২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

মার্কিন নতুন শ্রমনীতি: পোশাক শিল্পে আপদের ওপর বিপদ

-

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন শ্রমিকদের ক্ষমতায়ন, শ্রম অধিকার ও তাদের মানসম্মত জীবনযাপন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সম্প্রতি একটি স্মারকে (প্রেসিডেন্সিয়াল মেমোরেন্ডাম) স্বাক্ষর করেছেন। বিশ্বজুড়ে শ্রম অধিকার নিশ্চিতে যুক্তরাষ্ট্রের এ নতুন নীতি ও বিশ্ব পরিস্থিতিসহ আরো কিছু কারণে দুশ্চিন্তায় পড়েছে বাংলাদেশের রফতানিকারকরা। বিশেষ করে পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা উদ্বেগ জানিয়ে বলেছেন, কোনো কারণে শ্রম অধিকার ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র নতুন নীতি বাংলাদেশের ওপর কার্যকর করলে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে আমাদের রফতানি খাতে। তাই বাংলাদেশের পোশাক শিল্পসংশ্লিষ্টরা বেশ দুশ্চিন্তায়। ক্ষমতাসীনরা কিছুতে কিছু হবে না ভাব নিলেও সংশ্লিষ্টরা ভালো করে জানেন, যুক্তরাষ্ট্র শ্রম অধিকার ইস্যুতে নতুন নীতিটি বাংলাদেশের ওপর কার্যকর করে বসলে কী হতে পারে? এ শিল্পে তথা দেশের রফতানি খাত যে কোন মাত্রায় দুমড়েমুচড়ে পড়বে, তার হিসাব তাদের কাছে আছে। গত কয়দিন ধরে এ নিয়ে পোশাকশিল্প মালিকদের ঘুম হারাম অবস্থা।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানির বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র। দেশটিতে পোশাক রফতানিতে তৃতীয় শীর্ষ দেশ বাংলাদেশ। পোশাক ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রে হোম টেক্সটাইল, হিমায়িত মৎস্য, চামড়াজাত পণ্য, প্লাস্টিকসহ আরো নানা পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশ। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে মোট ৯৭০ কোটি ডলারের বাংলাদেশী পণ্য রফতানি হয়েছে। যার মধ্যে তৈরি পোশাক ৮৫১ কোটি ডলার।
বেশ কিছু দিন ধরে দেশে তৈরি পোশাক খাতে শ্রমিক অসন্তোষ বিরাজ করছে। সরকার হুমকি-ধমকিসহ নানা আয়োজনে দমনের চেষ্টা করছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও তা গুরুত্বের সাথে প্রচারিত হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পর্যবেক্ষক দলও ঠিক এমন সময় বাংলাদেশ ঘুরে গেছে। শ্রমিকদের আন্দোলন দমাতে সরকারের কঠোর অবস্থান, শ্রমিকদের ওপর পুলিশি হামলা, মামলা, ধরপাকড় থেকে শুরু করে শ্রমিক হত্যার ঘটনাও দেখে গেছেন তারা।

