ইরানের দিক থেকে ইসরাইলে পাল্টা হামলার আশঙ্কা কতটা
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ০৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৬:২৯, আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৬:৩২
সিরিয়ার দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেটে ইসরাইলি হামলায় ১৩ জন নিহত হওয়ার পর ইরানের জন্য জন্য একটি কঠিন সময় যাচ্ছে। একদিকে এই হামলার জবাব দিতে চাইছে দেশটি। অন্যদিকে ইরান এমন কোনো কাজ করতে চায় না যার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়তে পারে।
ইসরাইল এবং যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা আশঙ্কা করেন, ইরান পাল্টা আঘাত করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে দেশটির সংবাদমাধ্যম সিবিএস নিউজ জানিয়েছে, ইরান ড্রোন এবং ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পরিকল্পনা করছে।
তবে কখন এবং কোন জায়গায় এই আঘাত করা হবে সেটি নিশ্চিত নন মার্কিন কর্মকর্তারা। এই হামলা এখন থেকে শুরু করে রমজান মাসের শেষ সপ্তাহে যেকোনো সময় হতে পারে বলে ধারণা করছেন কর্মকর্তারা।
ড্রোন ওক্ষেপণাস্ত্র হামলা ইরাক ও সিরিয়ার মাটি থেকে নাকি ইরানের ভেতর থেকে পরিচালনা করা হবে সেটিও এখনো নিশ্চিত হতে পারেনি মার্কিন গোয়েন্দারা।
এদিকে ইসরাইলও বলেছে, ইরান যদি পাল্টা আঘাত করে তাহলে তারা আবারো হামলা চালাবে। এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি যুদ্ধের সঙ্কেত বেজে উঠতে পারে।
ইরানের শক্তি আছে?
ইসরাইলের বিরুদ্ধে কোনো কড়া সামরিক জবাব দিতে গেলে সেটি যুদ্ধকে ইরানের দোরগোড়ায় টেনে আনবে। কারণ ইরানের বিষয়ে ইসরাইলও ছেড়ে কথা বলবে না।
অন্যদিকে ইসরাইলি হামলার যথাযথ জবাব দিতে না পারলে ইরানের সামরিক সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। ফলে ভবিষ্যতে ইসরাইল ইরানকে আরো দুর্বল ভাববে এবং তাদের ওপর চেপে বসবে।
ইরানকে প্রমাণ করতে হবে যে তারা দুর্বল নয়, যেকোনো হামলার জবাব দেয়া ক্ষমতা তাদের রয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যে বড় ধরনের কোনো যুদ্ধের সূত্রপাত না করে ইরান কিভাবে ইসরাইলকে জবাব দিতে পারে সেটি নিয়ে এক ধরনের দোদ্যুল্যমানতা তৈরি হয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে ইসরাইলকে পাল্টা আঘাত করার মতো সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সামর্থ্য ইরানের রয়েছে কিনা?
মধ্যপ্রাচ্য-বিষয়ক বিশ্লেষক ও লেখক আলী সাদরাজদেহ বলেন, ইসরাইলের সাথে সঙ্ঘাতে জড়ানোর মতো সামর্থ্য ইরানের নেই।
সাদরাজদেহ বলেন, ‘কিন্তু দেশের ভেতরে জনগণকে দেখানোর জন্য হলেও ইরানকে একটি জবাব দিতে হবে। এছাড়া নিজেদের মিত্রদের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা টিকিয়ে রাখার জন্যও ইরানকে একটি পদক্ষেপ নিতে হবে।’
তবে ইরানের কড়া জবাব দেয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। এর পরিবর্তে ইরানকে ‘কৌশলগত কারণে ধৈর্য’ ধরতে হবে।
কারণ ইরানের এখন অগ্রাধিকার হচ্ছে পারমাণবিক বোমা তৈরি করা। কিছু ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ে ১০০ জন ইসরাইলিকে হত্যা করার চেয়ে পারমাণবিক বোমা তৈরির পথে এগিয়ে যাওয়া যুক্তিযুক্ত। এর মাধ্যমে ভবিষ্যতে শুধু ইসরাইল নয়, যুক্তরাষ্ট্রের হামলা ঠেকাতেও সক্ষম হবে ইরান।
হিজবুল্লার অবস্থান কী?
গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর থেকে সিরিয়া, ইরাক, লেবানন ও ইয়েমেনে ইরান-সমর্থিত বিভিন্ন গোষ্ঠী ইসরাইলি স্বার্থে আঘাত হানছে। কিন্তু তাদের সে তৎপরতাও সীমিত আকারে। এসব গোষ্ঠী ইসরাইলের সাথে পুরোপুরি যুদ্ধে লিপ্ত হতে চায় না।
সাদরাজদেহ বলেন, ‘ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর কাছে ইসরাইলের দূতাবাসে হামলার বিষয়টি চিন্তা করাটা বেশ কঠিন।’
হিজবুল্লাহ হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে সংগঠিত সশস্ত্র গ্রুপ। রাষ্ট্রীয় বাহিনী না হয়েও তাদের ২০ থেকে ৫০ হাজারের মতো যোদ্ধা রয়েছে। তাদের বেশিভাগই বেশ প্রশিক্ষিত। সিরিয়া যুদ্ধে অংশ নেয়ার মাধ্যমে যুদ্ধের ময়দানে লড়াই করার অভিজ্ঞতাও তাদের তৈরি হয়েছে।
ইরান-সমর্থিত হিজবুল্লাহর প্রায় এক লাখ ৩০ হাজার রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
তারপরেও বিশ্লেষকরা মনে করেন, ইরানের পক্ষ নিয়ে হিজবুল্লাহ এখন ইসরাইলের সাথে সরাসরি যুদ্ধে জড়াবে না।
গার্গেস বলেন, ‘হিজবুল্লাহ ইসরাইলের ফাঁদে পা দিতে চায় না। কারণ তারা ভালো করেই জানে যে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং তার যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভা এই যুদ্ধকে বিস্তৃত করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে। কারণ নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এই যুদ্ধ কত দিন চলবে তার ওপর।’
প্রতীকী জবাব দেয়া
পর্যবেক্ষক সাদরেজাদেহ মনে করেন, ইসরাইলের সাথে সরাসরি যুদ্ধে না গিয়ে ইরান একটি প্রতীকী জবাব দেয়ার উপায় খুঁজছে।
কয়েক বছর আগে ইরানের শীর্ষ কমান্ডার কাশেম সোলাইমানিকে ইরাকে হত্যা করার পর ইরানের তরফ থেকে ‘কড়া প্রতিশোধের’ হুমকি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে সেটি ঘটেনি।
সোলাইমানি হত্যার জবাবে ইরান ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছিল ইরাকে অবস্থিত মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে। কিন্তু সেই হামলায় মার্কিন কোনো সৈন্য হতাহত হয়নি। বরং হামলার আগে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীকে ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে সতর্ক করে দেয়া হয়েছিল।
ভার্জিনিয়া টেক স্কুল অব পাবলিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স-এর ইউসুফ আজিজি বলেন, ইরানের ভেতরে পর্দার অন্তরালে দুটি শক্তির মধ্যে মতভেদ চলছে। একটি পক্ষ চাইছে ইরান পারমানবিক শক্তি অর্জন করার মাধ্যমে ইসরাইলি অগ্রাসন রুখে দাঁড়াক। আরেকটি অংশ চায় ইসরাইলে সরাসরি হামলার মাধ্যমে এর জবাব দেয়া হোক।
এক্ষেত্রে ধৈর্য ধারণ করে পারমাণবিক লক্ষ্য অর্জন করার বিষয়টি হয়তো অগ্রাধিকার পাবে।
পাল্টা জবাব দিতেই হবে?
মধ্যপ্রাচ্যে বড় ধরনের কোনো যুদ্ধ শুরু হোক সেটি ইরান চায় না। তেহরানের হাতে দুটি বিকল্প আছে। একটি হচ্ছে- মার্কিন সৈন্য এবং তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট স্থাপনার ওপর হামলার জন্য ইরান-সমর্থিত গ্রুপগুলোকে মদদ দিতে পারে।
দ্বিতীয়টি হচ্ছে- ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি জোরদার করে এগিয়ে নেয়া।
যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্ররা তেহরানের পারমাণবিক কর্মসূচির রাশ টেনে ধরতে চাইছে।
বার্তাসংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা ইরানের গতিবিধি খুবই সতর্কতার সাথে পর্যবেক্ষণ করছে। ইরান-সমর্থিত বিভিন্ন গোষ্ঠী ইরাক এবং সিরিয়াতে অবস্থিত মার্কিন সৈন্যদের ওপর হামলান সম্ভাবনা আছে কিনা সেদিকে সতর্ক নজর রাখছে ওয়াশিংটন।
তবে সিরিয়া ও ইরাকে মার্কিন সৈন্যদের ওপর ইরান-সমর্থিত গ্রুপগুলোর হামলার বিষয়ে মার্কিন গোয়েন্দাদের দিক থেকে এখনো পর্যন্ত তথ্য পাওয়া যায়নি।
শুক্রবার ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জামশিদি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) লেখেন, নেতানিয়াহু যে ফাঁদ তৈরি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের নেতারা যাতে নিজেদের সেখানে টেনে না আনে।
জামশিদি লেখেন, ‘আপনারা দূরে থাকুন যাতে আঘাত না লাগে।’
তিনি দাবি করেন, তার এই বার্তার পর যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে বলেছে যে তারা যাতে মার্কিন স্থাপনার ওপর আঘাত না করে।
সিবিএস নিউজ নিশ্চিত হয়েছে, ইরানের কাছ থেকে যুক্তরাষ্ট্র লিখিত বার্তা পেয়েছে। স্টেট ডিপার্টমেন্টের একজন মুখপাত্র সিবিএস নিউজকে জানিয়েছেন, ইরানের চিঠির জবাবে যুক্তরাষ্ট্রও পাল্টা হুঁশিয়ারি দিয়ে চিঠির উত্তর দিয়েছে।
স্টেট ডিপার্টমেন্ট লিখেছে, ইসরাইলের হামলার বিষয়টিকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে যাতে কোনো আঘাত না করা হয়।
ইরান একদিকে চাইছে, এমন একটি জবাব দিতে যাতে ভবিষ্যতে ইসরাইল এ ধরনের হামলা করতে সাহস না পায়। অন্যদিকে ইরান এটাও চায় না যে তাদের জবাবের মধ্য দিয়ে যাতে আবার মধ্যপ্রাচ্যে বড় ধরনের কোনো যুদ্ধের সূত্রপাত হয়ে যায়। এ বিষয়টি নিয়ে এক ধরনের দোলাচলে রয়েছে ইরান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেছেন রয়টার্সকে বলেন, ‘এক্ষেত্রে ইরান যদি কোনো জবাব না দেয় তাহলে এটা এমন একটা বার্তা দেবে যে ইরান শুধু একটি কাগুজে বাঘ, জবাব দেয়ার কোনো ক্ষমতা তাদের নেই।’
ইরানের সামনে পথ কী?
সেক্ষেত্রে ইরান হয়তো বিদেশে অবস্থিত ইসরাইলি দূতাবাস এবং বিভিন্ন ইহুদি স্থাপনায় হামলা চালাতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সংস্থা কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্সের মধ্যপ্রাচ্য-বিষয়ক বিশেষজ্ঞ এলিয়ট আব্রামস রয়টার্সকে বলেন, ইরান ইসরাইলের সাথে সর্বাত্মক যুদ্ধে লিপ্ত হতে চায় না বলে তার বিশ্বাস। তবে ইসরাইলের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন জায়গায় তারা হামলা চালাতে পারে।
ইরান আরেকটি উপায়ে জবাব দিতে পারে। সেটি হচ্ছে- তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি তরান্বিত করা। ইউরেনিয়াম আরো সমৃদ্ধ করে সেটিকে পারমাণবিক বোমা তৈরির উপযোগী করে তোলা। অথবা প্রকৃত পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির নকশা পুনরায় শুরু করা।
কিন্তু এসব পদক্ষেপ ইরানের জন্য উল্টা ফল বয়ে আনতে পারে বলে পর্যবেক্ষকদের অনেকে মনে করেন। ইরান এসব কাজ করতে গেলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের হামলাকে আমন্ত্রণ জানানো হবে।
ওয়াশিংটন-ভিত্তিক থিংক ট্যাঙ্ক সিএসআইএসের মধ্যপ্রাচ্য-বিষয়ক বিশেষজ্ঞ জন অল্টারম্যান মনে করেন, ইসরাইলের দূতাবাসে হামলার মতো পদক্ষেপ ইরান নেবে না।
তিনি বলেন, ‘ইসরাইলকে শিক্ষা দেয়ার ব্যাপারে ইরান ততটা আগ্রহী নয়। বরং ইরান তাদের মিত্রদের দেখাতে চায় যে তারা দুর্বল নয়।’
ইরান এখন কোন পথে হাঁটবে? এ বিষয়টি নির্ভর করছে দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লাহ আলি খামেনির সিদ্ধান্তের ওপর।
সূত্র : বিবিসি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা