অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে সংখ্যালঘুরা আগের চেয়ে নিরাপদ মনে করেন
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৫:১৩, আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৫:১৬
বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মনে করে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের তুলনায় অন্তবর্তী সরকার ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের বেশি নিরাপত্তা দিচ্ছে। মার্কিন গণমাধ্যম ভয়েস অব আমেরিকা (ভিওএ) বাংলার এক জরিপে এ তথ্য ওঠে এসেছে।
ভিওএ‘র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অক্টোবরের শেষের দিকে পরিচালিত এই জরিপে দেখা গেছে, ৬৪.১ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকার আগের সরকারের তুলনায় সংখ্যালঘুদের বেশি সুরক্ষা দিচ্ছে। অন্যদিকে ১৫.৩ শতাংশ মনে করেন পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে এবং ১৭.৯ শতাংশ মনে করেন পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে।
তবে এতে বলা হয়েছে, মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে নিরাপত্তার ধারণা ভিন্ন ভিন্ন।
এক হাজার উত্তরদাতার ওপর এই জরিপ চালানো হয়েছে। এই জরিপে সমান সংখ্যক পুরুষ ও নারীর অংশগ্রহণ ছিল। উত্তরদাতাদের ৯২.৭ শতাংশ মুসলিম ছিল। তাদের অর্ধেকেরও বেশি ৩৪ বছরের কম বয়সি এবং প্রায় এক-চতুর্থাংশ শহরাঞ্চলে বাস করেন।
পরিস্থিতির অবনতির পর উন্নতি
বাংলাদেশে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর সংখ্যালঘুদের বাড়ি-ঘর, ব্যবসা এবং ধর্মীয় স্থাপনাগুলোতে ভাংচুর-অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
তবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা নেয়ার পর প্রশাসন, বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং সাধারণ মানুষ এগিয়ে আসে সংখ্যালঘুদের উপাসনাস্থল পাহারা দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়া জন্য।
‘বেশ কিছু দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ আমরা লক্ষ্য করেছি, সাধারণ মানুষের তরফ থেকে, রাজনৈতিক দলের তরফ থেকে এবং ধর্মীয় গোষ্ঠীর তরফ থেকে। এর ফলে দেখা গেছে, পরবর্তী এক মাসের মধ্যেই অবস্থার উন্নতি হয়েছে,’ বলেন বাংলাদেশের মানবাধিকার কর্মী নুর খান লিটন, যিনি সম্প্রতি প্রতিষ্ঠিত গুম কমিশনের একজন সদস্য।
ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে পার্থক্য
তবে, জরিপে ফলাফলে নিরাপত্তা নিয়ে ধারণায় মুসলিম ও অমুসলিমদের কিছুটা তফাৎ লক্ষ্য করা গেছে।
মুসলিম উত্তরদাতাদের মধ্যে মাত্র ১৩.৯ শতাংশ মনে করেন বর্তমান পরিস্থিতি আগের থেকে খারাপ। কিন্তু ধর্মীয় সংখ্যালঘু উত্তরদাতাদের ৩৩.৯ শতাংশ মনে করেন তাদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের চেয়ে খারাপ করছে।
ঢাকার বাসিন্দা জয়তী সরকারের দাবি, তিনি আগে কখনো তার বা পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন না। কিন্তু এখন তিনি নিশ্চিত নন।
সংখ্যালঘুদের স্বস্তির জায়গা
ভয়েস অফ আমেরিকার জরিপে দেখা গেছে, মুসলিম উত্তরদাতাদের মধ্যে ৬৬.১ শতাংশ মনে করছেন আওয়ামী লীগ সরকারের চেয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংখ্যালঘুদের বেশি নিরাপত্তা দিচ্ছে। অন্যদিকে, ধর্মীয় সংখ্যালঘু উত্তরদাতাদের মধ্যে ৩৯.৫ শতাংশ এই ধারণার সাথে একমত।
অর্থাৎ, সংখ্যালঘুদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মনে করে আগের তুলনায় তারা বেশি নিরাপত্তা পাচ্ছে। জয়তী সরকার নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় থাকলেও, তিনিও একটি স্বস্তির জায়গা দেখতে পাচ্ছেন।
‘আওয়ামী লীগ ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় ছিল, তাদের নেতা–কর্মীদের ছত্রছায়ায় লোকজন হিন্দুদের জমি অল্প দামে কিনেছে বা তাদের বিক্রি করতে বাধ্য করেছে। এরা এখন আর নাই। তাই একটা স্বস্তি বিরাজ করছে,’ বলেন তিনি।
