০৬ অক্টোবর ২০২৪, ২১ আশ্বিন ১৪৩১, ২ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

মধ্যপ্রাচ্যকে সর্বাত্মক যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছে যে সপ্তাহটি

লেবাননে ইসরাইলের হামলা - সংগৃহীত

গত এক বছরে বিশ্বে অনেক বিপদের মুহূর্ত এসেছে। তবে এবারেরটি সব চেয়ে ভয়াবহ। গত সাত দিনে হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহকে হত্যা করা হয়েছে, ইসরাইল লেবাননে স্থল অভিযান শুরু করেছে এবং ইরান ইসরাইলের বেশ কয়েকটি স্থানে প্রায় ২০০টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে।

এমন অবস্থায় উত্তেজনা প্রশমনের জন্য জোর দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পাশ্চাত্য ও আঞ্চলিক শক্তিগুলো।

চলমান লড়াই অবিলম্বে বন্ধ করার জন্য জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদও আহ্বান জানায়। একইভাবে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জার্মানিসহ জি-সেভেনভুক্ত দেশগুলো ‘সংযত’ থাকার আহ্বান জানিয়ে আসছে।

কিন্তু এখন পর্যন্ত সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় ধারণা করা হচ্ছে যে মধ্যপ্রাচ্য সর্বাত্মক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে।

গত সপ্তাহের ঘটনাপ্রবাহ কেমন ছিল, তা জানতে পারবেন আজকের এই প্রতিবেদনে।

শুক্রবার সন্ধ্যা : নাসরুল্লাহকে হত্যা
২৭ সেপ্টেম্বর বৈরুতে সূর্যাস্তের সাথে সাথে শহরের দক্ষিণে একের পর এক প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটতে থাকে। বেশ কয়েকটি অ্যাপার্টমেন্ট ভবনে ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে মাটিতে বিশাল বিশাল গর্তের সৃষ্টি হয়। এতে লেবাননের রাজধানীর আকাশ ধসে পড়া ভবনগুলোর ধ্বংসাবশেষ ও ভারী ধুলোবালিতে ছেয়ে যায়।

একটি ভূগর্ভস্থ বাঙ্কার লক্ষ্য করে এই হামলাটি চালানো হয় বলে ধারণা করা হয়েছে। মূলত ওই হামলাতেই নিহত হন হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহ।

হাসান নাসরুল্লাহ ইসরাইলের হাতে নিহত হতে পারেন এমন আশঙ্কায় বহু বছর ধরে জনসমক্ষে আসেননি। তাই তাকে নিশানা করে হত্যার এই ঘটনাকে ‘প্রাইজ টার্গেট’ বলা হচ্ছে।

নাসরুল্লাহকে হত্যার পরও হিজবুল্লাহকে লক্ষ্য করে একের পর এক হামলা চালাতে থাকে ইসরাইল। এক সপ্তাহ জুড়ে চলতে থাকা লাগাতার হামলায় ৫০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে।

তারও এক সপ্তাহ আগে হিজবুল্লাহকে লক্ষ্য করে পর পর অসংখ্য ওয়াকি-টকি এবং পেজার বিস্ফোরণ ঘটনো হয়। এতে কমপক্ষে ৩২ জন নিহত এবং তিন হাজার জনের বেশি মানুষ আহত হয়েছিল।

নাসরুল্লাহর মৃত্যু ওই অঞ্চলে উত্তেজনা প্রশমনের সমস্ত আশা ও সম্ভাবনা নিশ্চিহ্ন করে দেয়, যা হামলার কয়েক ঘণ্টা আগেও সম্ভব বলে মনে হয়েছিল।

নিউইয়র্কে জাতিসঙ্ঘের সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে ২১ দিনের যুদ্ধবিরতির বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়েছিল।

ইসরাইলের জাতিসঙ্ঘের দূত ড্যানি ড্যানন বলেন, তারা এ বিষয়ে যেকোনো প্রস্তাবের বিষয়ে আলোচনার জন্য প্রস্তুত আছেন।

তবে হামলার কয়েক ঘণ্টা পর ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু নিউইয়র্ক থেকে সকালের একটি ফ্লাইটে ইসরাইলে ফিরে যান। এতে করে কূটনৈতিক এই সমস্যা সমাধানের যেটুকু আশা ভরসা ছিল সেটাও ম্লান হয়ে পড়ে।

সোমবার রাত : লেবাননে ইসরাইলের হামলা
তিন দিন পর ইসরাইলি বাহিনী লেবাননে প্রবেশ করে এবং একটি স্থল অভিযান শুরু করে। ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) বলছে, তাদের অভিযান হবে সীমিত পরিসরে এবং নির্দিষ্ট নিশানা বরাবর।

লেবাননের ক্রাইসিস ইউনিটের মতে, যুদ্ধের কারণে এখন পর্যন্ত লেবাননের প্রায় ১২ লাখ মানুষ তাদের বাড়িঘর থেকে বিতাড়িত হয়েছে। এতে অন্তত আটজন ইসরাইলি সেনা সদস্য নিহত হয়েছেন।

ইসরাইল বলেছে, হিজবুল্লাহ যেন সীমান্তে আর কোনো রকেট এবং ড্রোন হামলা চালাতে না পারে সেই সক্ষমতা দমন করার লক্ষ্যেই তারা এই অভিযান চালাচ্ছে।

ইসরাইল হামাসের বিরুদ্ধে প্রায় প্রতিদিন এ ধরনের অভিযান চালাচ্ছে।

ফিলিস্তিনের হামাস প্রায় এক বছর আগে দক্ষিণ ইসরাইলে একটি মারাত্মক অভিযান পরিচালনা করেছিল।

বর্তমানে ইসরাইলি সৈন্যরা গাজা ও লেবানন- দু’টি স্থানে একই সাথে স্থল অভিযান পরিচালনা করছে। যা গত কয়েক দশকে দেখা যায়নি।

২০০৬ সালে ইসরাইল এবং হিজবুল্লাহর মধ্যে শেষ যুদ্ধ হয়েছিল, যা পরে জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাব ১৭০১-এর মাধ্যমে পুরোপুরি শেষ হয়।

পরে হিজবুল্লাহ দক্ষিণ লেবানন থেকে তার বাহিনী প্রত্যাহার করে নেয়। এমনটা আগে কখনোই ঘটেনি এবং ইরানের সমর্থনে হিজবুল্লাহর শক্তি বৃদ্ধি পায়।

ইসরাইল বলেনি যে তারা লেবাননের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে হিজবুল্লাহকে পুরোপুরি সরিয়ে দিতে চায় (যেমন এখন গাজায় হামাসের ক্ষেত্রে বলছে)।

তবে তারা এখন ‘সীমিত পরিসরে এবং নিশানা লক্ষ্য করে’ অভিযান চালানোয় এটা স্পষ্ট যে ইসরাইল হিজবুল্লাহকে দমন করার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

মঙ্গলবার সন্ধ্যা : ইসরাইলে ইরানের হামলা
পরের দিন, স্থানীয় সময় সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে ইরান ইসরাইলে প্রায় ২০০টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। এ অবস্থায় এক কোটি ইসরাইলিকে বোমা থেকে বাঁচানোর জন্য সারাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আশ্রয়কেন্দ্রে দ্রুত পাঠানো হয়।

এরপর ইসরাইলের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বেশ সক্রিয় হয়ে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যসহ মিত্র দেশগুলো ইরানের হামলা প্রতিহত করার জন্য উঠেপড়ে লাগে। যা সঙ্ঘাত আরো বেড়ে যাওয়ার একটি লক্ষণ।

আইডিএফ বলছে, বেশিভাগ ক্ষেপণাস্ত্র তারা আটকে দিতে পেরেছে, তবে অল্প সংখ্যক ক্ষেপণাস্ত্র ইসরাইলের মধ্য ও দক্ষিণাঞ্চলে ‌আছড়ে পড়েছে।

এই হামলায় দখলকৃত পশ্চিম তীরে একজন ফিলিস্তিনি ব্যক্তি নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

যখন তাদের ছায়াযুদ্ধের প্রধান সহযোগীরা লণ্ডভণ্ড অবস্থায় আছে, তখন পরিণাম সম্পর্কে শত্রুদের মনে ভীতি তৈরি করার জন্য তেহরানকে বিশেষ কিছু করতে হবে।

সেটা অবশ্যই গত এপ্রিল মাসে আগে থেকে জানিয়ে দেয়া ক্ষেপণাস্ত্র আর ড্রোন হামলার চেয়ে নাটকীয় কিছু হতে হবে।

তারই ধারাবাহিকতায় ইরান এবার বিপুল সংখ্যক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে এবং সেটা আগে থেকে কোনো সতর্কতা দেয়া ছাড়াই।

তবে পুরোদমে এই হামলা চালানোর কারণে একটি ধারণাই স্পষ্ট হয় যে ইসরাইলের বিরুদ্ধে একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ চায় ইরান।

ইসরাইলের শক্তিশালী পাশ্চাত্যের মিত্ররা এবং মধ্যপ্রাচ্যে তাদের গুটিকয়েক প্রতিবেশী মিত্র ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহতের জন্য ইসরাইলকে সাহায্য করার ব্যাপারে আগ্রহী, যা একটি আঞ্চলিক পরাশক্তিতে রূপ নিতে পারে।

ইরান অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর। এমনকি তাদের কোনো শক্তিশালী মিত্রবাহিনীও নেই যারা সঙ্ঘাতের ক্ষেত্রে তাদের প্রতিরক্ষায় এগিয়ে আসতে চায়।

তবে সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি, তেহরানে জুমার নামাজে খুতবায় প্রতিবাদী আওয়াজ তোলেন।

এরপর কী?
হিজবুল্লাহর ভয়াবহ ক্ষতি হওয়া সত্ত্বেও তারা লেবাননে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেছে। এবং ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে ইসরাইলের পক্ষে লেবাননে প্রবেশ করা সহজ, কিন্তু তাদের পক্ষে ফিরে যাওয়া কঠিন।

ইরানের এই হামলার পর ইসরাইল কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে তা নিয়ে পুরো মধ্যপ্রাচ্য, এমনকি গোটা বিশ্ব মঙ্গলবার থেকে ব্যাপক উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরাইলের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, তারা যেন প্রতিশোধ নেয়ার অংশ হিসেবে ইরানের পারমাণবিক বা তেল স্থাপনায় হামলা না চালায়।

যদিও ইসরাইল এখন বড় ধরনের জবাব দেবে বলেই মনে হচ্ছে এবং বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সাম্প্রতিক কিছু বক্তব্য থেকে বোঝা যায় যে তিনি শেষ পর্যন্ত ইরানে শাসন পরিবর্তনের কথা ভাবছেন।

ইসরাইলের প্রত্যাশা হলো গাজায় ‘সম্পূর্ণ বিজয়’ এবং উত্তর সীমান্তে হিজবুল্লাহর হুমকি দূর করা। তবে ইসরাইলের এই নিশানাগুলো তাদের নিজেদের ভূখণ্ডের খুব কাছাকাছি।

ইসরায়েলি নেতারা উল্লেখ করেছেন, তারা এখন অনেক অঞ্চলে যুদ্ধ করছেন। বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এমন সাতটি অঞ্চলের কথা উল্লেখ করেছেন। এগুলো হলো- গাজা, লেবানন, পশ্চিম তীর, ইয়েমেন, ইরান, ইরাক ও সিরিয়া।

এটা সত্যি যে গত এক বছরে এই সমস্ত দিক থেকে হামলা হয়েছে। যদিও ইরাক এবং সিরিয়ায় ইরানপন্থী গোষ্ঠীগুলো এখন পর্যন্ত বড় ধরনের কোনো হুমকি তৈরি করতে পারেনি।

এখনই হয়তো কোনোসর্বাত্মক আঞ্চলিক যুদ্ধ দেখা যাবে না, কিন্তু অনেক অংশীদাররা মনে করে যে তাদের কিছু করার রয়েছে।

ফলে গাজা যুদ্ধ এখন বেশ নাটকীয়তার সাথে মধ্যপ্রাচ্যের অন্য অনেক এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে।
সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement
বিএনপির দাবি নির্বাচনী রোডম্যাপ, জামায়াত চায় আগে সংস্কার বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে নারায়ণগঞ্জের মসজিদসহ শতাধিক স্থাপনা ‘রংপুরে প্রত্যেকটি মন্দির পাহারা দিবে জামায়াত শিবির নেতাকর্মীরা’ ব্যাটিং-ব্যর্থতায় ইংল্যান্ডের কাছে হার বাংলাদেশের নৌবাহিনীর অভিযানে মাদকসহ ২ ব্যবসায়ী আটক তারাগঞ্জে মহাসড়ক অবরোধ, ১০ কিলোমিটার এলাকা যানজট সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে আ’লীগ নেতা গ্রেফতার অন্যায় করে পার পাওয়া যায়, এ সংস্কৃতি থেকে বের হতে হবে : অর্থ উপদেষ্টা নোয়াখালীতে বৃদ্ধ বাবাকে পিটিয়ে হত্যা করল ছেলে সরকারি চাল বিক্রি করে ভারতে পালানোর সময় খাদ্য কর্মকর্তা আটক কেরানীগঞ্জে খাবারের দোকানে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ, নিহত ৩

সকল