গাজায় যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব পাস : ইসরাইল মানতে বাধ্য, হামাস নয়
- ২৬ মার্চ ২০২৪, ১২:৫৫
গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে একটি প্রস্তাব পাস করেছে জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদ। এর আগে এরকম প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র ভেটো দিলেও এবার ভোট দান থেকে বিরত থেকেছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এই প্রস্তাবটি পাসের অর্থ হলো ইসরাইল তা পালন করতে বাধ্য। কিন্তু গাজাভিত্তিক ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস তা পালন করতে বাধ্য নয়। কারণ সে রাষ্ট্র নয়।
নিরাপত্তা পরিষদের এই প্রস্তাবে সব পণবন্দীকে অবিলম্বে ও নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানানো হয়েছে।
গত বছরের অক্টোবরে যুদ্ধ শুরুর পর বেশ কয়েকটি ব্যর্থ প্রচেষ্টার পরে নিরাপত্তা পরিষদ এই প্রথম যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানালো।
গাজায় ইসরায়েলের আক্রমণের প্রেক্ষাপটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপ তার এবং তার মিত্র ইসরাইলের মধ্যে ক্রমবর্ধমান মতবিরোধের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
নিরাপত্তা পরিষদের এই প্রস্তাব পাসের পর ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয় থেকে একটি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এর আগে পণবন্দী মুক্তির সাথে যুদ্ধবিরতির বিষয়টি যুক্ত রাখা হলেও এবার যুক্তরাষ্ট্রে তাদের ওই অবস্থান পরিত্যাগ করেছে।
এতে বলা হয়েছে, 'দুঃখের বিষয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নতুন প্রস্তাবনায় ভেটো দেয়নি।'
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এটা পণবন্দীদের মুক্তির প্রচেষ্টাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এটি হামাসকে ধারণা দিয়েছে যে তারা বন্দীদের মুক্ত না করে যুদ্ধবিরতি অর্জনের জন্য ইসরাইলের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ ব্যবহার করতে পারে।
ওয়াশিংটনে একটি ইসরাইলি প্রতিনিধিদল এবং মার্কিন কর্মকর্তাদের মধ্যে এই সপ্তাহের জন্য নির্ধারিত বৈঠক বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন নেতানিয়াহু, বলা হয়েছে বিবৃতিতে।
ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেছেন, গাজায় এখনো যেহেতু পণবন্দীরা আটকে রয়েছে, তাই ইসরাইল গাজায় যুদ্ধ বন্ধ করবে না।
জাতিসঙ্ঘে ফিলিস্তিনের প্রতিনিধি রিয়াদ মনসুর প্রস্তাবটিকে স্বাগত জানিয়েছেন। তবে, বলেছেন, এটা আরো অনেক আগেই করা দরকার ছিল।
মনসুর বলেন, 'অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির দাবি জানাতে এই কাউন্সিলের ছয় মাস সময় লেগেছে। এরই মধ্যে ১০ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত ও পঙ্গু হয়েছে, দুই মিলিয়ন বাস্তুচ্যুত এবং দুর্ভিক্ষ হয়েছে।'
হামাস এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছে। তারা বলেছে যে 'তারা অবিলম্বে বন্দী বিনিময় প্রক্রিয়ায় জড়িত হতে প্রস্তুত। যা উভয় পক্ষের বন্দীদের মুক্তির দিকে নিয়ে যাবে।'
সোমবার নিরাপত্তা পরিষদের ভোটে যুক্তরাষ্ট্র ভোট দেয়া থেকে বিরত থাকে। তবে, বাকি ১৪ সদস্য এ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এর আগে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে করা প্রস্তাবগুলোতে বাধা দিয়েছিল। তারা বলেছিলে যে ইসরাইল এবং হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি এবং পণবন্দী মুক্তির আলোচনা চলার সময়ে এই ধরনের পদক্ষেপ ভুল হবে।
