রাজনৈতিক ট্যাগে নির্যাতনের শিকার ৮৪ শতাংশ শিক্ষার্থী

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও হলগুলোতে গত ১৫ বছরে যেসব নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে ৮৪ শতাংশ শিক্ষার্থীকে রাজনৈতিক ট্যাগ ব্যবহার করে নির্যাতন করা হয়েছে। ৮৪ শতাংশ শিক্ষার্থী নির্যাতিত হয়েছেন হলগুলোতে।

এছাড়া ১৪ শতাংশ শিক্ষার্থী ছাত্র শিবির ও ২ শতাংশ শিক্ষার্থী ছাত্রদলের রাজনীতি করার কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। বিগত সরকারের আমলে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ না করা, রাতে হলে গেস্টরুমের মিটিংয়ে অনুপস্থিত থাকা, জ্যেষ্ঠ নেতাদের যথেষ্ট সম্মান-সমীহ না করাসহ নানা কারণে এসব নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন ‘সোচ্চার-টর্চার ওয়াচডগ বাংলাদেশ‘ এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্যাতিত ৫০ জনের সাক্ষাৎকার নিয়ে সংগঠনটি প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে।

গতকাল সোমবার রাতে বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের ৫ম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক ওয়েবিনারে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।

গবেষণা প্রতিবেদনে তারা উল্লেখ করেছেন, প্রায় ৮৪ শতাংশ নির্যাতনের ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে ঘটেছে, যেখানে ভুক্তভোগীদের নির্দিষ্ট কক্ষে ডেকে এনে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। ১০ শতাংশ নির্যাতন শুরু হয়েছে ক্যাম্পাসের কোনো স্থানে এবং শেষ হয়েছে আবাসিক হলের নির্দিষ্ট নির্যাতনের কক্ষে। ৬ শতাংশের ক্ষেত্রে নির্যাতন শুরু এবং শেষ হয়েছে ক্যাম্পাসেই।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, নির্যাতনের শিকার ২৬ শতাংশ শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের, ১৮ শতাংশ খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং ১৬ শতাংশ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের।

এছাড়াও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় এবং এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটিতেও নির্যাতনের ঘটনা রয়েছে।

এতে আরো বলা হয়, নির্যাতনের সবচেয়ে বেশি ঘটনা ঘটেছে ২০১৭ সালে। মাস হিসেবে সবচেয়ে বেশি নির্যাতন করা হয়েছে আগস্ট মাসে।

নির্যাতনের ধরন উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে তাড়া করা এবং লাঠি, স্টাম্প, রামদা ও জিআই পাইপ দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। গ্রুপভিত্তিক নির্যাতনের সময় সিগারেটের আগুনের ছ্যাঁকা দেয়া, হকিস্টিক, ক্রিকেট স্টাম্প, লাঠি ও রড দিয়ে পেটানো হয়েছে। হাত-পায়ের হাড় ভেঙে দেয়া, চড়-থাপ্পড়, কিলঘুষি ও লাথি মারা হয়েছে। কারো কারো নখ তুলে ফেলা হয়। মাধরের পর মুমূর্ষু অবস্থায় পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে মিথ্যা মামলাও করা হয়েছে।

এছাড়াও প্রতিবেদনে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের কারণ, ধরন, নির্যাতনের সময় এবং নির্যাতন-পরবর্তী আন্দোলন নিয়ে সোচ্চারের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হয়। একইসাথে অতীতে সংঘটিত নির্যাতনের বিচার এবং ভবিষ্যতে নির্যাতন বন্ধের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ ক্যাম্পাস গড়ে তুলতে সোচ্চার ১০ দফা সুপারিশ করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ভার্জিনিয়ার অর্থনীতি বিভাগের পোস্টডক্টরাল রিসার্চ ফেলো ও সোচ্চারের প্রেসিডেন্ট শিব্বির আহমদ বলেন, ‘নির্যাতনের ঘটনার আগের দিনগুলো আর পরের দিনগুলো এক থাকে না শিক্ষার্থীদের। দীর্ঘ সময় কারাবরণ, মানসিক যন্ত্রণা, পড়াশোনায় অনিয়মিত হওয়া, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছিটকে পড়া, দীর্ঘমেয়াদি নানা সমস্যা দেখা দেয়া, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, আর্থিক ক্ষতি, ক্যাম্পাসে আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তায় ভুগতে হয় ভুক্তভোগীদের।‘

তিনি আরো বলেন, ‘এসব নির্যাতন বন্ধে সরকারি কমিশন গঠন করে তদন্ত করতে হবে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের আলাদা তদন্ত কমিটি ও প্রাতিষ্ঠানিক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। ভিক্টিম সাপোর্ট সেল গঠন, প্রথম বর্ষের ছাত্রদের জন্য বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা, ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির জন্য বিধিমালা তৈরি করা, ছাত্ররাজনীতির সংস্কার, হলগুলোতে ছাত্ররাজনীতি মুক্ত করা, ইনক্লুসিভ ক্যাম্পাস সম্পর্কিত প্রশিক্ষণ, আবাসনের সঙ্কটের সমাধান ও ৭ অক্টোবর ক্যাম্পাস নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস ঘোষণা করতে হবে।‘

ওয়েবিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. সালেহ হাসান নকিব বলেন, ‘ছাত্র নির্যাতনের ঘটনার ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। স্বাধীনতার আগে, পরেও হয়েছে। এটার সাথে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। ৮০ ও ৯০ দশকে ছিল ছাত্র সংঘর্ষ। কিন্তু গত ১৫ বছরের ঘটনাকে ছাত্র সংঘর্ষ বলা যায় না, বরং এগুলো হলো ছাত্র নিপীড়ন ও নির্যাতন। আমরা দেখেছি, উৎসব করে বিশেষ কক্ষে নির্যাতনের ঘটনা ঘটানো হয়েছে। এখানে ছাত্রসংগঠন ও সরকার মিলেমিশে নির্যাতনের ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে। যার মূল ভিত্তিতে ছিল বিচারহীনতা। এসব বন্ধ করতে হলে সুশাসন ও ন্যায়বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে।‘

বুয়েটের উপ-ভিসি ড: আব্দুল হাসিব চৌধুরী বলেন, ‘ক্যাম্পাসে ছাত্র নির্যাতনের ইতিহাস প্রায় দীর্ঘ ৫০ বছরের, কিন্তু সেগুলো সুনির্দিষ্টভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়নি। তিনি সোচ্চারকে ক্যাম্পাসে নির্যাতনের ঘটনাগুলোকে লিপিবদ্ধ করার উদ্যোগ নেয়ার জন্য ধন্যবাদ জানান।‘

উল্লেখ্য, ২০১৯ সালে ছাত্রলীগের নির্যাতনের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেন বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ।‘

আবরার ফাহাদের ছোট ভাই আবরার ফাইয়াজ বলেন, ‘শুধু আবরার ফাহাদ না, সারাদেশের সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকগুলো ভয়াবহ ঘটনা পাওয়া যাবে। এগুলোর সঠিক নথিভুক্তকরণ ও বিচার জরুরি। তা না হলে এসব ঘটনার পুনরায় ফিরে আসবে।‘

মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের সভাপতি অধ্যাপক ড. সি আর আবরার বলেন, ‘ক্ষমতাসীন দলগুলো বিশ্ববিদ্যালায়গুলোকে স্বেচ্ছাচারিতার চারণভূমিতে পরিণত করেছে। তাদের ছাত্রবাহিনীকে পেটোয়া বাহিনীতে পরিণত করেছিল সেটা আমরা সবাই জানি। শিক্ষকরা দলদাস হিসেবে কাজ করেছে। শিক্ষকরা কিন্ত এখন আর এখানে শিক্ষক হিসেবে পরিচিত হন না। কার দলীয় কী পদ সেটা নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। বিভিন্ন নামে, বিভিন্ন সংগঠনের পরিচয়ে। এসব জায়গা থেকে বের না হয়ে আসতে পারলে ক্যাম্পাস নির্যাতন বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।

ব্যারিস্টার শাইখ মাহদি বলেন, ‘নির্যাতকদের অনেকেই পরবর্তীতে সরকারি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পজিশনে পদস্থ হয়েছে। বিচারহীনতা এবং নির্যাতকদের পুরষ্কৃত করার এই ঘটনাগুলো জুনিয়রদের নির্যাতক হয়ে উঠার প্রনোদনা হিসেবে কাজ করেছে। তিনি ভিক্টিম সাপোর্ট সেল গঠন করে বিচার করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।‘

এছাড়া আলোচকরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, সোচ্চারের গবেষণা প্রতিবেদন, নির্যাতনের বিচার এবং ক্যাম্পাসে নির্যাতন বন্ধে সোচ্চারের সুপারিশসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন।

তারা বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা যাতে ভয়মুক্ত পরিবেশে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে, সেজন্য প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ও নীতিমালা অত্যন্ত জরুরি।