খতনা করতে গিয়ে শিশুর মৃত্যু : ক্ষতিপূরণ প্রশ্নে হাইকোর্টের রুলের শুনানি ৫ মার্চ
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ২৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১৪:৫৮
রাজধানীর বাড্ডার সাঁতারকুলে ইউনাইটেড মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সুন্নতে খতনার জন্য অজ্ঞান করা শিশু আয়ান আহমেদের মৃত্যুতে ক্ষতিপূরণ এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ প্রশ্নে জারি করা রুলের শুনানি আগামী ৫ মার্চ।
বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত একটি হাইকোর্ট ডিভিশন বেঞ্চ রুল শুনানির জন্য আজ বুধবার এ দিন ধার্য করেন।
আদালতে রিটের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট এ বি এম শাহজাহান আকন্দ মাসুম। ইউনাইটেড হাসপাতালের পক্ষে ছিলেন সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার মো: রুহুল কুদ্দুস কাজল। সাথে ছিলেন ব্যারিস্টার জারিন রহমান। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তানিম খান। আর এই মামলায় ইন্টাভেনর হিসেবে ছিলেন অ্যাডভোকেট শিশির মনির।
২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর সুন্নতে খতনা করানোর জন্য আয়ানকে সাঁতারকুল বাড্ডার ইউনাইটেড মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান অভিভাবকরা। খতনা শেষ হওয়ার পর আয়ানের জ্ঞান না ফেরায় তাকে সেখান থেকে পাঠানো হয় গুলশান-২ এর ইউনাইটেড হাসপাতালে। সেখানে পিআইসিইউতে (শিশু নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। এর সাত দিন পর চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
২০২৪ সালের ৯ জানুয়ারি হাইকোর্টে রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এ বি এম শাহজাহান আকন্দ মাসুম। এরপর আয়ানের মৃত্যুর ঘটনার বিষয়ে অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট।
একইসাথে রুল জারি করে আয়ানের পরিবারকে কেন পাঁচ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে না, তা জানতে চান আদালত।
হাইকোর্টের সে আদেশ অনুসারে স্বাস্থ্য অধিদফতরে উপ-পরিচালক ডা. পরিমল কুমার পালের সই করা ১৫ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করা হয়েছিল। তবে স্বাস্থ্য অধিদফতরের ওই প্রতিবেদনকে এক ধরনের আইওয়াশ বলে মন্তব্য করে প্রতিবেদনের সুপারিশকে হাস্যকর উল্লেখ করেন উচ্চ আদালত। এরপর হাইকোর্ট নতুন করে পাঁচ সদস্যের বিশেষজ্ঞ তদন্ত কমিটি গঠন করে দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট সে কমিটির আহ্বায়ক করা হয় সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও অ্যানেস্থেসিওলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডাক্তার এ বি এম মাকসুদুল আলমকে। সচিব হিসেবে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন।
হাইকোর্টের নির্দেশে গঠিত এই বিশেষজ্ঞ তদন্ত কমিটি রিপোর্ট নথিভুক্ত করে আদালত রুল শুনানির দিন ধার্য করেছেন। হাইকোর্টে দাখিল করা প্রতিবেদনে বিশেষজ্ঞ তদন্ত কমিটির চূড়ান্ত মতামত ও সিদ্ধান্ত অংশে বলা হয়, বিশ্লেষণের আলোকে বিশেষজ্ঞ তদন্ত কমিটির সদস্যরা মনে করেন যে শিশু আয়ান আহমেদের মৃত্যুর জন্য সাঁতারকুলে অবস্থিত ইউনাইটেড মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দায়ী। কেননা, এই মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালটি একটি নির্মাণাধীন প্রতিষ্ঠান। এ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের স্বাস্থ্য অধিদফতরের অনুমোদন না থাকায় এটি বৈধভাবে চিকিৎসা কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারে না।
দ্বিতীয়ত, অস্ত্রোপচারের পূর্বে নেবুলাইজ করা এবং অস্ত্রোপচার পরবর্তী ঝুঁকি সম্পর্কে চিকিৎসকদের টিমের উচিত ছিল শিশু আয়ানের বাবা বা অভিভাবকদের কাছে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়া।
তৃতীয়ত, অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট সৈয়দ সাব্বির আহম্মদের আরো সতর্ক হওয়া উচিত ছিল এবং তাকে সহযোগিতা করার জন্য সহকারী প্রয়োজন ছিল।
চতুর্থত, কমিটি মনে করে যে, সাঁতারকুলে অবস্থিত ইউনাইটেড মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে অস্ত্রোপচার করার পরিবেশ যেমন ছিল না, তেমনি অস্ত্রোপচার পরবর্তী জরুরি পরিস্থিতি সামাল দেয়ার ব্যবস্থাও ছিল না। উপরন্তু, গুলশানে ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার সময়ে আয়ানের পিতা ও আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে ডাক্তার ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ব্যবহার ছিল রূঢ়। সবশেষে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক পাঁচ লাখ ৭৭ হাজার দু’শ সাতান্ন টাকার বিল পরিশোধ করে আয়ানের লাশ নিয়ে যেতে বলা ছিল অমানবিক।
হাইকোর্টে দাখিল করা তদন্ত কমিটির সুপারিশে বলা হয়- ১. সাঁতারকুলে অবস্থিত ইউনাইটেড মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল শিশু আয়ান আহমেদের মৃত্যুর জন্য দায়ী হওয়ায় এ প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেয়া উচিত। ক্ষতিপূরণের একটি অংশ আয়ানের মা-বাবাকে দেয়া এবং অন্য অংশ দিয়ে দুস্থ শিশু ও কিশোর/কিশোরীদের জন্য একটি হাসপাতাল নির্মাণ করার জন্য কমিটির সদস্যরা সুপারিশ করছেন।
২. স্বাস্থ্য অধিদফতরের অনুমোদন ছাড়া চিকিৎসা কর্মকাণ্ড পরিচালনা এবং শিশু আয়ানের মৃত্যুর জন্য ইউনাইটেড মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হোক।
৩. ডাক্তার তাসনুভা মাহজাবীন ও অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট সৈয়দ সাব্বির আহম্মদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হলো।
৪. চিকিৎসাসংক্রান্ত লিখিত সম্মতিপত্রটি বাংলায় বড় বড় অক্ষরে স্পষ্ট ও বোধগম্যভাবে লিখতে হবে, যাতে রোগীর মা-বাবা বা অভিভাবকরা সেটি সহজে পড়তে পারেন এবং চিকিৎসা ও তার পরবর্তী ফলাফল সম্পর্কে জেনেবুঝে লিখিত সম্মতিপত্র স্বাক্ষর করতে পারেন। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে সমগ্র বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য একটি ‘ইউনিফর্ম’ বা একই ধরনের সম্মতিপত্র প্রস্তুত করার জন্য অনুরোধ ও সুপারিশ করা হলো।
৫. স্বাস্থ্য অধিদফতরের অনুমোদন ছাড়া যেসব হাসপাতাল ও ক্লিনিক চিকিৎসা কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে, সেগুলো খুঁজে বের করে অবিলম্বে সেখানে চিকিৎসা কর্মকাণ্ড বন্ধ করা এবং সেসব হাসপাতালের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হচ্ছে।
প্রতিবেদনে দেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। সেগুলো হলো-
১. বাংলাদেশের সব মানুষের সুস্বাস্থ্যের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য বিদ্যমান আইনগুলোর প্রয়োগ নিশ্চিত করা এবং প্রয়োজনে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিদ্যমান আইনের সংস্কার ও পরিমার্জন করার সুপারিশ করা হলো।
২. বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় রেফারেল পদ্ধতির মাধ্যমে নিচ থেকে উচ্চ পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের কাছে চিকিৎসা নেয়ার জন্য সুপারিশ করা হচ্ছে। একজন জেনারেল ফিজিশিয়ানকে দেখানোর পরে তিনি যদি কোনো রোগীকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে রেফার করেন, তাহলে তিনি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন। এতে চিকিৎসা পদ্ধতি সহজ হবে এবং রাজধানী ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে রোগীর চাপ কমবে।
৩. অপরিকল্পিত, মানহীন (ডায়াগনস্টিক সেন্টার, হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজ) বন্ধ করার জন্য কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
৪. অ্যান্টিবায়োটিকের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য অবিলম্বে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
৫. একমাত্র বিএমডিসি (বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল) কর্তৃক নিবন্ধিত ব্যক্তির মাধ্যমে চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে হবে।
৬. বাংলাদেশের সব নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য বৈশ্বিকভাবে অনুসারিত জিডিপির পাঁচ শতাংশ স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ ও সেটি যথাযথভাবে ব্যবহার করার জন্য সুপারিশ করা হলো।
৭. চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত চিকিৎসক, নার্স ও কর্মকর্তাসহ অন্যান্য ব্যক্তিকে তাদের যোগ্যতা অনুসারে ক্ষেত্রমতো প্রণোদনা ও ভালো প্রাতিষ্ঠানিক চর্চায় উৎসাহিত করার জন্য সুপারিশ করা হলো।
সূত্র : বাসস