কিন্তু বৃহস্পতিবার তারা তাদের নিজস্ব খসড়া উত্থাপন করেছে। যাতে প্রথমবারের মতো যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানোয় ইসরাইলের প্রতি তাদের কঠোর অবস্থান চিহ্নিত করেছে।
মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র জন কিরবি বলেছেন, প্রস্তাব পাস করতে দেয়ার মার্কিন সিদ্ধান্তের অর্থ 'আমাদের নীতিতে পরিবর্তন' নয়।
তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধবিরতিকে সমর্থন করেছে কিন্তু প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়নি। কারণ এতে হামাসের নিন্দা করা হয়নি।
প্রস্তাবটি পাস হওয়ার পর একটি প্রেস ব্রিফিংয়ে কিরবি বলেছেন, 'আমরা খুব স্পষ্ট ছিলাম, আমরা একটি পণবন্দী চুক্তির অংশ হিসেবে একটি যুদ্ধবিরতির পক্ষে বরাবরই আমাদের সমর্থন ছিল। এভাবেই পণবন্দী মুক্তির চুক্তি হয় এবং প্রস্তাবে সেই আলোচনার স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।''
জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, যুদ্ধবিরতি এবং সব বন্দীর অবিলম্বে ও নিঃশর্ত মুক্তির জন্য এই প্রস্তাবনাটির 'দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে।'
২০০৯ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত জাতিসঙ্ঘে যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পারনকারী মার্ক লিয়াল-গ্রান্ট বিবিসি রেডিও ৪ পিএম প্রোগ্রামে বলেছেন, এই প্রস্তাবনা পাসের অর্থ ইসরাইল এখন 'মূলত পরবর্তী ১৫ দিনের জন্য সামরিক অভিযান বন্ধ করতে একটি বাধ্যবাধকতার অধীনে থাকবে।'
তিনি যোগ করেছেন, এই প্রস্তাবনাটি আইনত ইসরাইলের জন্য বাধ্যতামূলক, কিন্তু হামাসের জন্য নয়। কারণ ফিলিস্তিনি গ্রুপটি একটি রাষ্ট্র নয়।
এর আগে, জাতিসঙ্ঘে ইসরাইকে সুরক্ষা দিতে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ভেটোর ক্ষমতা ব্যবহারের অভিযোগ আনা হয়েছিল।
যাইহোক, গাজায় ক্রমবর্ধমান মৃ্ত্যুর সংখ্যার কারণে সমালোচনার মুখে পড়েছে ইসরাইল।
হামাস-পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গাজায় ৩২ হাজারেরও বেশি মানুষ, প্রধানত মহিলা এবং শিশু ইসরাইলের বোমাবর্ষণে নিহত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র গাজায় ত্রাণ বিতরণে আরো ভূমিকা রাখার জন্য ইসরাইলকে চাপ দিচ্ছে। তারা বলছে যে সেখানকার জনগণ তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।
ইসরাইলের বিরুদ্ধে ত্রাণ কার্যক্রমে বাধা দেয়ার অভিযোগ করেছে জাতিসঙ্ঘ। অন্যদিকে জাতিসঙ্ঘের বিরুদ্ধে ত্রাণ সরবরাহে ব্যর্থতার অভিযোগ করেছে ইসরাইল।
গত অক্টাবরে হামাসের বন্দুকধারীরা সীমান্তে ইসরাইলি বসতিতে আক্রমণ করার পরে বর্তমান যুদ্ধ শুরু হয়। ইসরাইলের হিসাব অনুযায়ী, এতে প্রায় ১২ শ' জন নিহত হয়। ২৫৩ জনকে গাজায় বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয়।
পণবন্দীদের মুক্তি,উদ্ধার অভিযান বা মৃতদেহ উদ্ধারের পরেও ১৩০ জন পণবন্দীর বিষয়ে এখনো কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
এই সপ্তাহের শেষের দিকে ওয়াশিংটনে ইসরাইলি প্রতিনিধি দলের যে সফর হওয়ার কথা ছিল, ইসরাইল সেটি সেটি বাতিল করার কথা জানালেও কিরবি বলেছেন, ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট এবং যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভানের মধ্যে নির্ধারিত বৈঠক পরিকল্পনা অনুযায়ী চলবে।
সোমবার এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি বলেছেন, 'আমরা প্রতিরক্ষামন্ত্রীর কাছে স্পষ্ট করতে চাই যে হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইসরাইলের পাশে আছে যুক্তরাষ্ট্র।'
সূত্র : বিবিসি