ঢাকার বাসিন্দা ও বেসরকারি সংস্থায় প্রোগ্রাম কোঅর্ডিনেটর হিসেবে কর্মরত হীরেন পণ্ডিত মনে করছেন, সম্প্রতি গ্রামে-গঞ্জে সেনাবাহিনী মোতায়েনের ফলে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা পরিস্থিতি আগস্ট-সেপ্টেম্বরের চেয়ে ভালো হয়েছে।
আন্তর্জাতিক উদ্বেগ
বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের পর সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন বিষয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নিয়মিত তার সরকারের উদ্বেগের কথা সংবাদ মাধ্যমকে জানান।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্তনি ব্লিংকেন ২৬ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে সাক্ষাৎ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার জানান, দুই নেতা অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যসহ বাংলাদেশের সকলের জন্য মানবাধিকার সুরক্ষার গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনের আগে ৩১ অক্টোবর সামাজিক মাধ্যম এক্স ও ট্রুথ সোশ্যালে এক পোস্টে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
তবে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ অভিহিত করে বলেছে, হিন্দুদের উপর নির্যাতনের খবর অতিরঞ্জিত করে প্রচার করা হচ্ছে।
সরকারের ১০০ দিন পূর্তি উপলক্ষে ১৭ অক্টোবর জাতির উদ্দেশে দেয়া এক ভাষণে ড. ইউনূস বলেন, কয়েকটি ক্ষেত্রে সংখ্যালঘুরা সহিংসতার শিকার হন, কিন্তু সেগুলো ছিল রাজনৈতিক।
ড. ইউনূস তার ভাষণে বলেন, ‘অল্প যে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে তার মূল কারণ ছিল রাজনৈতিক। কিন্তু এসব ঘটনাকে ধর্মীয় আবরণ দিয়ে বাংলাদেশকে নতুন করে অস্থিতিশীল করে তোলার চেষ্টা হয়েছে।’
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দক্ষিণ এশিয়ার পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেছেন, শেখ হাসিনার ‘নিপীড়নমূলক শাসনের’ প্রতি ভারতের সমর্থনও হিন্দুদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে, এবং আগামীতে দিল্লির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হবে।
তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত সব জায়গাতেই সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে চিন্তিত হওয়া। কিন্তু যেসব গোষ্ঠী ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে ঘৃণা এবং সহিংসতা ছড়াতে চায়, তাদের ব্যাপারে বিশেষ করে ভারতের আরো সাবধান হওয়া উচিত।’
ইতিবাচক ইঙ্গিত
মানবাধিকারকর্মী নুর খান লিটন বলেন, ‘দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় দুর্বলের প্রতি সবলের আঘাত আমরা বিগত দিনে দেখেছি এবং তার প্রধান শিকার হয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়।’
তবে তিনি সাম্প্রতিক সময়ে ইতিবাচক ইঙ্গিত দেখতে পাচ্ছেন।
তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের সময় যে শঙ্কা ছিল, সে শঙ্কা ক্রমান্বয়ে কেটে উঠছে, এবং এক ধরনের স্বস্তি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে আসতে শুরু হয়েছে। কিন্তু এখনি বলা যাবে না, তারা সম্পূর্ণ আস্থাশীল হতে পেরেছে কিনা।’
তবে নিরাপত্তা নিয়ে কতটুক আস্থাশীল হতে পারবেন, তা নিয়ে এখনো উদ্বিগ্ন ঢাকার বাসিন্দা জয়তী সরকার।
নুর খানের মতে, একটা আশঙ্কা অনেক মানুষের মধ্যেই আছে যে, আগামী তিন মাস পর চিত্র কী হবে। অর্থাৎ, আস্থার সঙ্কট রয়েছে।
‘সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আস্থার জায়গাটা আরো মজবুত হবে কিনা, তা নির্ভর করবে আগামী ছয় থেকে নয় মাসের কার্যক্রমের ওপর, সরকারের পদক্ষেপের ওপর,’ বলেন তিনি।
মানবাধিকার কর্মীরা মনে করছেন, সংখ্যালঘুদের তাদের অধিকার এবং নিরাপত্তা সম্পর্কে জনসমক্ষে আশ্বস্ত করতে সরকার এবং ছাত্রনেতাদের আরো পদক্ষেপ নেয়া উচিত।
সূত্র : ভয়েস অব আমেরিকা