমার বুকে। বেলা তখন সাড়ে ৩টা। বুকের বামপাশে গুলি ঢুকে পিঠের ডান পাশ দিয়ে বের হয়ে যায়।’

তিনি বলেন, ‘গুলি লাগার পর জ্ঞান ছিল আমার। সাথে যারা ছিলেন, তারা আমাকে ধরে নিয়ে যান এমডেজ হাসপাতালে। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে পাঠিয়ে দেয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে ভর্তি করা হয়। সিট না থাকায় শুইয়ে রাখে ফ্লোরে। ডাক্তার আসছিলেন না। চিকিৎসা হচ্ছিল না। পরে ওই রাতেই আমাকে মামা-মামি নিয়ে যান এভারকেয়ার হাসপাতালে।’

আনোয়ার হোসেন আরো বলেন, ‘এভারকেয়ারে ১৮ দিন থাকার পর ব্যয় বহন করতে না পারায় আমাকে বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। এভারকেয়ারে চিকিৎসায় ব্যয় হয় ছয় লাখ ৭৯ হাজার টাকা। সেখানে অপারেশন করে ফুসফুসে জমা পানি বের করা হয়। এভারকেয়ার থেকে আসার সময় সেখানকার চিকিৎসকরা ব্যায়াম করার পরামর্শ দেন। কিন্তু আমার কোনো অনুভূতিই নেই। ব্যায়াম করবো কিভাবে?

তিনি আরো বলেন, ‘বাসায় পাঁচ দিন থাকার পর গত ১১ আগস্ট ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ফিজিওথেরাপি নেয়ার জন্য ভর্তি হই। কিন্তু কোনো উন্নতি হয়নি। এরই মধ্যে শুয়ে থাকতে থাকতে পিঠে একটি ঘা হয়। ঘার চিকিৎসার জন্য গত ৫ সেপ্টেম্বর বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগে রেফার করা হয়। সেই থেকেই এখানে ভর্তি আছি। পিঠেও অপারেশন করা হয়েছে।’

আনোয়ার আরো বলেন, ‘ভাবছি সিএমএইচএ যাবো। কিন্তু ডাক্তাররা সেখানে রেফার করছেন না। গেলে ছুটি নিয়ে যেতে হবে। এভাবে আর কতদিন পড়ে থাকব! এখন ডাক্তাররা খুব একটা খোঁজ-খবর নিচ্ছেন না। প্রতি মাসে মা-স্ত্রী এবং আমার খাওয়াসহ সব মিলে প্রায় ৩০ হাজার খরচ হচ্ছে। দিন দিন সবকিছু সাধ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। সরকারের কাছে সুস্থ হওয়া ছাড়া আর কোনো চাওয়া নেই আনোয়ারের। তিনি শুধু সুস্থ হতে চান। ফিরতে চান স্বাভাবিক জীবনে। আনোয়ার তার সুস্থতার জন্য দেশবাসীর নিকট দোয়া চেয়েছেন।

আনোয়ারের বিষয়ে ঢামেকের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন বলেন, ‘স্পাইনাল কর্ডে ইনজুরি হয়েছে। যে কারণে তার শরীরের নিচের অংশ অবশ হয়ে গেছে। চলাচল করতে পারছেন না। তার পিঠের ঘা প্লাস্টিক সার্জারি করে ঠিক করা হয়েছে। কিন্তু নিচের অংশ ঠিক হয়নি।’

তাকে বিদেশ পাঠানোর সুপারিশ করার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এটা খুবই জটিল। সারা পৃথিবীতে এর চিকিৎসা যেমন ব্যয়বহুল, তেমনি কেউ নিশ্চয়তা দিতে পারে না। আমাদের নিউরো সার্জন যারা আছেন, তারা বিষয়টি নিয়ে কথা বলছেন।’

এদিকে আনোয়ারের স্ত্রী আকলীমা আক্তার স্বামীর সুস্থতার জন্যে সকলের কাছে দোয়া চেয়েছেন। একইসাথে তিনি সরকারের কাছ থেকে সহায়তা পাওয়ারও আশা ব্যক্ত করেছেন।

সূত্র : বাসস


আরো সংবাদ



premium cement