২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

মনের পশুকে দাও কোরবানি

-


‘কোরবানি’ শব্দের আরবি হলো কোরবান। ওই বস্তুকে কোরবান বলা হয় যার মাধ্যমে আল্লøাহ তায়ালার নৈকট্য লাভ করা হয়, তা পশু জবাই করার মাধ্যমে হোক বা যেকোনো দান খয়রাতের মাধ্যমে হতে পারে। আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট ব্যক্তির নির্দিষ্ট জানোয়ার জবাই করাকে কোরবানি বলে। প্রকৃতপক্ষে এ ঘটনা ছিল ইবরাহিম আ:-এর আত্মত্যাগের কঠিন পরীক্ষাÑ ওই পরীক্ষা ইবরাহিম আ: উত্তীর্ণ হলেন নিজ ছেলে ইসমাইল আ:কে আল্লাহর হুকুমে কোরবানি দিতে স্বেচ্ছায় প্রস্তুতি গ্রহণ করে। আমাদের এই কোরবানি প্রকৃতপক্ষে হজরত ইবরাহিম আ:-এর এই অতীব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার স্মৃতিচারণ।
মানুষকে নিজ স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে আত্মত্যাগী হওয়ার মহৎ অনুপ্রেরণায় ইসলামে কোরবানির বিধান এসেছে। কিন্তু আমরা এই ধরণীর মায়ার বাঁধনে পতিত হয়ে ভুলে গেছি আত্মত্যাগ। আমরা আমাদের অর্জিত সম্পদের দাসত্ব করছি ফলে দান বা ত্যাগের ধারণা প্রায় শূন্যের কোঠায়। দানের পরিবর্তে গ্রহণ, ত্যাগের পরিবর্তে লাভের স্পৃহায় মানুষের মানবিকতা ভুলে গিয়ে পাশবিকতা রূপ ধারণ করেছে। হেন অবস্থায় মানব হৃদয়ে পাশবিকতার বিনাশ না হলে মানবিকতা প্রকাশ সম্ভব নয়।
আল্লাহর রাহে নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দেয়ার দীপ্ত শপথের নাম কোরবানি। কোরবানিকারী মানুষকে বুঝতে হবে, পশুর গলায় ছুরি চালানো নয়, এ ছুরি চালানো হচ্ছে কোরবানিদাতার নিজ প্রবৃত্তির গলায়। তখন তাকে ভাবতে হবে, যে সে তার নিজ সন্তানকে কোরবানি দেয়ার পরিবর্তে পশুকে কোরবানি দিচ্ছে। আল্লাহর প্রেমে নিজ সন্তানকে কোরবানি করলে যে ভারাক্রান্ত শোকের ছায়া নেমে আসত সেই অনুভূতি এই পশুর বেলায় থাকতে হবে। অন্যথায় কোরবানির সার্থকতা পাওয়া মুশকিল। কবির ভাষায় ‘তাকওয়ার অর্জনে হতে মহীয়ান, নিজ ছেলে মনে করে দাও কুরবান’। যে কোরবানিতে তাকওয়ার আবেগ অনুভূতি নেই, আল্লাহর দৃষ্টিতে সেই কোরবানির কোনো মূল্য নেই।
বনের পশুকে কোরবানির মাধ্যমে মনে মায়ার দাগ কাটলে হৃদয়ে আসবে শুদ্ধতা। শুদ্ধতা লাভের জন্যই তাকওয়া যা অর্জনের জন্য কোরবানির ‘ঈদুল আজহা’। মানুষ আত্মস্বার্থ ত্যাগ না করে, তাকওয়া ভুলে গিয়ে প্রতিযোগিতামূলকভাবে গরু, মহিষ, ভেড়া, উট, দুম্বা জবাই করে উদরপূর্তি ভুরিভোজে আনন্দ উপভোগ করে থাকে। আত্মীয়-স্বজনের কাছে নিজের নাম ফুটানোর জন্য বলে থাকেনÑ আমি অত লাখ টাকার কোরবানি দিয়েছি।
বাস্তবতা হলোÑ কোরবানির প্রতিযোগিতায় মাংস ভোজের স্পৃহা বিদ্যমান। আমার জীবনের প্রত্যক্ষ একটি দৃশ্যের সামান্য একটু ব্যক্ত করে, আমার সমমনাদের হৃদয় প্রদান করে মনের যন্ত্রণা একটু লাঘব করতে চেষ্টা করব। কোনো এক বছর জনৈক ধনী ব্যক্তি একটি বৃহৎ মহিষ কোরবানির জন্য ক্রয় করেন। ঈদুল আজহার নির্দিষ্ট দিন ও সময়ে কোরবানির জন্য মহিষটি বেঁধে শোয়ানোর পর মৌলভী সাহেব জবাই করার নিমিত্তে গলায় ছুরি চালালেন। কিঞ্চিত গলা কাটার পর মহিষটি হঠাৎ পায়ের বাঁধন ছিড়ে শোয়া থেকে উঠে প্রাণে বাঁচার জন্য অচেনা পথে দৌড়াতে থাকে। অবশেষে ঘটনার স্থান থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে এক জঙ্গলে প্রাণ বাঁচানোর জন্য আশ্রয় নেয়। কিন্তু হায়রে বিধি! বাঁচার জন্য বনে আশ্রয় নিলেও মাংসভোজী রাক্ষুসে দল মহিষটির পিছু ছাড়েনি। সদলবলে জঙ্গলেই তাকে পাকড়াও করল। এ সময় ওই মৌলভী সাহেব দ্বারা আংশিক গলা কাটার স্থান থেকে রক্তের প্রবাহ ঝরেই যাচ্ছিল। সবাই পাশে গিয়ে মহিষকে বেঁধে ফেলল এবং ওই সময় যেন তার প্রতিবাদের শক্তিও ছিল না এবং তার দুই আঁখিতে জল টলমল করছিল। এমনি মুহূর্তে তার গলায় ছুরি চালিয়ে জীবন প্রদীপের ইতি টানা হলো।
মানুষ শ্রেষ্ঠ জীব তখনই প্রমাণিত হয় যখন সে স্রষ্টার কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং তাই যদি হয়ে থাকে, সে যা খুশি তাই করতে পারে না। সৃষ্টির কল্যাণে আত্মোপলব্ধি করে কর্ম সম্পাদন করাই তাকওয়ার সঠিক পন্থা।
পশু কোরবানির সময় ভাবতে হবে, আমার মধ্যে অসত্য, অপকর্ম অন্যায় উশৃঙ্খলতা হিংসা-বিদ্বেষসহ সব অনিয়ম ও পাশবিকতা কোরবানি দিয়ে, আত্মশুদ্ধি গ্রহণ করতে পেরেছি কি না। পশু কোরবানির মাধ্যমে আমাদের মনের পশুত্বকে বিসর্জন দিয়ে আত্মশুদ্ধির পথ প্রসারিত এবং তাকওয়া অর্জিত হলে ঈদুল আজহার সার্বিক সার্থকতা সফল হবে এবং এ প্রত্যাশা সবার মনে জাগ্রত হওয়া উচিত।
মো: হাবিবুর রহমান
শিবপুর, নরসিংদী


আরো সংবাদ



premium cement