যা দেখার-বোঝার, তারা দেখেছেন। বুঝেছেনও। এমনিতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চলতি বছর পোশাক রফতানি কিছুটা নেতিবাচক ধারায় রয়েছে। ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই থেকে অক্টোবর চার মাসে যুক্তরাষ্ট্রে তৈরী পোশাক রফতানি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩ শতাংশের বেশি কমেছে। এখন নতুন এ শ্রমনীতি প্রয়োগ হলে কী অবস্থা দাঁড়াবে এ খাতে?
যুক্তরাষ্ট্র শুধু বাংলাদেশের জন্য এ পদক্ষেপ নেয়নি। তবে, উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশের নাম উচ্চারিত হয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেনের মুখে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের শ্রমিকদের ক্ষমতায়ন, শ্রম অধিকার ও শ্রমিকদের মানসম্মত জীবনযাপন নিশ্চিতের লক্ষ্যে ‘মেমোরেন্ডাম অন অ্যাডভান্সিং ওয়ার্কার এমপাওয়ারমেন্ট, রাইটস অ্যান্ড হাই লেবার স্ট্যান্ডার্ডস গ্লোবালি’ শীর্ষক একটি স্মারকে সইয়ের খবরটি ১৬ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছেন তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন। তখন তিনি বলেছেন, প্রয়োজনে নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা।
শ্রম অধিকার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের ঘোষণা এমন এক সময়ে এসেছে, যখন বাংলাদেশে পোশাক খাতে ন্যূনতম মজুরি নিয়ে চলছে অস্থিরতা। ন্যায্য মজুরির দাবিতে শ্রমিকরা আন্দোলন করছেন, জীবন দিচ্ছেন। এ ছাড়া নির্দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দাবিতে মাঠের বিরোধী দল বিএনপিসহ সমমনা অন্য দলগুলোর হরতাল-অবরোধ চলছে। অন্যদিকে বিরোধী দলের এ দাবির সপক্ষে অর্থাৎ এ দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি কার্যকর করেছে। এ পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র শ্রম অধিকারবিষয়ক নতুন এ নীতিও কার্যকর করলে সেটি হবে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের তরতাজা উদাহরণ। পোশাক শিল্প শ্রমিকরা এতে বেশ খুশি।

বাংলাদেশের সোনালি আঁশ পাট এখন অতীতের বিষয়। চা-শিল্পও প্রায় তা-ই। বিদেশে শ্রমশক্তি রফতানিও টিকে আছে কোনোমতে। এখন পর্যন্ত মোটা দাগের ভরসা হচ্ছে তৈরী পোশাক শিল্প। অর্থনীতির জন্য এটি যেন সোনার ডিম পাড়া হাঁস। রফতানি খাতে সর্বাধিক আয়কারী এবং সবচেয়ে বেশি বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্টকারী শিল্প খাত এটি। যাত্রা শুরুর পর থেকে নানা সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা খাতটিতে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পোশাক শ্রমিকদের সময়মতো বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা না দেয়া, বকেয়া বেতন-বোনাস পরিশোধে অনিয়ম-বিলম্ব, কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের নিরাপত্তা ঝুঁকি, ভবন ও অগ্নিদুর্ঘটনার প্রকোপ, ব্যবসায়ী-মালিকদের অপেশাদার আচরণ, নকল ও নিম্নমানের পোশাক রফতানি, নারী শ্রমিকদের প্রতি বৈষম্য, গ্যাস-বিদ্যুতের সঙ্কট, কাঁচামাল আমদানি জটিলতা, অনাকাক্সিক্ষত শ্রমিক ছাঁটাইসহ নানা সমস্যার মধ্যেও খাতটি এগিয়েছে। কিন্তু, সোনার ডিম পাড়া হাঁসটির যে যতœআত্তি দরকার তা করা হয়নি; বরং করা হয়েছে বিপরীতটি। পুরোনো সেসব সমস্যা সমাধান না করে আরো সমস্যা ও জটিলতা পাকানো হয়েছে। আপদের ওপর বিপদের মতো চেপেছে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শ্রম অধিকার নীতি ঘোষণা। নারীর অবদান এ খাতকে এক অন্যান্য পর্যায়ে নিয়ে গেছে। অথচ নারী শ্রমিকদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ, পুরুষদের তুলনায় কম মজুরি, অনিয়মিত বেতন-ভাতা, কর্মক্ষেত্রে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার অভাব, যৌন হেনস্তার শিকার হওয়া, সময়মতো পদোন্নতি না পাওয়া, অপর্যাপ্ত মাতৃত্বকালীন ছুটি ইত্যাদি সমস্যা যেন দিনে দিনে বেড়ে চলেছে। সেলাই ও অপারেটরের কাজ ছাড়া বড় কোনো পদে তাদের পদোন্নতি হয় না বললে চলে। কিছু গার্মেন্টে মাতৃত্বকালীন ছুটি দিলেও তা ছয় মাসের জায়গায় তিন মাস দেয়া হয়। এ অবস্থায় খাতটিতে নারীদের অংশগ্রহণ নিয়েও দেখা গেছে তীব্র অসন্তোষ। পোশাক শ্রমিকদের এ পেশায় বয়স নিয়েও পড়তে হয় বিশাল বিপাকে। এ যেমন দেশের সরকারি চাকরিতে অবসরের বয়সসীমা সাধারণত ৫৯ বছর হলেও পোশাককর্মীরা, বিশেষ করে নারীকর্মীরা ত্রিশের কোঠা পার হলে চাকরি নিয়ে শঙ্কায় পড়ে যান। তাদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা কাজে না লাগিয়ে তখন তাদের বাদ দিয়ে কম বেতনে নতুন কর্মী নিয়োগ দেয়া হয়। অল্প বয়সে চাকরি হারানোর শঙ্কায় এ পেশায় অসন্তোষ বাড়ছে যা এ খাতের জন্য মোটেও শুভলক্ষণ নয়।
শ্রমিকদের বিপরীতে মালিকদের সবাই যে খুব আয়েশে আছেন তাও নয়। গ্যাস-বিদ্যুৎ সঙ্কটে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় লোকসান গুনতে হয় কখনো। কাঁচামাল আমদানিতে প্রায় পড়তে হয় নানা ঝামেলায়। আমদানি ব্যয় বেড়েছে, বিশেষ করে আমদানি পণ্য পরিবহনে ব্যয় বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। এসব দুর্গতির মধ্যে যোগ হয়েছে বৈশ্বিক মন্দা ও ডলার সঙ্কট। এতে আমদানি-রফতানিতে তীব্র নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এর মধ্যে আবার রাজনৈতিক অস্থিরতা। কূটনীতিরও এ নাজুক পরিস্থিতি। তার মধ্যে আপদের ওপর বিপদের মতো চেপেছে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শ্রম অধিকার নীতি ঘোষণা।

গার্মেন্ট সেক্টরে বাংলাদেশের ভালো খবর প্রতিবেশী ভারতের জন্য মন্দ সংবাদ। আর মন্দ খবরগুলো তাদের জন্য খোশখবর। সূত্র মতে, পোশাক কারখানাগুলোর জেনারেল ম্যানেজার, প্রোডাকশন ম্যানেজার, অ্যাকাউন্টস ম্যানেজার, মার্চেন্ডাইজারের মতো পদে কর্মরতদের বেশির ভাগ বিদেশী। ওই বিদেশীদের বেশির ভাগই আবার ভারতীয়। এরা একেকটি গার্মেন্টে বড় ফ্যাক্টর। বিশ্বস্ত সূত্রে আরো জানা যায়, বন্ধ হয়ে যাওয়া কোনো পোশাক কারখানা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে হাতে নিয়ে নেয় তারা। কখনো কখনো গণ্ডগোল পাকিয়ে কারখানা বন্ধ করা এবং সেটি তাদের হাতে কন্ট্রাক্টে ছেড়ে দিতে মালিককে বাধ্য করে তারা। দেশে তালিকাভুক্ত বায়িং হাউজের বেশির ভাগ ভারতীয়দের দখলে। অনেক সময় নিজস্ব এজেন্টদের মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে শ্রমিক অসন্তোষ ছড়িয়ে দেয়ার কারসাজিও করে এরা। গার্মেন্ট কারখানাগুলোতে এবারের শ্রমিক অসন্তোষ ও নাশকতার পেছনে তারা জড়িত কি না, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন বৈকি। কিন্তু, আসন্ন নির্বাচন ও রাজনৈতিক-কূটনৈতিক বাস্তবতায় এ সময়ে সেদিকে দৃষ্টিপাতের ফুরসত নেই। তবে, পোশাক শিল্পে যুক্তরাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে বাজার যে ভারতমুখী হয়ে যাবে- তাতে কোনো রাখঢাক থাকবে না।
প্রকাশ্যে কিছু বলতে না পারলেও বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজের এটি আরেক কারণ। ভারত গত বছর কয়েক ধরে বস্ত্র ও পোশাক খাতে যে মাত্রায় বিনিয়োগ করছে, সেই তথ্য আছে বাংলাদেশের এ খাতের বিনিয়োগকারীদের কাছে। শুধু ভারত নয়, বাংলাদেশের গার্মেন্ট খাতের লাগাম টানার বিদেশী মহলের অভাব নেই। সুযোগ পেলে খাবলে ধরে। রানা প্লাজার মতো দুনিয়া কাঁপানো দালানধসের পর রিটেইল পুঁজিপতিরা অ্যাকর্ড ও আল্যায়েন্স নামে দুটো কারখানা পরিদর্শক গড়ে তুলেছেন, যাদের কাজ হলো গার্মেন্ট কারখানাগুলো আরো পরিবেশবান্ধব করে তোলা। ওই পথেও বাংলাদেশের এ খাতকে কম পরীক্ষা দিতে হয়নি। তাদের মন ভরাতে যে সাধনা করতে হয়েছে, ঝরাতে হয়েছে ঘাম, তার দাম দিচ্ছেন না রিটেইল ক্রেতারা। কাঁচামাল, পরিবহন খরচ কয়েকগুণ বাড়লেও প্রতিযোগিতার কথা বলে পোশাকের দাম ক্রমে কমিয়েছে বিদেশী ক্রেতারা। কিন্তু, ভারতের সাথে তা করে না বা পারে না বিদেশী ক্রেতারা।

বর্তমানে ভারতের দিল্লিতে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বা আইএলওতে কর্মরত সংস্থাটির দক্ষিণ এশিয়ার শ্রম কার্যক্রমবিষয়ক বিশেষজ্ঞ (স্পেশালিস্ট অন ওয়ার্কার অ্যাকটিভিটিস) সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ মনে করেন, যখন কোনো দেশে কর্মপরিবেশ ও শ্রম অধিকার বিষয়ে দুর্বলতা থাকে, তখনই সেখানে বাইরের কেউ এসে কথা বলার সুযোগ পায়। তাই এ ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে হলে নিজেদের দুর্বলতা নিজেদের দূর করতে হবে। তিনি আরো মনে করেন, শ্রমিকের অধিকারের বিষয়ে প্রকৃত শ্রমিক প্রতিনিধিদের কথা বলার সুযোগ তৈরি করতে হবে। সেখানে বাংলাদেশের বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে। মজুরি দাবিতে শ্রমিকদের আন্দোলনকে যেভাবে মোকাবেলা করা হচ্ছে, তা বহির্বিশ্বে ভালো কোনো বার্তা দিচ্ছে না।
পরিশেষে, শ্রমিকদের ক্ষমতায়ন, শ্রম অধিকার ও শ্রমিকদের মানসম্মত জীবনযাপন নিশ্চিতের লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের স্মারকের আলোকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী যেহেতু বাংলাদেশের শ্রমিক অধিকারকর্মীর নাম উল্লেখ করেছেন; সেহেতু এটিকে হালকাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। কিসের ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নামটি সামনে নিয়ে এলো, তা খতিয়ে দেখতে পুরো স্মারক বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। মনে রাখা দরকার, যুক্তরাষ্ট্র যে নীতি গ্রহণ করে, তার পশ্চিমা মিত্ররা অর্থাৎ ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জাপান ও অস্ট্রেলিয়াও একই নীতি অনুসরণ করে। তাই দেশের সার্বিক অর্থনীতির স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্রের এ স্মারক আমলে নিতে হবে।
লেখক : কলামিস্ট
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement