০১ জানুয়ারি ২০২৫, ১৭ পৌষ ১৪৩০, ১৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৫
`

ফৌজদারি মামলার তদন্ত থেকে পুলিশকে সরিয়ে দেয়ার চিন্তা যে কারণে

- সংগৃহীত

অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন করা বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন তাদের যে সুপারিশমালা আইন মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে, তাতে ফৌজদারি অপরাধের তদন্ত পুলিশের কাছ থেকে সরিয়ে একটি স্বাধীন তদন্ত সংস্থার মাধ্যমে করার প্রস্তাব দিয়েছে বলে জানা যাচ্ছে।

একইসাথে একটি ক্যারিয়ার প্রসিকিউশন সার্ভিস বা অ্যাটর্নি সার্ভিস প্রতিষ্ঠারও প্রস্তাব দেয়া হয়েছে, যাতে করে মামলার শুরু থেকেই প্রসিকিউটররা তদন্তকারী কর্মকর্তা বা সংস্থাকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতে পারেন।

জানা গেছে, বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশন মনে করছে, কোনো একটি বিষয় বিচারে যাওয়ার আগে যে ধাপগুলো পার হয়- সেটিও তাদের আওতায় পড়বে।

সাধারণত মামলা দায়েরের পর এর প্রাথমিক কার্যক্রমই শুরু হয় তদন্তের মাধ্যমে।

সরকার কমিশনের সুপারিশ গ্রহণ করলে নতুন আইন করে বা বিদ্যমান আইন সংশোধন করে আলাদা করে তদন্ত সংস্থা ও অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠন করতে হবে।

বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের একজন সদস্য সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী তানিম হোসেন শাওন বলেছেন, এখন মামলার তদন্তে নানা বাধ্যবাধকতার কারণে পুলিশ প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করতে পারছে না বলেই একটি বিশেষায়িত পেশাদার তদন্ত সংস্থার প্রয়োজনীয়তা তারা উপলব্ধি করেছেন।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক মো: নূরুল হুদা বলছেন, এখন পুলিশ ফৌজদারি কার্যবিধি বা সিআরপিসি অনুসরণ করে মামলার তদন্ত করে থাকে, তবে সরকার চাইলে নতুন আইন করে তদন্তের জন্য নতুন সংস্থা গঠন করতে পারে।

মো: নূরুল হুদা বলছিলেন, ‘সে আইনেই থাকতে পারে যে নতুন সংস্থার কর্মপরিধি কী হবে এবং তারা কী ধরনের কাজ করবে। সে ধরনের কিছু না হওয়া পর্যন্ত পুলিশের ওপর এর প্রভাব কী হবে তা বোঝা যাবে না।’

এ কমিশনের রিপোর্ট শিগগিরই জনসম্মুখে প্রকাশ করা হবে বলে জানিয়েছেন কমিশনের আরেকজন সদস্য।

যদিও তিনি এ বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করতে রাজি হননি।

সুপারিশ সম্পর্কে কতটা জানা যাচ্ছে
বাংলাদেশে এখন ফৌজদারি অপরাধের তদন্ত করে পুলিশ। এছাড়া পুলিশের বিশেষায়িত সংস্থা পিবিআই এবং সিআইডিও তদন্ত সংস্থা হিসেবে পরিচিত।

তবে বিচার বিভাগীয় কমিশন মনে করছে, পুলিশের লোকজন দিয়েই এসব সংস্থা চলার কারণে তারা পেশাদারিত্বের সাথে কাজ করতে পারছে না।

এটিই তাদের সুপারিশে উঠে এসেছে।

এই সুপারিশমালাসহ কমিশনের রিপোর্ট এখন আইন মন্ত্রণালয়ে আছে বলে জানা গেছে।

কমিশনের সদস্য তানিম হোসেন শাওন বলছিলেন, ‘পিবিআই মূলত তদন্ত সংস্থা হওয়ার কথা। আবার সিআইডিও তাদের মতো কাজ করে। র‍্যাব পুলিশ তো আছেই। সব মিলিয়ে সুনির্দিষ্ট ও সমন্বিত পেশাদার তদন্ত প্রক্রিয়া বাংলাদেশে গড়ে উঠেনি। এ জন্যই একটি বিশেষায়িত পেশাদার ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন সংস্থার প্রয়োজন।’

তার মতে, ‘পুলিশ একদিকে প্রভাবের বাইরে থেকে কাজ করতে পারে না, আবার তদন্তের জন্য যে দক্ষতা দরকার সেটাও গড়ে ওঠেনি। আবার বিচার প্রক্রিয়ায় কোনো মামলা যাওয়ার আগে তদন্ত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বেশিভাগ ক্ষেত্রে দুর্বল তদন্তের কারণে অপরাধের বিচার দূরুহ হয়ে পড়ে।’

এছাড়া বিচার বিভাগীয় কমিশন ক্যারিয়ার প্রসিকিউশন সার্ভিস গঠনেরও সুপারিশ করেছে বলে জানা গেছে।

সরকার এটি গ্রহণ করলে এটি হবে মূলত অ্যাটর্নি সার্ভিস।

এটি হলে প্রসিকিউটর বা রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী শুরু থেকেই অর্থাৎ তদন্ত পর্যায় থেকেই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সহায়তা করতে পারবেন।

এতে করে মামলার জন্য প্রয়োজনীয় আলামত সংগ্রহ থেকে শুরু করে সব পর্যায়েই আদালতে দরকার হবে- এমন তথ্যাদি সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে কর্মকর্তারা সহায়তা পেতে পারবেন।

কমিশনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সমন্বয়ের অভাবে অনেক ক্ষেত্রে যথাযথ সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়াই আদালতে মামলার বিচারকাজ শুরু হয় এবং শেষ পর্যন্ত অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে যান।

তানিম হোসেন শাওন বলেন, ‘পুলিশের ভেতর থেকে এগুলো সম্ভব হয় না। এ জন্য আলাদা অর্গানোগ্রাম করতে হবে। পৃথক তদন্ত সংস্থা ও স্বাধীন প্রসিকিউশন সার্ভিস হলে তদন্ত কর্মকর্তা ও প্রসিকিউটরের সমন্বয়ের মাধ্যমে তদন্ত করতে পারবে।’

তবে ফৌজদারি তদন্তের কাজ পুলিশের হাত থেকে সরিয়ে নেয়ার সুপারিশের বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক আইজিপি নূরুল হুদা বলেন, ‘আগে দেখতে হবে সরকার নীতিগতভাবে এটা করতে রাজি হয় কি না। রাজি হলে তখন নতুন আইন করে তদন্ত সংস্থা ও অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠন করতে হবে। তখন দেখার বিষয় হবে যে তাদের কর্মপরিধি কী হয় এবং তারা কী কী করবেন।’

প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা অনুযায়ী গত ৩ অক্টোবর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মমিনুর রহমানকে প্রধান করে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন গঠন করে।

এ কমিশনের অন্য সদস্যরা হলো অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এমদাদুল হক, হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি ফরিদ আহমেদ শিবলী, সুপ্রিম কোর্টের সাবেক রেজিস্ট্রার সাইয়েদ আমিনুল ইসলাম, সাবেক জেলা ও দায়রা জজ মাজদার হোসেন।

এছাড়াও রয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী তানিম হোসেন শাওন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মাহফুজুল হক এবং একজন শিক্ষার্থী প্রতিনিধি।

ফৌজদারি মামলা কোনগুলো
সাধারণত চুরি, ডাকাতি, খুন, ধর্ষণ, প্রতারণা, জালিয়াতি, মিথ্যা সাক্ষ্যদানের মতো অপরাধে কাউকে অভিযুক্ত করে যখন তার বিরুদ্ধে যে মামলা হয় সেটিই ফৌজদারি মামলা।

মূলত ব্যক্তির অধিকার কিংবা সম্পত্তির অধিকার ছাড়া যেকোনো অপরাধই ফৌজদারি মামলার অন্তর্ভুক্ত।

এসব অপরাধের মামলায় কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে তার জেল-জরিমানা, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডের মতো শাস্তিও হতে পারে।

বিদ্যমান আইন অনুযায়ী, কোনো কোনো অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশ কোনো ওয়ারেন্ট ছাড়াই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেফতার করতে পারে।

তবে গ্রেফতারের পর দ্রুতই আদালতে প্রতিবেদন দিয়ে থাকে পুলিশ।
সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement