গোলান মালভূমি কী, ইসরাইলের কাছে কেন গুরুত্বপূর্ণ
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:২০
সিরিয়া ও ইসরাইলের মাঝখানে বাফার জোন (সংঘাতমুক্ত বিশেষ অঞ্চল) বলা হতো গোলান মালভূমিকে। কিন্তু দামেস্কে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের পতনের পর ইসরাইলি সামরিক বাহিনী গোলানসহ আরো কয়েকটি এলাকা দখল করে নিয়েছে।
ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইসরাইল ডিফেন্স ফোর্স (আইডিএফকে) বাফার জোনে প্রবেশ করার এবং কমান্ডিং পজিশনে অবস্থান নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
বাশার আল আসাদের পতনের পর ইসরাইলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সাময়িকভাবে এই পদক্ষেপ নেয়া হলো বলে জানিয়েছেন তিনি। তবে আরব দেশগুলো এর নিন্দা জানিয়েছে।
গোলান মালভূমি কোথায় এবং কারা এর নিয়ন্ত্রণ করছে?
গোলান হলো সিরিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত প্রায় এক হাজার ৮০০ বর্গকিলোমিটার (প্রায় এক হাজার বর্গমাইল) আয়তনের এক পাথুরে মালভূমি। এলাকাটি ইসরাইলের উত্তর-পূর্বাঞ্চল স্পর্শ করেছে। গোলান বর্তমানে ইসরাইলি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আছে।
১৯৬৭ সালে ছয় দিনের যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত লড়াইয়ের সময় গোলান মালভূমিজুড়ে ইসরাইলের ওপর হামলা চালায় সিরিয়া। কিন্তু ইসরাইল পাল্টা প্রতিরোধ নেয় এবং গোলানের এক হাজার ২০০ বর্গকিলোমিটার (৪৬০ বর্গমাইল) এলাকা দখল করে নেয়।
১৯৭৩ সালে মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধের (যা ইয়োম কাপুর নামেও পরিচিত) সিরিয়া গোলানের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।
১৯৭৪ সালে দু’দেশই অস্ত্রবিরতিতে সই করে। চুক্তির শর্ত মেনে দু’পক্ষকেই মালভূমির ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি লম্বালম্বি এলাকা ছেড়ে নিজ নিজ বাহিনীকে সরিয়ে নিতে হয়। এই এলাকাটি পরিচিত ‘এরিয়া অব সেপারেশন’ নামে। এরপর সেখানে জাতিসঙ্ঘ নিয়োজিত ‘ডিজএনগেজমেন্ট অবজারভার ফোর্স’ মোতায়েন করা হয় অস্ত্রবিরতির বিষয়টিতে নজর রাখার জন্য।
১৯৮১ সালে ইসরাইল গোলান মালভূমিতে নিজের নিয়ন্ত্রণেল এলাকার বাড়ায় এবং নতুন দখল করা ভূমিতে বসতি স্থাপনও শুরু করে।
এই এলাকায় ইসরাইলের সার্বভৌমত্বে কখনো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মেলেনি। তবে কয়েক দশক পুরনো মার্কিন নীতি ভঙ্গ করে ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই দখলদারিত্বে স্বীকৃতি দেন।
সিরিয়া বরাবরই বলে এসেছে, ইসরাইল গোলান মালভূমি থেকে পুরোপুরি সেনাপ্রত্যাহার না করা পর্যন্ত তারা আর কোনো শান্তি চুক্তিতে সই করবে না।
বাফার জোন উপেক্ষা করে এরিয়া অব সেপারেশনের কোনো কোনো পয়েন্ট পর্যন্ত বসতি সম্প্রসারণ করায় গত নভেম্বরে ইসরাইলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে সিরিয়া ও জাতিসঙ্ঘ।
গোলান মালভূমি কেন গুরুত্বপূর্ণ?
গোলান মালভূমি দখলে থাকার সময় ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত সিরিয়ার উত্তরঞ্চলে নিয়মিত কামানের গোলা নিক্ষেপ করত ইসরাইল। এছাড়া সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক গোলান থেকে মাত্র ৬০ কিলোমিটার উত্তরে, ফলে ইসরাইলের জন্য সেখানে নজর রাখাও অনেক সহজ। সিরিয়ান সামরিক বাহিনীর নড়াচড়াও চোখে পড়ে সেখান থেকে।
এই মালভূমি সিরিয়ার হামলা থেকেও ইসরাইলকে এক ধরনের প্রতিরক্ষা দেয়, ১৯৭৩ সালের যুদ্ধের সময়ও তারা এর সুবিধাটা পায়।
এছাড়া শুষ্ক ওই অঞ্চলে গোলান মালভূমি হচ্ছে পানির উৎস। মালভূমি বেয়ে নামা বৃষ্টির পানি যায় জর্ডান নদীতে, যেই পানি আশপাশের জমির উর্বরতা ধরে রাখে।
যেকোনো শান্তি চুক্তির জন্য সিরিয়ার মূল শর্ত হলো, ইসরাইলকে ১৯৬৭ সালের আগের সীমান্তে ফিরে যেতে হবে। ইসরাইল এটা মানলে গ্যালিলি সাগরের (মিঠা পানির হ্রদ) নিয়ন্ত্রণ পাবে। আরবদের মধ্যে এই হ্রদ লেক তিবেরিয়াস এবং ইসরাইলিদের মধ্যে লেক কিনেরেত নামেও পরিচিত। কিন্তু এর নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিল বিশুদ্ধ পানির উৎস ইসরাইলের হাতছাড়া হয়ে যাবে। বরং ইসরাইলের দাবি, গোলানের ওপর দিয়ে পূর্ব দিতে তার সীমানা আরো সম্প্রসারিত হওয়া উচিত।
ইসরাইলের জনমতও এই অঞ্চলের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার পক্ষে।
গোলান মালভূমিতে বসবাস করে কারা?
১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরাইল গোলান মালভূমি দখল করার পর অনেক সিরিয়ানকে ওই এলাকা ছেড়ে চলে যেতে হয়। এখন সেখানে ৩০টিরও বেশি ইসরাইলি বসতি আছে। এসব বসতিতে ২০ হাজারের মতো লোক বসবাস করে।
আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী এসব বসতি বেআইনি, যদিও ইসরাইল এটা মানতে নারাজ।
ইসরাইলি বসতিগুলোর আশপাশ দিয়ে আরো বসবাস করছে অন্তত ২০ হাজার সিরিয়ার নাগরিক, যারা প্রধানত দ্রুজ সম্প্রদায়ের।
সিরিয়া বারবারই দাবি করছে, এই এলাকাটির মালিক তারা এবং মালিকানা পুনরুদ্ধার করা হবে। তবে ইসরাইলের দাবি, এই মালভূমি তাদের নিরাপত্তার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং এটা চিরকালই তাদের দখলে থাকবে।
এখন ইসরাইল গোলান মালভূমিতে কী করছে?
প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের পতনের পর বিদ্রোহী সিরিয়ার সেনারা গোলান মালভূমিতে তাদের চৌকিগুলো ছেড়ে যেতে শুরু করে। ঠিক তখনই বাফার জোন অতিক্রম করে ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী।
ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলছেন, তার বাহিনী এখানে সাময়িকভাবে প্রতিরক্ষামূলক অবস্থানে থাকবে।
‘সাময়িক’ এই ব্যবস্থা কত দিন থাকবে তার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘সিরিয়ার নতুন ক্ষমতাসীনদের সাথে যতক্ষণ না শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপিত হয়। তবে এটা না হলে ইসরাইল রাষ্ট্র ও এর সীমানা রক্ষার জন্য যা যা করা দরকার আমরা তার সবটাই করব।’
সিরিয়ান সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, ইসরাইলি বাহিনী দামেস্কের ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে চলে এসেছে, যদিও এটা স্বীকার করেনি ইসরাইল।
সিরিয়ায় ইসরাইলের সাম্প্রতিক এসব কর্মকাণ্ডের নিনন্দা জানিয়েছে আরব দেশগুলো। মিসরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এটাকে ‘সিরিয়ান ভূখণ্ডের ওপর দখলদারিত্ব এবং ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত লড়াই থেকে সরে আসার চুক্তির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন’ বলে মনে করেন।
লন্ডনের এসওএএস ইউনিভার্সিটির শিক্ষক গিলবার্ট অ্যাচকার বলেন, ‘সিরিয়ার দিক থেকে যেন ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার মতো কোনো ঘটনা না ঘটে সেটা ফেরানোর চেষ্টা করছে বলে দাবি করেছে ইসরাইল। এর মধ্যে দিয়ে অন্য যেকোনো পক্ষকে সীমান্তের কাছে আসতে বাধা দিচ্ছে তারা।’
তবে অনেক বিশেষজ্ঞ ইসরাইলের এই পদক্ষেপ নিয়ে সন্দিহান।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে লন্ডনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান চ্যাথাম হাউজের প্রফেসর ইয়োসি ম্যঅকেলবার্গ বলেন, ‘সিরিয়া তো বলেনি তারা বিদ্যমান চুক্তি মানবে না। ইসরাইল প্রতিরক্ষার কথা বলে আগ বাড়িয়ে এসব পদক্ষেপ নিয়েছে, অথচ যুদ্ধের কোনো উসকানি নেই।’
লন্ডনভিত্তিক আরেক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের ডক্টর এইচ এ হেলিয়ার বলেন, সিরিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো গোলানের দখল ফিরে পেতে অচিরেই হামলা চালাবে এমন কোনো সম্ভাবনা নেই।
তিনি বলেন, ‘তারা অভ্যন্তরীণ নানা বিষয় নিয়েই এতটা ব্যস্ত যে নতুন করে ইসরাইলের সাথে লড়াইয়ে জড়ানোর ভাবনা তাদের আসব না। খারাপ পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলে ইসরাইল যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে তা মূলত হিতে বিপরীত হতে পারে।’
সূত্র : বিবিসি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা