যে কারণে পতন ঘটতে পারে মিসরের স্বৈরশাসক সিসির
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ২৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১৮:৫৭
একটি সফল সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ২০১৪ সালে মিসরের ক্ষমতা গ্রহণ করেন প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি। এরপর গত হলো দীর্ঘ একটি দশক। এ সময় অর্থনৈতিক, নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক পরিসরে দেশটি কেবল অবনতিরই সাক্ষী হলো। কিন্তু এরপরও তার বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠেনি জনগণ। সেজন্য প্রশ্ন জাগে, কিভাবে এমন স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করেছেন তিনি?
আসলে নিজের নিরাপত্তার জন্য সিসি এই সময় বড় খড়গহস্ত ছিলেন। তিনি গণমাধ্যমকে কঠোরভাবে রুদ্ধ করেছেন। বিচার বিভাগের উপর রেখেছেন পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। বিরোধী নেতাদেরও ব্যাপক ধর-পাকড় করেছেন। সামরিক বাহিনীতে নিয়মিত বদলির নীতি বাস্তবায়ন করে আনুগত্য টিকিয়ে রেখেছেন। মোটকথা বেশ চরমপন্থা অবলম্বন করে তিনি যেকোনো উত্থানকে দমিয়ে রেখেছেন।
তিনি অবশ্য অতীত থেকেই শিক্ষা নিয়েছিলেন। পাঠ গ্রহণ করেছেন মিসরের সাবেক প্রেসিডেন্ট গামাল আবদেল নাসের ও তার প্রতিরক্ষা প্রধান হাকিম আমিরের দ্বন্দ্ব থেকে। তিনি দেখেছেন, কিভাবে সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের অধীনে দীর্ঘ সময় প্রতিরক্ষামন্ত্রী থেকে মোহাম্মদ হুসেন তানতাওয়ের নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করেছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত ২০১১ সালে তাকে অপসারণ পর্যন্ত করেছেন। তিনি ইতিহাসের এ শিক্ষাগুলো আমলে নিয়েছেন; ভুলের পুনরাবৃত্তি করেননি।
সিসি তার ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য পাঁচটি স্তম্ভের উপর ভর করেছেন। সেগুলো হলো, নিরাপত্তার হাতিয়ার হিসেবে সামরিক গোয়েন্দা তথ্য ব্যবহার, জোটের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর বিকল্প স্থাপন, রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্রের বিকল্প কাঠামো প্রতিষ্ঠা, অর্থনীতির উপর সামরিক বাহিনীকে ব্যাপক নিয়ন্ত্রণ প্রদান এবং বিরোধীদের পাশে দাঁড় করানোর জন্য নতুন আইন প্রণয়ন। এই স্তম্ভগুলোর উপর ভর করে নিজের ক্ষমতাকে ঝালিয়ে নিয়েছেন তিনি।
সিসির সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ
২০১১ সালে বিদ্রোহের সময় সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার আধিপত্য তীব্রভাবে শুরু হয়। এ সময় তারা প্রথম দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ শুরু করে। একইসাথে জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা জেনারেল ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসে (জিআইএস) নিজেদের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করে। এরপর ২০১৩ সালের জুলাই অভ্যুত্থানের পর জিআইএসকে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার অধীনস্থ করে নেয়। এতে প্রেসিডেন্টের সাথে জিআইএস-এর যোগাযোগ কমে যায়। আর সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের কাজ করার অবকাশও শেষ হয়ে যায়। এতে জিআইএসকে একরকম নিরপেক্ষ থাকতে হয়েছে। এরপর সিসির সাবেক চিফ অফ স্টাফ আব্বাস কামেলকে জিআইএস-এর তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব দেয়া হয়। এতে সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সরিয়ে অনুগত লোকদের বসানোর পথ উন্মোচিত হয়।
জিআইএসকে তবুও যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণে নিতে পারেননি সিসি। ফলে তিনি গণমাধ্যমের উপর নিরাপত্তা খাতের নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত তথ্য ফাঁস, ২০১৭ সালে মিসরের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের হত্যা প্রচেষ্টায় তার সম্পৃক্ততা প্রকাশ পাওয়ার আশঙ্কা করছিলেন। এমনিভাবে সাবেক প্রেসিডেন্টপ্রার্থী সামি আনানের প্রতি জিআইএস সমর্থন দিয়েছিল। সৌদি আরবকে তিরান ও সানাফির দ্বীপপুঞ্জ ছেড়ে দেয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের বিরোধিতাও করেছিল। ফলে জিআইএস-এর গুরুত্বপূর্ণ পদে নিজের ছেলেকেই বসিয়ে দেন সিসি। আর টেলিযোগাযোগ খাতের দায়িত্ব দিলেন আরেক সন্তানকে। এভাবে তিনি পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ সুসংহত করলেন।
অর্থনৈতিক অবক্ষয়
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সিসি সামরিক বাহিনীকে সম্পৃক্ত করেন। তিনি অবকাঠামো ও খাদ্য উৎপাদনসহ একাধিক খাতে সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করেন। এতে সামরিক বাহিনী কেবল নিরাপত্তা বাহিনীই থাকেনি; বরং অর্থনীতির সহায়ক হিসেবেও আবির্ভূত হয়ে ওঠেছে। তবে বেসরকারি খাতকে পাশ কাটিয়ে অর্থনীতিতে সামরিক বাহিনীর সম্পৃক্ততায় বিদেশী বিনিয়োগ হারিয়েছেন তিনি।
হোসনে মোবারকের অর্থনৈতিক ভাবনার সাথে সিসির বিস্তর ব্যবধান রয়েছে। মোবারক অর্থনীতির খাতকে বেসরকারি খাতে উন্মুক্ত করেছেন। তিনি সামরিক বাহিনী, ব্যবসায়ী ও আমলাদের মাঝে ভারসাম্য বজায় রেখেছিলেন। যে কারণে মধ্যবিত্তরাও রাজনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছিল। কিন্তু সিসি হেঁটেছেন তার উল্টো পথে। তিনি বেসরকারী খাত, বিদেশী বিনিয়োগ ইত্যকার সেক্টরকে তুলনামূলক দুর্বল করে দিয়েছেন। এর বাইরে অপরিকল্পিত ও ব্যয়বহুল নানা প্রকল্প শুরু করে অর্থনীতিকে আরো খাদে ফেলেছেন। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণ নিয়েও তেমন লাভবান হতে পারেননি। উল্টো দেশের ঋণ বৃদ্ধি করেছেন।
রাজনৈতিক জিঘাংসা
রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে কোনো আপোষ করেননি সিসি। বরং তাদের সাথে চরম বৈরি ও ঘৃণার আচরণ করেছেন তিনি। অবশ্য রাজনৈতিক দলগুলোর বিকল্প হিসেবে তিনি নিরাপত্তা বাহিনীর সমন্বয়ে একটি জোট তৈরি করেছেন। এরপর রাজনৈতিক দলগুলো ভেঙে দেয়ার জন্য গ্রেফতার ও নানা দমন-পীড়ন করেন। এরই ধারাবাহিকতায় শত শত রাজনৈতিক বন্দী এখনো মিসরের কারাগারে রয়েছে।
এক্ষেত্রে তিনি নাসেরের পদাঙ্কই অনুসরণ করেছেন বলে মনে হয়। তিনিও তার শাসনের শুরুর দিকে রাজনৈতিক দলগুলো ভেঙে দিয়েছিলেন। তবে সিসির অধীনে গঠিত জোটে সাবেক ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এনডিপি) মতো সাংগঠনিক সমন্বয় নেই। এনডিপি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অভিজাত শ্রেণির মাঝে আনুগত্যের একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল। তারা সরকারের জন্য রাজনৈতিক ঢাল হিসেবে কাজ করেছিল। রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবেও ভূমিকা রেখেছিল। কিন্তু সিসি এমন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে জনসাধারণের অনুভূতি বা নির্বাচন কার্যকরভাবে পরিচালনা করার মতো রাজনৈতিক ভিত্তি তার নেই।
নিরাপত্তার সাথে সিসির আপোষ
আন্তর্জাতিক ফ্রন্টে সিসির পররাষ্ট্র নীতি মিসরের জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। উল্টো কৌশলগত সম্পর্ককেও ক্ষতিগ্রস্থ করেছে। উপসাগরীয় দেশগুলোর সাথে তার যে সম্পর্ক দেখা যাচ্ছে, সেজন্য তাকে দীর্ঘ মেয়াদি স্বার্থের জলাঞ্জলি দিতে হয়েছে। বিশেষ করে নীলনদের পানির উপর আধিপত্যে ছাড় এবং সৌদি আরবকে তিরান ও সানাফির হস্তান্তর দেশটির আঞ্চলিক অবস্থান আরো দুর্বল করে দিয়েছে।
এর বাইরে ফিলিস্তিন ইস্যুতে মিসর ইতোমধ্যে তার ঐতিহাসিক নেতৃত্ব হারিয়েছে। এক্ষেত্রে তাকে একটি প্রান্তিক অবস্থান গ্রহণ করতে হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যকে স্থিতিশীল করার ক্ষেত্রে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে জোট বাধা ফিলিস্তিনি অধিকারের রক্ষক হিসেবে মিসরের বিশ্বাসযোগ্যতা হ্রাস করেছে।
এছাড়া মিসরের কিছু অভ্যন্তরীণ বিষয় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিস্তৃত হয়ে গেছে। যেমন গ্র্যান্ড ইথিওপিয়ান রেনেসাঁ বাঁধ। এ কারণে কৌশলগত চ্যালেঞ্জগুলোও স্বাধীনভাবে সমাধান করা তার জন্য জটিল হয়ে গেছে। এতে বহিরাগত নানা চাপেরও মুখোমুখি হতে হচ্ছে সিসিকে।
এহেন পরিস্থিতিতে নাগরিক পর্যায়ে অসন্তোষ ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। সিসি যদি এই অসন্তোষকে উপেক্ষা করে আপন নীতিতেই অটল থাকেন, বিশেষ করে কৌশলগত সম্পদ বিক্রি, কঠোর ব্যবস্থা বাস্তবায়ন এবং ভিন্নমত দমন ইত্যকার বিষয় অব্যাহত রাখেন, তাহলে যে বিদ্রোহ তৈরি হবে, তা হয়তো তাৎক্ষণিকভাবে দমন করা যেতে পারে। তবে তাকে একটি দীর্ঘমেয়াদি অস্থিতিশীলতার মধ্যে পড়তে হবে।
এছাড়া যেকোনোভাবেই হোক সামরিক বাহিনীকে এই অর্থনৈতিক পতন রোধে হস্তক্ষেপ করতে হবে। সেজন্য হয়তো সিসির সাথে আলোচনার মাধ্যমেই তা সম্ভব হবে। অথবা এর জন্য অভ্যুত্থানও ঘটতে পারে। সেনাবাহিনীর মালিকানাধীন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোতেও স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করতে হবে। এর জন্য আইএমএফ বরাবর চাপ দিয়ে যাচ্ছে। সেজন্য সেনাবাহিনী এমন পর্যায়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।
অবশেষে আমরা মিসরে এখন যে গণ-বিক্ষোভ দেখতে পাচ্ছি, তা পরিবর্তনেরই আভাস দেয়। কারণ, অর্থনৈতিক দুর্দশা থেকেই বিদ্রোহের সূত্রপাত ঘটে। এ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে সামরিক বাহিনীকে হস্তক্ষেপ করতে পারে এবং সিসিকেও অপসারণ করতে বাধ্য করে।
সিসির শাসনামল কর্তৃত্ববাদী একীভূতকরণ, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং আঞ্চলিক প্রভাবসহ নানা দুর্বলতায় চিহ্নিত হয়ে থাকবে। বাস্তব সংস্কার ছাড়া, শাসনব্যবস্থার কাঠামোগত দুর্বলতাগুলো শেষ পর্যন্ত তার পতনের দিকে নিয়ে যেতে পারে। এতে মিসর নতুনভাবে গভীর রাজনৈতিক ও সামাজিক সঙ্কটে গিয়ে পড়বে।
মিডল ইস্ট আই থেকে অনুবাদ করেছেন আবু সাঈদ
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা