এবার শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে অভিযোগ
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ০২ নভেম্বর ২০২৪, ২৩:৫৫, আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ০০:৩৮
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার বিষয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রিপরিষদ এবং সহযোগীদের বিরুদ্ধে নেদারল্যান্ডেসের হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক আদালতে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) রোম স্ট্যাটিউটের ১৫ অনুচ্ছেদের অধীনে এ অভিযোগ দায়ের করেন ‘থ্রি বোল্ট কোর্ট চেম্বার্স’র ব্যারিস্টার মো: আশরাফুল আরেফিন।
ব্যারিস্টার মো: আশরাফুল আরেফিন যিনি ব্যারিস্টার এম এ আরেফিন আশরাফ নামেও পরিচিত।
অভিযোগে শেখ হাসিনা ও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে স্বাধীন তদন্ত এবং মূল সন্দেহভাজনদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির অনুরোধ করেছেন এ আইনজীবী।
শুক্রবার (১ নভেম্বর) লন্ডন-বাংলা প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানিয়েছেন মামলার বাদী ব্যারিস্টার মো: আশরাফুল আরেফিন।
সংবাদ সম্মেলনে ব্যারিস্টার সারাহ ফোরে ও ব্যারিস্টার এমিল লিক্সান্দ্রু উপস্থিত ছিলেন।
আশরাফুল আরেফিন বলেন, গত ২৮ অক্টোবর আমি এই অভিযোগ দায়ের করেছি। মালায় শেখ হাসিনা, তার মন্ত্রিসভার সদস্য ও জড়িত বিভিন্ন সংস্থার ৭০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, চলতি বছরের জুলাই মাসে বাংলাদেশে এক নজিরবিহীন ছাত্র আন্দোলনের সূচনা ঘটে, যা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামে পরিচিতি লাভ করে। শিক্ষার্থীরা সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটার অযৌক্তিক হারে পুনর্বহাল এবং সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ পদ নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর জন্য সংরক্ষণের প্রতিবাদে রাস্তায় নামে। তাদের দাবি ছিল, এই কোটা ব্যবস্থা নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে অযাচিত অগ্রাধিকার প্রদান করে, যা দেশের মেধাবী এবং যোগ্য প্রার্থীদের জন্য চাকরির পথ রুদ্ধ করে দেয়। আন্দোলনের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল কোটা সংস্কার, তবে পুলিশের গুলিতে আবু সাঈদের মৃত্যুর মতো ঘটনার পর এটি দ্রুত বৃহত্তর আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। শিক্ষার্থীরা তখন কেবল কোটা সংস্কার নয়, বরং প্রশাসনিক দুর্নীতি, অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলনে যুক্ত হন। তাদেরকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। আবু সাঈদকে কীভাবে পুলিশ গুলি করেছে সেটি সারাবিশ্ব দেখেছে। আমরা এসব মানবতাবিরোধী অপরাধের বিষয়গুলো তুলে ধরছি।
অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ২০২৪ সালের জুলাই এবং আগস্ট মাসে বাংলাদেশ ইতিহাসের এক পৈশাচিক নৃশংসতার সাক্ষী হয়েছিল।
ওই সময় বাংলাদেশের সরকার আন্দোলন দমনে পুলিশ, র্যাব ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগকে মাঠে নামায়। তারা আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচারে রাবার বুলেট, সাউন্ড গ্রেনেড, লাইভ বুলেট ব্যবহার করে। এতে প্রায় ১ হাজার ৪০০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয় এবং প্রায় ২২ হাজার মানুষ আহত হয় বলে জানা গেছে। গণহত্যার পাশাপাশি গুলিতে অন্তত ৯২ জন দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন এবং শতশত মানুষ পঙ্গুত্ববরণ করেছেন বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।
এই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখোমুখি হওয়ার পর অমানবিক সহিংসতার মাধ্যমে সরকার এর জবাব দেয় উল্লেখ করে বলা হয়, শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন দমন করতে সরকার পুলিশ, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের মতো বাহিনী মোতায়েন করে। এই বাহিনী নির্বিচারে গুলি, রাবার বুলেট, সাউন্ড গ্রেনেড এবং প্রাণঘাতী অস্ত্র— যেমন বার্ডশট প্লেট এবং তাজা গুলি ব্যবহার করে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকারীদের ওপর হামলা চালায়। ইতিহাসের এই বর্বরতম নৃশংসতায় ১ হাজার ৪০০ জনেরও বেশি মানুষ শহীদ হয়েছেন এবং হাজার হাজার মানুষ আহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে অনেকেই স্থায়ীভাবে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন।
বাংলাদেশ সরকারের এই কঠোর ব্যবস্থার ফলে দেশে গণহত্যা, বিচারবহির্ভূত হত্যা, নির্যাতন এবং অসংখ্য বিক্ষোভকারী নিখোঁজ হয়েছেন। এই নিষ্ঠুরতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো আন্তর্জাতিক মানবিক আইন লঙ্ঘনের উদাহরণ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে বিবেচিত।
বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা এই গুরুতর অপরাধের নিরপেক্ষ তদন্ত করতে সক্ষম হবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে উল্লেখ করে আরও বলা হয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং প্রশাসনের অধিকাংশ কর্মকর্তাই পূর্ববর্তী সরকার আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত, যা নিরপেক্ষ তদন্তের পথে বড় বাধা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার কারণে, নিরপেক্ষ বিচার বা বিচার ব্যবস্থার প্রভাবশালী সিদ্ধান্ত প্রাপ্তিতে রাজনৈতিক স্বার্থ বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে, যা ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর জন্য প্রতারণামূলক হবে। অভিযুক্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত থেকে রাজনৈতিক সহায়তা পাওয়ার সম্ভাবনার কারণে স্থানীয় আদালতে ঘোষিত কোনো দণ্ড কার্যকর হওয়ার বিষয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলে ভারত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সহযোগিতায় বাধ্য হতে পারে। এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) রোম স্ট্যাটিউটের ১৫ অনুচ্ছেদের অধীনে আবেদনটি দাখিল করা হয়েছে।
এই আবেদনের অগ্রগতি নিয়মিত জানানো হবে উল্লেখ করে বলা হয়, এর মাধ্যমে শেখ হাসিনা, তার মন্ত্রিসভা এবং সরকারের অন্যান্য প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগে একটি স্বাধীন তদন্তের আহ্বান জানানো হয়েছে। আবেদনে উল্লিখিত বিভিন্ন অপরাধের মধ্যে রয়েছে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড, গোপন বন্দিশালায় নির্যাতন, চলাচল ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং গণহত্যার মতো গুরুতর অপরাধ।