২৬ অক্টোবর ২০২৪, ১০ কার্তিক ১৪৩১, ২২ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

মধ্যপ্রাচ্য সংঘাত শেষ হবে কিভাবে?

চরম মানবিক বিপর্যয়ের মুখে গাজাবাসী। - ছবি : বিবিসি

এক বছর আগে ৭ অক্টোবর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় হামলার শিকার হয়েছিল ইসরাইল। তখন তারা ওই হামলার ধাক্কা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিল ঠিক-ই, কিন্তু সেইসাথে ফিলিস্তিনের গাজায়ও বিধ্বংসী বোমাবর্ষণ শুরু হয়ে গিয়েছিল।

তখনকার পরিস্থিতি দেখে মনে হয়েছিল, এবার সবকিছুর মোড় ঘুরে যাবে।

বিশ্ব দরবারে টানা অনেক বছর ধরেই ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত কিছু আড়ালে পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু ওই ঘটনাকে কেন্দ্রে করে আচমকা তা ফের আমাদের চোখের সামনে ফিরে এলো।

এই গোটা বিষয়টি সবাইকে অবাক করে দিয়েছিল তখন। ২০২৩ সালের অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে সংঘটিত ওই হামলার মাত্র এক সপ্তাহ আগে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান বলেছিলেন, ‘গত দুই দশকের তুলনায় মধ্যপ্রাচ্য আজ অনেকটাই শান্ত।’

কিন্তু জ্যাক সুলিভানের ওই বক্তব্যের পর আজ এক বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যে আগুন জ্বলছে।

এই সময়ে ৪১ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নাগরিক ইসরাইলি হামলায় নিহত হয়েছেন। গাজার দুই মিলিয়ন বা ২০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। পশ্চিম তীরে নিহত হয়েছেন আরো ৬০০ জন।

এই ধ্বংসযজ্ঞের রেষ ছড়িয়ে পড়েছে লেবাননেও। সেখানে ইসরাইলি হামলায় দুই হাজারের বেশি মানুষ নিহত ও অন্তত ১০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাস নজিরবিহীন হামলা চালিয়েছিল ইসরাইলে। ওই হামলার প্রথম দিনেই এক হাজার ২০০ জনের বেশি ইসরাইলি নিহত হন। এরপর গাজায় ৩৫০ জনের বেশি ইসরাইলি সেনা নিহত হয়েছেন।

গাজার কাছাকাছি ও লেবাননের উত্তর সীমান্ত এলাকায় বসবাসরত প্রায় দুই লাখ ইসরাইলি নাগরিক তাদের বাড়িঘড় ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। ওইসময় লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হেজবুল্লাহও ইসরাইলে রকেট হামলা চালিয়েছিল, তাতেও প্রায় ৫০ জন সামরিক ও বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন।

মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীও এই সংঘাতে যোগ দিয়েছে। তা থামাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নানা ধরনের চেষ্টা করেছে। যেমন– দেশটির প্রেসিডেন্টের সফর, অসংখ্য কূটনৈতিক মিশন, বিপুল সেনা-সরঞ্জাম মোতায়েন। কিন্তু সেসবের কোনো চেষ্টাই আসলে কাজে দেয়নি।

বরং, অনেক দূরের দেশ ইরাক ও ইয়েমেন থেকেও ইসরাইলকে লক্ষ্য করে রকেট ছোঁড়া হয়েছে।

শুধু তাই নয়, চিরশত্রু ইসরাইল ও ইরানের মাঝে পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনাও ঘটেছে। এটি সহসা থামবে বলে মনে হচ্ছে না, বরং ভবিষ্যতে যে আরো ঘটবে তা একপ্রকার নিশ্চিত।

মধ্যপ্রাচ্যে ওয়াশিংটনের প্রভাব আগের চেয়ে তুলনামূলক কম বলে মনে হচ্ছে।

ওই অঞ্চলের সংঘাত যেহেতু চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছে, তাই এর সূত্রপাতের ঘটনাও আমাদের স্মৃতি থেকে ঝাপসা হয়ে গেছে। অনেকটা ওই চলমান গাড়ির পেছনমুখী আয়না দিয়ে ফেলে আসা পেছনের দৃশ্য দেখার মতো।

গত বছরের ৭ অক্টোবরের আগে গাজার বাসিন্দাদের জীবন কেমন ছিল, তা মানুষ প্রায় ভুলতে বসেছে। কারণ গণমাধ্যম ক্রমাগত মধ্যপ্রাচ্যে একটি ‘সর্বাত্মক যুদ্ধের’ আশঙ্কার কথা বলছে।

ওইদিনের সেই ভয়ানক ঘটনায় কিছু ইসরাইলির জীবনও ওলট-পালট হয়ে গেছে। তারা অনেকে এখন অবহেলিত বোধ করছেন।

হামাস যাদেরকে বন্দী করে নিয়ে গিয়েছিল, তাদের একজন হলে নিমরোদ কোহেন। তার বাবা ইয়েহুদা কোহেন গত সপ্তাহে ইসরাইলি কান নিউজকে বলেন, ‘আমাদেরকে একপাশে সরিয়ে দেয়া হয়েছে।’

কোহেন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে এই যুদ্ধের জন্য দায়ী করে বলেন যে দেশকে একটি ‘অর্থহীন যুদ্ধের দিকে’ ঠেলে দেয়া হয়েছে। ইসরাইলি নাগরিকদেরকে সম্ভাব্য শত্রুদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়ার জন্য তিনি নেতানিয়াহুকে দায় দিয়েছেন।

‘৭ অক্টোবরের ঘটনাকে একটি মামুলি ব্যাপারে পরিণত করার জন্য তিনি (বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু) সফলতার সাথে সবকিছু করছেন’ বলেও মন্ত্যব্য করেন কোহেন।

অবশ্য সব ইসরাইলি-ই যে ইয়েহুদা কোহেনের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে একমত, বিষয়টা তেমন নয়। অনেকে হামাসের ওই আক্রমণকে অন্যভাবে দেখেন। তারা মনে করেন, ইহুদি রাষ্ট্রটিকে ধ্বংস করার জন্য ইসরাইলের শত্রুদের প্রথম পদক্ষেপ ছিল ৭ অক্টোবরের ওই হামলা।

তবে পেজার বিস্ফোরণ, বিভিন্নজনকে লক্ষ্য করে হত্যাকাণ্ড, দূর থেকে বোমা হামলা চালানো এবং গোয়েন্দাদের নেতৃত্বাধীন অভিযান পরিচালনাসহ আরো নানা উপায়ে ইসরাইলও আঘাত করেছে। এসব পদক্ষেপের মাঝ দিয়ে দেশটি তার এক বছর আগে হারিয়ে ফেলা আত্মবিশ্বাস পুনরুদ্ধার করেছে।

গত সপ্তাহে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু আত্মবিশ্বাসের সাথে ঘোষণা করেছেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে এখন এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে ইসরাইল পৌঁছাতে পারে না।’

৭ অক্টোবরের হামলার পর প্রধানমন্ত্রীর জনসমর্থন (ভোট রেটিং) তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল। কিন্তু এখন ফের তা ধীরে ধীরে বাড়তে দেখছেন তিনি।

তার জন্য এটি হয়তো আরো বড় কোনো দুঃসাহসী পদক্ষেপ গ্রহণের একটি ছাড়পত্র।

কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের সামগ্রিক পরিস্থিতি আসলে কোনদিকে যাচ্ছে?

‘আমরা কেউ-ই জানি না এই সংঘাত কখন থামবে এবং ওইসময় আমরা সবাই কোথায় থাকবো,’ সম্প্রতি বিবিসি’র টুডে পডকাস্টে এসে এ কথা বলেছিলেন ইরানে নিযুক্ত যুক্তরাজ্যের সাবেক রাষ্ট্রদূত সিমন গাস।

এই সঙ্কট মোকাবিলা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র এখনো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ডের (সেন্টকম) প্রধান জেনারেল মাইকেল কুরিলা’র সাম্প্রতিক সময়ের ইসরাইল সফর দেখে মনে হয়, কূটনৈতিক উপায় খোঁজার চেয়ে ব্যবস্থাপনার দিকে যুক্তরাষ্ট্র বেশি মনোযোগী।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আর চার সপ্তাহ বাকি এবং এখন মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বিষাক্ত অবস্থায় আছে। এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র কোনো সাহসী ও নতুন উদ্যোগ নিবে বলে মনে হয় না।

আপাতত যুক্তরাষ্ট্রের তাৎক্ষণিক চ্যালেঞ্জ হলো বিস্তৃত আঞ্চলিক সংঘাত প্রতিরোধ করা।

যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের ধারণা, গত সপ্তাহে ইরান ইসরাইলের ওপর যে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে, সেটির জবাব দেয়ার অধিকার আছে ইসরাইলের, এটি ইসরাইলের কর্তব্যও।

ওই হামলায় কোনো ইসরাইলি নিহত হয়নি। হামলার ধরন দেখে মনে হয়, সামরিক ও গোয়েন্দা লক্ষ্যবস্তু নিশানা করেছিল ইরান। কিন্তু নেতানিয়াহু ওই হামলার কঠোর জবাব দেয়ার অঙ্গীকার করেছেন।

কয়েক সপ্তাহের অভাবনীয় কৌশলগত সাফল্যের পর ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী এখন অনেক বড় উচ্চাকাঙ্ক্ষা পোষণ করছেন বলে মনে হচ্ছে।

সরাসরি ইরানের জনগণকে উদ্দেশ্য করে দেয়া ভাষণে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইঙ্গিত করেছেন যে তেহরানের সরকারে পরিবর্তন আসছে। ‘শেষ পর্যন্ত ইরান যখন মুক্ত হবে, তখন সবকিছু পাল্টে যাবে। সেই সময়টি এত তাড়াতাড়ি আসবে যে তা মানুষের ধারনারও বাইরে।’

২০০৩ সালে ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন আগ্রাসনের আগে মার্কিন নব্যরক্ষণশীলরা এমনভাবেই কথা বলতো। নেতানিয়াহু’র বক্তব্য যেন তাদের কথারই প্রতিধ্বনি।

কিন্তু এই মুহূর্তে এ ধরনের ঘটনার জন্য দুর্বল হলেও কিছু বাধা এখনো রয়ে গেছে।

ইরানের শাসকরা ইসরাইলবিহীন একটি বিশ্বের স্বপ্ন দেখতেই পারে, কিন্তু তারাও জানে যে এই অঞ্চলের একমাত্র পরাশক্তিকে মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে ইরান খুবই দুর্বল। বিশেষ করে, এমন এক সময়ে যখন ইরান সমর্থিত হামাস ও হেজবুল্লাহকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার চেষ্টা করছে ইসরাইল।

একইভাবে, ইরানের দেয়া হুমকি থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্তি পেতে চায় ইসরাইল। কিন্তু ইসরাইল জানে যে সাম্প্রতিক সময়ে তারা বিভিন্ন অভিযানে সফল হলেও তারা একা এই কাজ করতে পারবে না।

ইরানে সরকার পরিবর্তনের যে আশঙ্কা, তা মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের এজেন্ডা বা লক্ষ্যের মাঝে নেই। এমনকি, ভাইস প্রেসিডেন্টের এজেন্ডাতেও তা নেই।

২০১৯ সালের জুনে ইরান একটি মার্কিন সার্ভেইল্যান্স ভূপাতিত করার পর একপর্যায়ে মনে হয়েছিল যে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইরানে হামলা করার জন্য প্রস্তুত। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তিনি পিছু হটেন। যদিও এর ৭ মাস পর তিনি ইরানের শীর্ষ জেনারেল কাশেম সোলাইমানিকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

আজ থেকে এক বছর আগে খুব কম মানুষই কল্পনা করেছিল যে, মধ্যপ্রাচ্য এতটা বিপজ্জনক পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। গত কয়েক দশকের মাঝে এমনটা আসেনি।

মধ্যপ্রাচ্যের পথে পথে এখন অনেক ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। এখনে উদ্বেগজনক গতিতে নানান ধরনের ঘটনা ঘটছে সেখানে। নীতিনির্ধারকসহ সবাই এই পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে।

গাজা যুদ্ধ দ্বিতীয় বছরে পড়েছে। এই যুদ্ধ যখন শেষ পর্যন্ত সমাপ্ত হবে, তখন গাজাকে কিভাবে পুনর্গঠন ও পরিচালনা করা হবে, তা নিয়েও এখন কোনো কথাবার্তা হচ্ছে না।

ফিলিস্তিনিদের সাথে ইসরাইলের চলমান বিরোধ সমাধান নিয়ে আলোচনাও বন্ধ হয়ে গেছে।

কোনো একদিন যদি ইসরাইলের মনে হয় যে তারা হামাস ও হেজবুল্লাহ’র যথেষ্ট ক্ষতিসাধন করেছে বা যখন মার্কিন নির্বাচন শেষ হবে, তখন হয়তো সঙ্কট সমাধানের সুযোগ আসবে।

কিন্তু এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, সঙ্কট সমাধানের পথ আরো অনেক দূরে।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement
সম্মিলিত নূরানী শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান মাওলানা ইসমাইল, মহাসচিব মাওলানা হারুন জীবপ্রযুক্তিতে বৈষম্য ও এনআইবি’র ডিজি নিয়োগে জটিলতার প্রতিবাদ উদ্বোধনী দিনে সন্তোষজনক সাড়া পায়নি ‘কৃষিপণ্য স্পেশাল ট্রেন’ ‘ফ্যাসিবাদের প্রোডাক্ট’ রাষ্ট্রপতিকে যে কারণে সরানোর বিপক্ষে রিজভী দেশের মানুষ আর লগি-বৈঠার তাণ্ডব দেখতে চায় না : আব্দুল জব্বার সিরাজগঞ্জে সাবেক এমপি হেনরীর প্রধান সহযোগী গ্রেফতার শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের প্লট বাতিলের দাবিতে রূপগঞ্জে রাজউকের কার্যালয় ঘেরাও ‘বৈষম্যহীন ইনসাফপূর্ণ সমাজ গড়তে চায় জামায়াত’ ‘ইসরাইলি হামলা থেকে ফিলিস্তিনের অসহায় নারী, শিশু ও বৃদ্ধরাও রেহায় পাচ্ছে না’ ‘২৮ অক্টোবরের হত্যাকাণ্ড ছিল দেশ ও জাতিসত্তাবিরোধী ষড়যন্ত্র’ নাজমুলের অধিনায়কত্ব ছাড়ার আনুষ্ঠানিক চিঠি পাইনি : ফাহিম

সকল