২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৯ আশ্বিন ১৪৩১, ২০ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

ইসরাইলি হামলা অব্যাহত, নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে লেবানিজরা

ইসরাইলি হামলা অব্যাহত, নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে লেবানিজরা - সংগৃহীত

ইসরাইলি বোমা বর্ষণে লেবাননে আতঙ্ক বিরাজ করছে। তীব্র আক্রমণের জেরে দক্ষিণ লেবাননের অনেক পরিবারই ঘরবাড়ি ছেড়ে গেছেন। কোনোরকম জিনিসপত্র নিয়ে গাড়ি, ট্রাক বা মোটরসাইকেলে করে উত্তরের দিকে যাচ্ছেন তারা।

ইসরাইলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তাদের লক্ষ্যবস্তুগুলো লেবাননের শিয়া সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লার সাথে জড়িত।

বাড়িছাড়া বাসিন্দাদের কেউ কেউ জানিয়েছেন, ‘শিয়া গোষ্ঠী যে এলাকাগুলোতে অবস্থান করছে তার আশপাশের এলাকাগুলো ছেড়ে যেতে খবর পাঠিয়েছে ইসরাইলি সামরিক বাহিনী। তাদের পক্ষ থেকে লিখিত বার্তা ও ভয়েস রেকর্ডিংয়ের মাধ্যমে সতর্ক করা হয়েছে।’

দক্ষিণাঞ্চলের শহর নাবাতিয়েহের জাহরা সাওলি নামে এক শিক্ষার্থী জানান, তার এলাকায় তীব্র মাত্রায় বোমা বর্ষণ করা হয়েছে।

সাওলি বলেন, ‘সকাল ৬টার দিকে বোমা বর্ষণের শব্দ শুনে আমার ঘুম ভেঙে যায়। দুপুরের দিকে বোমা বর্ষণ আরো তীব্র হতে শুরু করে। আমার এলাকায় প্রচুর পরিমাণে বোমা বর্ষণ হতে দেখেছি। একইসাথে অনেক কাচ ভাঙার শব্দও শুনতে পেয়েছি।’

জাহরা সাওলি এবং তার সাথে যারা ছিলেন, তারা বাড়ি থেকে বের হননি। তারা বাড়ি থেকে বের হওয়ার সাহস পাননি। এদের মতো আরো অনেক মানুষ আছেন যারা ঘরবাড়ি ছেড়ে যাননি।

জাহরা সাওলির কথায়, ‘আমরা কোথায় যাব? এখনো রাস্তায় অনেক মানুষ আটকে আছেন। আমার অনেক বন্ধু এখনো রাস্তায়, যানজটে আটকে আছে। মানুষ পালানোর চেষ্টা করছে।’

উপকূলীয় মহাসড়কের ছয় লেনের দু’পাশ দিয়ে সরাসরি রাজধানীর দিকে গাড়ি চলাচল করেছে। যার কারণে দিনের মাঝামাঝি সময়ে বৈরুতে উত্তরের রাস্তাগুলো যানজটে ভরে গেছে। আবার অন্য ছবিতেও দেখা গেছে বিমান হামলায় বিধ্বস্ত গ্রামগুলো থেকে কুণ্ডলি পাকিয়ে ধোঁয়া উঠছে। মানুষ কিভাবে দক্ষিণাঞ্চলের শহর টায়ারের সমুদ্র সৈকত ধরে হেঁটে যাচ্ছে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য।

মোটরচাইকেলে করে বৈরুতে আসা পাঁচ সদস্যের একটি পরিবার দক্ষিণের এক গ্রাম থেকে উত্তরে ত্রিপোলির দিকে যাচ্ছিল। অভিভাবক ও সাথে থাকা তিন ছেলে ভীষণভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।

তিন সন্তানের ওই বাবা বলেন, ‘আমাদের কী বলতে বলছেন? আমাদের পালাতেই হতো।’

লেবাননের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের থেকে জানানো হয়েছে, সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত বোমা হামলায় ৪৯২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এতে আহত হয়েছেন এক হাজার ৬০০ জনেরও বেশি মানুষ। নিহতদের মধ্যে ৩৫ জন শিশু রয়েছে বলেও জানা গেছে।

এদিকে, ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) জানিয়েছে, গেল ২৪ ঘণ্টায় তারা এক হাজার ১০০ বার হামলা চালিয়েছে। এ হামলার তালিকায় দক্ষিণ বৈরুতে একটা বিমান হামলাও রয়েছে। একজন সিনিয়র হিজবুল্লার কমান্ডারকে লক্ষ্য করে ওই হামলা চালানো হয়েছে বলে আইডিএফ জানায়।

উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় রয়েছে বৈরুতেও। নিজেদের বাড়ি-ঘর ছেড়ে গাড়িতে করে সুটকেস বেঁধে দক্ষিণ থেকে রাজধানী বৈরুতে আসছে মানুষ, আবার শহর ছেড়েও চলে যেতে দেখা গেছে অনেক বাসিন্দাদের।

