২৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১৩ মাঘ ১৪৩১, ২৫ রজব ১৪৪৬
`

নেতানিয়াহুকে পশ্চিমতীর ‘উড়িয়ে দেয়ার’ স্বাধীনতা দিলেন ট্রাম্প!

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু - ছবি : সংগৃহীত

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ডকে নিয়ে কেউ কেউ আশাবাদী ছিলেন। তাদের ধারণা ছিল, ট্রাম্পের মাধ্যমেই অবসান ঘটবে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের। কিন্তু তাদের এই দৃষ্টিভঙ্গি পুনর্বিবেচনা করা উচিৎ। সেজন্য অধিকৃত পশ্চিমতীরের বর্তমান অবস্থা দেখলেই যথেষ্ট হবে বলে মনে করি।

যুদ্ধবিরতি চুক্তির অংশ হিসেবে বন্দী বিনিময় করছে ইসরাইল ও হামাস। ইন্টারন্যাশনাল রেড ক্রিসেন্ট কমিটির কাছে বন্দীদের হস্তান্তর করছে উভয় পক্ষ। ইসরাইলি বন্দীদের বহনকারী গাড়িকে সুসজ্জিত হামাস যোদ্ধারা পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এ দেখে ইসরাইলি বাহিনীর ক্ষোভের শেষ নেই। তারা জেনিনে হামলা করে এর খেদ মেটানোর চেষ্টা করছে।

ইসরাইলি সাংবাদিক ইসরাইল ফ্রে বলেন, সেনাবাহিনী ভিত্তিহীন বর্ণনা দিয়ে জনসাধারণকে পক্ষে রেখেছে। তারা এতদিন কেবল নিজেদের বিজয়গাঁথা ও প্রতিশোধের গল্প শুনিয়ে এসেছে। কিন্তু সদ্য মুক্তি পাওয়া বন্দীদের ঘিরে হামাসের এমন আয়োজন তাদের হতবাক করেছে। গুঁড়িয়ে দিয়েছে দীর্ঘ ১৬ মাস ধরে গড়ে তোলা সেনাদের বিজয়ের মিথ। গাজা থেকে তারা যখন টয়োটা ও সশস্ত্র হামাস যোদ্ধাদের বের হতে দেখেছে, তারা বুঝে নিয়েছে যে সেনাবাহিনী এতদিন তাদের মিথ্যা বুঝ দিয়েছিল।

তবে পশ্চিমতীরের শরণার্থী শিবিরে এই বৃহৎ স্থল আক্রমণ ছিল পূর্বপরিকল্পিত। এর মাধ্যমে অতিডানপন্থী অর্থমন্ত্রী ও অধিকৃত পশ্চিমতীরের ডি ফ্যাক্টো কনসাল জেনারেল বেজালেল স্মোট্রিচকে মন্ত্রিসভায় ধরে রাখা হয়েছে। কারণ, তিনি গাজায় যুদ্ধবিরতির কারণে পদত্যাগের হুমকি দিয়েছিলেন। সেনা নেতৃত্বকেও নির্মূল করার ভয় দেখিয়েছিলেন। তাই তাকে হাতে রাখতে এই আক্রমণ করা হয়েছে।

পূরণ হচ্ছে নেতানিয়াহুর স্বপ্ন!
এবার দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসেছেন ট্রাম্প। তিনি প্রশাসনকে এমনভাবে ঢেলে সাজিয়েছেন যে ইসরাইল প্রথম মেয়াদে ট্রাম্পের কাছে যেই আশাবাদ রেখেছিল, তা পূরণে যেন সকল বন্দোবস্ত করে দেয়া হয়েছে। তিনি প্রথম মেয়াদে দখলকৃত গোলান হাইটসকে সংযুক্ত করার অনুমতি দিয়েছিলেন; যা নিয়ে সিরিয়ার সাথে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছিল ইসরাইলের। তিনি আব্রাহাম চুক্তির উপর ভর করে ফিলিস্তিনিদের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়েছেন। এছাড়া জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তর করে শহরটিকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতিও দিয়েছিলেন।

দ্বিতীয় মেয়াদে এসেও ট্রাম্প ইসরাইলি স্বার্থ রক্ষা করছেন বলে মনে হচ্ছে। তিনি মাইক হাকাবিকে মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক রাষ্ট্রদূত নিয়োগ দিয়েছেন। অথচ হাকাবি মনে করেন, ফিলিস্তিন বলতে কিছু নেই। ফিলিস্তিনিদের অস্তিত্বও অস্বীকার করেন তিনি। পিট হেগসেথকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে প্রতিরক্ষা সচিব হিসেবে। অথচ তিনি বলেছিলেন, আল আকসা মসজিদের ধ্বংসাবশেষের উপর ইহুদিদের তৃতীয় সিনাগগ তৈরি করা উচিত। স্টিভ উইটকফ হয়েছেন শান্তি দূত। অথচ তিনি গাজাবাসীদের ইন্দোনেশিয়ায় স্থানান্তরিত করতে চান।

সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, ট্রাম্প নিজেই বলেছেন যে সাত মিলিয়ন ফিলিস্তিনির জন্য তিনি চিন্তা করতে আগ্রহী নন। ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনার তো গাজাকে বিশ্বের বৃহত্তম ধ্বংসস্তূপ হিসেবে দেখতে আগ্রহী। এর বিনিময়ে তিনি গাজার সমুদ্র দখলে নিতে চান। সেখানে দুর্দান্ত কিছু করতে চান। অথচ গাজাবাসীদের নিয়ে তারও নেই কোনো উদ্বেগ।

সত্যি বলতে, ট্রাম্প ধনী বা দরিদ্র কোনো আরব দেশের জন্যই আন্তরিক নন। এমনকি সৌদি আরবের প্রতিও তার সহানুভূতি ঠিক ততটুকুই, ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান তার স্বার্থ যতটুকু রক্ষা করতে ইচ্ছুক।

মোটকথা, গাজায় গণহত্যার প্রতি উদাসীন, আনুগত্যের মানদণ্ডে শতভাগ উত্তীর্ণদের নিয়ে পরিষদ গঠন, কঠোর ইসরাইলপন্থীদের প্রধান্যদান ইত্যাদি নানা কারণে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে যে ট্রাম্প কি আবারো ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর জন্য নিবেদিত হয়ে কাজ করবেন? নেতানিয়াহুর আগ্রাসী নীতি কি আসলেই ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের সম্ভাবনা অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দেবে?

এই প্রশ্নের উত্তরে আমি যা ভাবছি, তা কিছুটা দোদুল্যমান ভাবনা। বিষয়টি ব্যাখ্যা করেই বলি। মধ্যপ্রাচ্যে জায়নবাদের যে জাগরণ, এর পেছনে একটি পূর্ণাঙ্গ ইসরাইলি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভাবনা অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে। এমন ভাবনায়ই প্রভাবিত ইসরাইলের বৃহত্তম অংশ। অবশ্য ২০১৭ বা তার আগে এতো বেশি ছিল না। এছাড়া পূর্ণ ইসরাইলি রাষ্ট্রগঠন এখন মন্ত্রিসভারও অন্যতম দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেজন্য আনুকূল্য পেতে সর্বাত্মক চেষ্টা করে ট্রাম্পকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বানানো হয়েছে। এখন তাই ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে আন্তরিকতা ও আনুকূল্য লাভ করছে। এদিকে, পশ্চিমতীরকে কার্যত ইসরাইলই নিয়ন্ত্রণ করছে। এর সীমান্ত ইসরাইলি পুলিশই দেখভাল করছে। সেনাবাহিনীও সেখানে সক্রিয় রয়েছে। এতে পূর্ণাঙ্গ ইসরাইলি রাষ্ট্রগঠনের উৎসাহ তাদের মনে আরো জেঁকে বসেছে।

মধ্যপ্রাচ্য এখন আগের মতো নেই
তবে এটিও সত্য যে পরিস্থিতি এখন আগের মতো নেই। মধ্যপ্রাচ্য এখন আর ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের মতো নতজানু নেই। সেজন্য ইসরাইল ও মার্কিন প্রশাসনকে যদি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হয়, তাহলে ভেবেচিন্তে নিতে হবে। আগের মতো মনোভাব বজায় রাখলে পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটতে পারে। সেটি অস্থিরতা তৈরি করতে পারে তাদের প্রশাসনেও। যার সদ্য উদাহরণ প্রেসিডেন্ট বাইডেনের প্রশাসন। সেজন্য নেতানিয়াহু এখন যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছেন। এর জন্য তিনি উইটকফের মধ্যস্থতাকে সামনে আনতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, অভ্যন্তরীণ নানা অনুঘটকও তাকে যুদ্ধবিরতিতে রাজি হতে বাধ্য করেছিল। যুদ্ধবিরতির পর ইসরাইলি গণমাধ্যমগুলো জরিপে দৃষ্টি দিলেই তা সহজে অনুমান করা যেতে পারে।

জরিপগুলো আপাতদৃষ্টিতে পরস্পরবিরোধী মনে হতে পারে। সেখানে দেখা গেছে, ৬২ শতাংশ ইসরাইলি বিশ্বাস করেন যে গাজায় কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি নেই। সেজন্য ফিলিস্তিনিদের প্রতি তাদের কোনো সহানুভূতি নেই। অপরদিকে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ইসরাইলিই যুদ্ধের অবসানকে সমর্থন করেন। এর কারণ কী হতে পারে? এর কারণ হলো, ইসরাইলিরা তাদের সেনা ও আহতদের জীবনের নিরাপত্তাহীনতা, দেশীয় অর্থনীতির অবনতি ও পশ্চিমা জীবনযাত্রার ব্যত্যয় মেনে নিতে পারছে না। সেজন্য তারা এই যুদ্ধের অবসায়ন চায়। উঠতি প্রজন্ম এসবকে তাদের জন্মগত অধিকার মনে করে। এছাড়া যুদ্ধটা সরকার, সেনাবাহিনী এবং সামগ্রিকভাবে সমাজের উপর এক ভারী বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ইসরাইলি সমাজ আগের চেয়ে অনেক বেশি বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এর উপর বন্দীদের পরিবারের সাপ্তাহিক বিক্ষোভ সরকারের উপর আলাদা চাপ সৃষ্টি করেছিল। ফলে অভ্যন্তরীণ অসন্তোষও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল। এটি নিয়ন্ত্রণে তারা লেবাননে যুদ্ধবিরতি চুক্তি করেছিল। কিন্তু সেটি নেতানিয়াহু প্রশাসনের উপর চাপ কমাতে পারেনি। বরং পরিস্থিতির দিন দিন আরো অবনতি হয়েছে। এদিকে, নেতানিয়াহুর মনেও ভয় কাজ করছে যে এই চাপ যদি শামাল দিতে না পারেন, তাহলে তার আগামী মেয়াদের ক্ষমতায় আসাটা অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।

৭ অক্টোবরের হামলার জন্য তার ব্যর্থতার কথা না হয় বাদই দিলাম। এই যুদ্ধে তো ৪০০ জনেরও বেশি সৈন্য মারা গেছে এবং হাজার হাজার আহত হয়েছে। গাজার ধ্বংসস্তূপে হামাস যদি পুনরায় জেগে উঠতে পারে, তাহলে তারা কেন অবনতির দিকে এগুচ্ছে? এ প্রশ্নগুলোও আশাপাশে ভেসে বেড়াচ্ছিল। সেজন্য নেতানিয়াহুর প্রশাসন যুদ্ধবিরতির পথে হাঁটতে বাধ্য হয়েছিল। এখানেও একটি প্রশ্ন থেকে যায় যে যদি ইসরাইল যুদ্ধ-ক্লান্তই হয়ে থাকে, তাহলে কেন তারা পশ্চিমতীরে আরেকটি অভিযান শুরু করছে এবং কেন তারা গাজার চেয়ে বড় সিরিয়ার ভূখণ্ড দখল করেছে?

নেতানিয়াহুর চতুর বুদ্ধি
নেতানিয়াহু ওয়াশিংটনের মনোভাব খুব ভালো বিশ্লেষণ করতে পারে। সেজন্য শুরুতেই তিনি ট্রাম্পের মনোভাব পড়ে নিয়েছেন। তিনি বুঝে নিয়েছেন যে ট্রাম্প ইসরাইলি বন্দীদের মুক্তির জন্য মূলত যুদ্ধবিরতি চাচ্ছে। সেজন্য যদি বন্দীরা মুক্তি পেয়ে যায় অথবা তাদের বেশিরভাগই ছাড়া পেয়ে যায়, তাহলে ট্রাম্পের পক্ষ থেকে আর কোনো বাধা থাকবে না। তখন গাজা বা পশ্চিমতীরে যা ইচ্ছে, তা-ই করতে পারবে।

দায়িত্ব গ্রহণের পর গাজায় যুদ্ধবিরতির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে ট্রাম্প বলেন, এটি আমাদের যুদ্ধ নয়। এটি তাদের যুদ্ধ। আমি নিশ্চিত নই। তবে আমার মনে হয়, প্রতিপক্ষ অত্যন্ত দুর্বল।

মিডল ইস্ট আই থেকে অনুবাদ করেছেন আবু সাঈদ


আরো সংবাদ



premium cement
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির পক্ষে মামলা পরিচালনার আবেদন করতে পারবেন আইনজীবীরা টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে টেসলা: এলানের অনন্য সাফল্য সীমান্তে বাংলাদেশীকে কুপিয়ে হত্যা : ভারতীয় নাগরিকসহ ৭ জনের নামে মামলা এবারের ভোট হবে আমাদের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ভোট : নির্বাচন কমিশনার ‘সে আমারে দুই সন্তান আর তার নতুন কবর উপহার দিয়ে গেল’ প্রথম ঘণ্টায় ঢাকার পুঁজিবাজারে সবকটি সূচকের পতন নির্বাসন চুক্তির পর কলম্বিয়ার ওপর শুল্ক ও নিষেধাজ্ঞা স্থগিত করল যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞার মুখে অভিবাসীবাহী মার্কিন ফ্লাইট অবতরণে অনুমতি কলোম্বিয়ার কঙ্গোতে সকল বাংলাদেশী শান্তিরক্ষী নিরাপদ রয়েছেন : আইএসপিআর জামিন পেলেন পরীমণি হাতকড়া পরিয়ে অভিবাসীদের ফেরত পাঠালো যুক্তরাষ্ট্র

সকল