কান্না থামাতেই পারছেন না শহীদ ইসমাইলের মা
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৩৫, আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৩৮
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহীদ হয়েছেন ইসমাইল। একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে দিশেহারা মা। থেকে থেকে কেঁদেই চলেছেন তিনি। প্রায় চার মাস হতে চলল, তবুও কোথাও সান্ত্বনা খুঁজে পাচ্ছেন না। কান্না থামছে না অসহায় মায়ের।
সন্তানের কথা মনে হলেই কান্না শুরু করেন তাসলিমা আক্তার। প্রতিবেশীরাও তার কান্না থামাতে গিয়ে ফেরেন অশ্রুসিক্ত নয়নে। স্বজনেরাও শোকাহত ইসমাইলের মৃত্যুতে।
প্রতিবেশীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সব সময়ে শুধু ছেলের জন্য কান্নাকাটি করেন তাসলিমা। ছেলে নিহত হওয়ার পর থেকে স্বামীর (ইসমাইলের বাবা) সাথেও কোনো যোগাযোগ নেই। ইসমাইলের ছোট একটা বোন আছে। তাকে নিয়েই থাকেন তিনি। ছেলেটা জুতার কারখানায় কাজ করতো। আর মা বাসা বাড়িতে।
এখন রাজধানীর মোহাম্মদপুরে ঢাকা উদ্যানের পাশের নবীনগরে থাকেন ইসমাইলের মা তাসলিমা আক্তার (৩২)। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে ১৯ জুলাই (শুক্রবার) মোহাম্মদপুরের ‘আল্লাহ করিম’ মসজিদের পাশে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন মো: ইসমাইল (১৭)।
শহীদ ইসমাইলের মা তাসলিমা আক্তার বলেন, সেদিন ছিল শুক্রবার (১৯ জুলাই)। সকালে ছেলেটা বেতনের টাকা তুলে নিয়ে এসে আমার হাতে দেয়। পরে আমি তাকে ভাত মাখিয়ে খাইয়ে দেই। আমাদের আগের বাসা ছিল কামারাঙ্গীচরে। সে নানির বাসায় যাবে বলে বের হয়। ওর নানির বাসা নবীনগরেই।
তিনি বলেন, আমি মানুষের বাসা-বাড়ি থেকে কাজ করে ফিরে এসে ইসমাইলের কোনো খবর পাই না। ফোন দেই, ধরে না। পরে রাত ৯টার দিকে ওর এক বন্ধু ফোন করে জানায়, ইসমাইল পুলিশের গুলিতে মারা গেছে। খবর পেয়ে আমরা মোহাম্মদপুরে গিয়ে অনেক খোঁজাখুজি করেও লাশ পাই না। শুনি তাকে ঢাকা মেডিক্যালে নেয়া হয়েছে। সেখানে গিয়ে রাত ১টার সময় তার লাশ সনাক্ত করি। ২০ তারিখ ময়নাতদন্ত শেষ করে ওই দিন বিকেলে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করি।
ইসমাইলের গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের ভৌরব উপজেলার জগন্নাথপুরে। তবে ইসমাইলের জন্ম কামারাঙ্গীচরেই। তার বাবা জমিস (৪০)। রশ্নি নামে সাত বছরের একটা ছোট বোন রয়েছে ইসমাইলের। তবে ইসমাইলের মৃত্যুর পরে মা তাসলিমা ও বোন রশ্নি এখন ঢাকা উদ্যান এলাকার নবীনগরে থাকেন। কারণ ইসমাইলের নানা-নানি ও দুই মামা সেখানে বসবাস করেন। রশ্নি স্থানীয় ফুল কলি স্কুলে প্রথম শ্রেণীতে পড়ালেখা করছে।
তাসলিমা আক্তার বলেন, ‘সেদিন মেডিক্যালে পুলিশের ভয়ে কান্না করতে পারি নাই। নিজের সন্তানের লাশ দেখে চুপ করে থাকতে বাধ্য করে পুলিশ। ছেলেটার গলায় গুলি লেগে মৃত্যু হয়। ওর মুখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না।’
তিনি বলেন, ছেলেটা আমার পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছিল। সংসারের অভাবের কারণে আর পড়ালেখা করতে পারেনি। পরে ইসলামপুরে জুতার কারখানায় কাজ শুরু করে। ওর বাবা সংসারের প্রতি উদাসিন ছিল। তিনি সংসারের কোনো খরচ দিতেন না। সন্তানটা নিহত হওয়ার পরে হাসপাতালে পর্যন্ত যাননি। এরপর থেকে আমাদের সাথে কোনো যোগাযোগও নেই।
সরেজমিনে রাজধানীর নবীনগরের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, নিচতলায় একটি এক রুমের বাসায় ভাড়া থাকছেন শহীদ ইসমাইলের মা ও বোন। রুমের মধ্যই রান্নাঘর। ছোট একটা রুম ভাড়া সাড়ে তিন হাজার টাকা। রুমে তেমন কোনো আলো-বাতাস ঢোকার জায়গা নেই। স্যাঁতসেঁতে একটা পরিবেশ। তেমন কোনো আসবাবপত্রও নেই। বাসার অবস্থা দেখলেই বোঝা যায় কী নিদারুণ কষ্টে সংসার চলছে তাদের!
শহীদ ইসমাইলের মা বলেন, ছেলেডারে নিয়ে আমার তো অনেক আশা ছিল। ছেলে কাজ করে সংসার চালাবে। আমাদের অভাব-অনটন দূর করবে। সে ইচ্ছা যে, এভাবে শেষ হয়ে যাবে, তা কে জানত। এখন আমি কাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখব? আমার সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। আমি এখন কাকে নিয়ে বাঁচব? মেয়েটার মুখের দিকে তাকাতে পারি না। আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই।
ছোট বোন রশ্নি বলেন, ‘ভাইকে নিয়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন ছিল। পরিবারের সবার ইচ্ছে ছিল ভাই বড় হয়ে মায়ের সব স্বপ্ন পূরণ করবে। এখন আর কেউ রইল না আমাদের দেখার, কে দেখবে আমাকে ও আমার মাকে? কে দেবে আমার স্কুলের বেতন? কিভাবে সংসার চলবে আমাদের? সরকার যদি আমাদের দিকে তাকায়, তাহলে আমরা ভালোভাবে বাঁচতে পারব। আমিও পড়াশোনা চালাতে পারব। আমার ভাইকে যারা গুলি করে হত্যা করেছে তাদের কঠিন বিচার চাই, তাদের ফাঁসি চাই।
ইসমাইলের নানি ঝর্ণা জানান, ইসমাইল অনেক ভালো ছেলে ছিল। সে যে এভাবে গুলিতে মারা যাবে, আমরা মেনেই নিতে পারছি না। যখন ওর মৃত্যুর খবর শুনতে পেলাম, আমি খুবই মর্মাহত হই। ইসমাইল ছাড়া পরিবারটিকে দেখার মতো কেউ নাই। ছোট একটি বোন পড়াশোনা করছে। কে দেখবে এখন ওদের? দেখার মতো কেউ রইল না।
সরকারের কাছে দাবি, ইসমাইলের পরিবার যেন চলতে পারে সেরকম কোনো একটা ব্যবস্থা করে দিক।
তিনি বলেন, নাতিটা মারা যাওয়ার পর মেয়ে ও নাতনিকে এই এলাকায় নিয়ে এসে বাসা ভাড়া করে দিয়েছি। আমার সংসারই চলে না, ওদের দু’জনকে কিভাবে খাওয়াব, পরাব? আমার দুইটা ছোট ছেলে। তারাই কাজ করে সংসার চালায়। আমরাই ঠিকমতো খেতে পারি না। আবার এখন ওরা দু’জন এসেছে।
নিহত ইসমাইলের মা তাসলিমা আরো বলেন, আমার ছেলে কারখানায় কাজ করে কিছু টাকা দিত। আর আমি বাসা বাড়িতে কাজ করে যা টাকা পাইতাম তা দিয়েই আমাদের সংসার চলতো। সরকার যদি আমাদের পাশে দাঁড়ায়, তাহলে মেয়েকে নিয়ে একটু ভালোভাবে বাঁচতে পারব। আমার ছেলেকে যারা হত্যা করেছে, আমি তাদের বিচার চাই। আমার ছেলে তো দেশের জন্য জীবন দিয়েছে। তাকে যেন শহীদের মর্যাদা দেয়া হয়।
মামলার বিষয়ে তাসলিমা বলেন, আমার ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে মোহাম্মদপুর থানায় ১৫ জনের নামে মামলা করেছি। কতজনের নামে এবং কার কার নামে মামলা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এর বাইরে আমার কিছু মনে নেই। আমি ওই ফাইলগুলো বের করতে চাই না। ওগুলো দেখলে আমার বুকের মধ্যে অনেক কষ্ট বেড়ে যায়।
বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তাসলিমা আক্তার।
সূত্র : বাসস