বেসামরিক নাগরিকদের উদ্দেশ্যে সতর্কবার্তা জারি করেছে ইসরাইলি সামরিক বাহিনী। কিছু কিছু এলাকায় হিজবুল্লাহ অস্ত্র মজুদ করে রেখেছে এমন দাবি জানিয়ে সেই জায়গাগুলো খালি করার জন্য নির্দেশনা দিয়েছে। একইসাথে বৈরুতের যেসব জেলাকে হিজবুল্লার শক্ত ঘাঁটি হিসেবে বিবেচনা করা হয় না, ওই এলাকার বাসিন্দাদেরও রেকর্ড করা সতর্কবার্তা পাঠানো হয়েছে।

এর মধ্যে হামরাও আছে। যেখানে সরকারি মন্ত্রণালয়, ব্যাংক এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রয়েছে। হামরার বাসিন্দারাও একই সতর্কবার্তা পেয়েছেন। ওই এলাকাগুলো ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য একের পর এক সতর্কবার্তা পাওয়ার পর অভিভাবকরা বাচ্চাদের স্কুল থেকে নিয়ে আসার জন্য ছুটে যান।

তাদের মধ্যে একজন হলেন ইসা। তিনি তার ছেলেকে স্কুল থেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো করে এসেছিলেন।

বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে ইসা বলেছেন, ‘ফোন কলগুলোর কারণে আমরা এখানে এসেছি। তারা সবাইকে ফোন করে হুমকি দিচ্ছে। তাই ছেলেকে স্কুল থেকে নিয়ে যেতে এসেছি। পরিস্থিতি একেবারেই স্বস্তিদায়ক নয়।’

ফিলিস্তিনি নাগরিক মুহাম্মদ সস্ত্রীক বৈরুত ছেড়ে যাওয়ার পথে রাজধানীতে থাকবেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখন লেবাননের কোনো জায়গাই নিরাপদ নয়। ইসরাইল জানিয়েছে, তারা সব জায়গায় বোমা হামলা চালাবে। এখন এই এলাকাতেও হুমকি দিচ্ছে। তাহলে আমরা কোথায় যাব?।’

তিনি অসহায়ত্বের কথা জানিয়ে বলেন, ‘এ এক আতঙ্কের পরিবেশ। আমি কী করব জানি না, কী কাজ করব, কোথায় যাব কিছুই জানি না।’

এক ট্যাক্সিচালক বলেন, ‘বৈরুতেও অনেক মানুষ চলে আসছে।’

এমন পরিস্থিতিতে লেবাননের দক্ষিণ অঞ্চল ছেড়ে চলে আসা মানুষের জন্য তাড়াহুড়ো করে স্কুলগুলোকে আশ্রয়কেন্দ্রে পরিণত করা হয়েছে। সরকারি আদেশে বৈরুত, ত্রিপোলি ও পূর্ব লেবাননের স্কুলগুলোকে আশ্রয়কেন্দ্র করা হয়েছে।

সোমবার উত্তর-পূর্ব লেবাননে হিজবুল্লাহর মজবুত ঘাঁটি বেকা উপত্যকা ছেড়ে চলে আসা মানুষকে আশ্রয় দিতে তৈরি করা হচ্ছিল পশ্চিম বৈরুতের বির হাসানের একটা পাবলিক স্কুলের একটা ক্লাসরুম। ইসরাইলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল বেকা উপত্যকাও তাদের লক্ষ্যের মধ্যে একটা। ফাঁকা ক্লাসরুমে ওই সময়ে সারি সারি তোশক জড়ো করা থাকলেও দিনের শেষে ওই কক্ষ পুরোপুরি ভরে যাবে বলে জানিয়েছিলেন সেখানকার কর্মীরা।

এদিকে, লেবাননের হাসপাতাল আহত মানুষে ভরে গেছে। পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে হাসপাতালে জরুরি ভিত্তিতে অস্ত্রোপচার ছাড়া অন্য সব ধরনের অস্ত্রোপচার আপাতত বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সোমবারই এ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

বৈরুতে আতঙ্ক ও অনিশ্চিত পরিবেশ থাকার পরও কিছু মানুষ প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন। সেই প্রতিবাদীদের মধ্যে এক ব্যক্তি বিবিসিকে বলেছেন, ‘যদি পুরোপুরিভাবে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়, তাহলে আমাদের দলমত নির্বিশেষে লেবাননের জনগণ হিসেবে দাঁড়ানো দরকার। কারণ দিন শেষে আমাদের দেশেই বোমা ফেলা হচ্ছে।’

কেউ কেউ আবার সহিংসতার কাছেই ‘আত্মসমর্পণ’ করেছেন। বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে মোহাম্মদ সিবাই নামে এক ব্যক্তি বলেন, ‘যদি তারা যুদ্ধ চায়, তাহলে আমরা কী-ই বা করতে পারি? এটা আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। আমরা কিছুই করতে পারছি না।’ পেশায় ব্যবসায়ী তিনি, একটা দোকান চালান।

রাজধানী বৈরুতের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহরতলী দাহিয়েহের বাসিন্দা ৫৭ বছর বয়সী মুহাম্মদ বলেন, ‘হিজবুল্লার প্রধান ঘাঁটি নামে পরিচিত এ অঞ্চল। ১৯৭৫ সাল থেকে এই যুদ্ধের মধ্যেই বেঁচে আছি। কোথাও যাব না, আমি আমার বাড়িতেই থাকব।’
সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement