মধ্যস্থতা থেকে কাতারে সরে দাঁড়ালেও দোহায় হামাসের কার্যালয় থাকছে
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ১০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫:৩৮
গাজায় ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি এবং বন্দী মুক্তির আলোচনায় মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা থেকে আপাতত সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতার।
তবে দেশটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, যুদ্ধবিরতির বিষয়ে ইসরাইল ও হামাস ‘আন্তরিকতা দেখালে’ তারা আবারো মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় ফিরতে রাজি আছে।
এছাড়া দোহা থেকে হামাসের কার্যালয় তুলে দেয়ার বিষয়েও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানিয়েছে কাতার।
বিবৃতিতে কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ‘একটি চুক্তির বিষয়ে (গাজায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে) শেষবার প্রচেষ্টা চালানোর ১০ দিন আগে সবপক্ষকে অবহিত করা হয়েছিল যে ওই দফায় চুক্তির বিষয়ে সম্মত না হতে পারলে হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে মধ্যস্থতার প্রচেষ্টা বন্ধ করে দেবে কাতার।’
সেখানে আরো বলা হয়েছে, ‘উভয়পক্ষ নির্মম যুদ্ধের অবসান ঘটানোর বিষয়ে সদিচ্ছা ও গুরুত্ব দেখালে কাতার ওই (মধ্যস্থতার) প্রচেষ্টা আবারো শুরু করবে।’
এক যুগ আগে ২০১২ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা প্রশাসনের অনুরোধে রাজধানী দোহাতে হামাসকে রাজনৈতিক কার্যালয় স্থাপনের অনুমতি দিয়েছিল কাতার।
শনিবার বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়, গাজায় যুদ্ধবিরতির বিষয়ে চুক্তিতে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে দোহায় হামাসের রাজনৈতিক কার্যালয় বন্ধ করে দেয়ার বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একমত পোষণ করেছে কাতার।
এমন একটি সময় কাতার এই ঘোষণা দিলো যখন হামাসের বিরুদ্ধে গাজা যুদ্ধ অবসানের নতুন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার অভিযোগ তুলেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় কাতারে হামাসের প্রতিনিধিদের উপস্থিতি আর মেনে নেয়া হবে না বলেও জানিয়ে দিয়েছেন তারা।
তবে কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পাঠানো বিবৃতিতে অবশ্য জানানো হয়েছে, দোহায় হামাসের রাজনৈতিক কার্যালয় বন্ধের খবরটি সঠিক নয়।
হামাসের পক্ষ থেকেও একই কথা জানানো হয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যের গ্যাস সমৃদ্ধ দেশ কাতার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মিত্র দেশ। সেখানে একটি বড় মার্কিন বিমান ঘাঁটিও রয়েছে।
ইরান, তালেবান, রাশিয়াসহ বিশ্ব রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ অনেক সূক্ষ্ম ইস্যুতে আলোচনা এবং সংলাপের ক্ষেত্রেও কাতারকে ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে।
গাজায় ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে বছরব্যাপী যে যুদ্ধ চলছে, সেটি থামানোর লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও মিসরের পাশাপাশি কাতারও মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করে আসছিল।
যদিও দীর্ঘ আলোচনার পরও যুদ্ধবিরতির বিষয়ে ইসরাইল ও হামাস এখনো একমত হতে পারেনি।
এদিকে আলোচনা সফল না হলেও কাতারের সাথে হামাসের সম্পর্কের কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
গত জুলাই মাসে হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া নিহত হওয়ার পর দোহায় তিন দিনের শোকসভা করেছিল ফিলিস্তিনের সংগঠনটি।
কিন্তু সম্প্রতি হামাসের আরেক নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার নিহত হওয়ার পর দেখা যাচ্ছে, দোহায় একটি ছোট হলে দু’ঘণ্টার জন্য শোকসভা করেছে তারা।
গত বছরের শেষদিকে ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই যুদ্ধবিরতির বিষয়ে পক্ষ দু’টির সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে কাতার।
সবশেষ গত অক্টোবরের মাঝামাঝি সময় এই বিষয়ে ইসরাইল ও হামাসকে আলোচনার টেবিলে বসায় কাতার। কিন্তু সেখানে হামাস স্বল্পমেয়াদী যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।
ফলে কাতারের দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। তবে যুদ্ধবিরতির আলোচনা যেন পুরোপুরি ভণ্ডুল না হয়য়, সে জন্য দোহায় হামাসের রাজনৈতিক কার্যালয়টি থাকছে বলে জানিয়েছে দেশটি।
বিবৃতিতে কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ‘দোহায় হামাসের কার্যালয়ের বিষয়ে গণমাধ্যমের খবরগুলো সঠিক নয়। কার্যালয়টির মূল লক্ষ্য হলো যোগাযোগের একটি চ্যানেল হওয়া, যা (আগেও) যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্তের বিষয়ে ভূমিকা রেখেছে।’
কাতারের যত মধ্যস্থতা
মধ্যপ্রাচ্যের অনেকগুলো দেশ নিজেদের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে তুলে ধরতে চায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য মিসর, ওমান ও কুয়েত। তবে এদের ছাপিয়ে ওই অঞ্চলে কাতারই সঙ্কট সমাধান এবং আলোচনার উদ্যোক্তা দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
ইউক্রেন থেকে শুরু করে লেবানন, সুদান, ইরান, আফগানিস্তানসহ গাজা সঙ্কটে মধ্যস্থতা করেছে কাতার।
এর আগে ২০১৭ সালে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের সময় ইরাকে আটক বন্দীদের মুক্তির বিষয়ে সমঝোতায় সাহায্য করেছে কাতার। অবশ্য ওই বন্দীদের মধ্যে কাতারের ক্ষমতাসীন পরিবারের কয়েকজন সদস্যও ছিলেন।
এছাড়া ২০১৯ সালে আফগানিস্তানের তালেবানদের হাতে আটক দু’জন পাশ্চাতের বন্দীর মুক্তিতে মধ্যস্থতা করে কাতার। তালেবানরা ২০২১ সালে ক্ষমতায় আসার পর হাজার হাজার মানুষকে সরিয়ে নেয়ার বিষয়েও ভূমিকা রাখে কাতার। আর চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে বন্দী বিনিময়েও কাজ করে দোহা।
কাতারে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের আল-উদেইদ ঘাঁটি আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের সময় গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে কাজ করেছে। একইসাথে কাতার তালেবানদের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘ যুদ্ধের সমাপ্তি টানতে সমঝোতা আলোচনায় স্বাগতিক দেশ হিসেবেও কাজ করেছে।
এক দশক আগে ২০১৪ সালেও গাজায় ইসরাইলি সংঘাতের সময়ে মধ্যস্থতা করেছিল কাতার।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ছোট দেশ হলেও তরল গ্যাস সমৃদ্ধ ধনী এই দেশটি এক দিকে যেমন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে নিজেকে অপরিহার্য হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছে, একইসাথে প্রতিবেশী দুই বড় দেশ সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের অযাচিত হস্তক্ষেপ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে চেয়েছে। যার কারণে, সংঘাতের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে আবির্ভূত হতে চেয়েছে দেশটি।
মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক লেখক ও গবেষক আতেফ আল-শায়ের বলেন, ‘কাতার এরইমধ্যে বিশ্বের বেশ কিছু ঘটনায় যুদ্ধরত পক্ষগুলোর মধ্যে সফলভাবে মধ্যস্থতা করেছে। বিশেষ করে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে বন্দী বিনিময়ে কাতার ভূমিকা পালন করেছে।’
যুক্তরাষ্ট্র ও তালেবানদের মধ্যে মধ্যস্থতায়ও কাতার সফল হয়েছে। ফলে মধ্যস্থতাকারী দেশ হিসেবে কাতার আসলেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
আতেফ আল-শায়ের বলেন, ‘মানবিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সঙ্কট সমাধানে কাতার গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সংঘাতে যুক্ত থাকা দু’পক্ষের ব্যক্তিরাই কাতারে রয়েছে। আর কাতার নিজেও এই ভূমিকায় নিজেকে তুলে ধরতে চায়।’
সবার সাথে বন্ধুত্ব?
শেখ হামাদ বিন খলিফা আল থানি ১৯৯৫ সালে কাতারের আমির হওয়ার পর থেকে দেশটি মধ্যপ্রাচ্যে নিজেকে মধ্যস্থতাকারীর জায়গায় প্রতিষ্ঠা করে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাশ্চাত্যের দেশগুলো যেসব ‘রাষ্ট্র নয় এমন সত্ত্বা’ যেমন বিভিন্ন আদিবাসী ও বাহিনী যাদের সাথে আলোচনায় প্রস্তুত নয়, এমন সব প্রতিষ্ঠান বা গোষ্ঠীগুলোর সাথেও আলোচনা করে কাতার।
সময়ের সাথে সাথে এসব গোষ্ঠীর তালিকায় যুক্ত হয়েছে আফগানিস্তানের তালেবান, সিরিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠী, হামাস ও ফিলিস্তিনের অন্যান্য সংগঠন যেমন ইসলামিক জিহাদ।
বার্তাসংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের তথ্য মতে, কাতারে আশ্রয় নিয়েছেন হামাসের শীর্ষ নেতা খালেদ মাশাল। তিনি ১৯৯৭ সালে জর্ডানে ইসরাইলি হত্যাকাণ্ডের প্রচেষ্টা থেকে বেঁচে যান। এছাড়া হামাসের সুপ্রিম লিডার ইসমাইল হানিয়েহ কাতারে বাস করেছেন।
ইরানের সাথেও কাতারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। কয়েক বিলিয়ন ডলারের যৌথ প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্র রয়েছে তাদের।
গত কয়েক দশকে এ ধরনের সম্পর্ক কাতারকে এমন একটি অবস্থানে নিয়ে গেছে, যেখান থেকে দেশটি এই সংগঠনগুলোর সাথে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও ইসরাইলের চুক্তির বিষয়ে মধ্যস্থতা করে থাকে। দু’পক্ষের হয়েই চুক্তির বিষয়ে দর কষাকষি করে এই দেশটি।
এই অবস্থানকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ‘সবার বন্ধু, কারো বন্ধু নয়’ বলে উল্লেখ করেছেন।
সূত্র : বিবিসি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা