১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১, ১৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

বিতর্কিত কারিকুলামের নেপথ্য কুশিলবরা এখন কে কোথায়?

-

- আড়ালে চলে যাচ্ছেন অনেকেই
- ভোল পাল্টাচ্ছেন বর্তমান কর্মকর্তারা

আড়ালে চলে যাচ্ছেন বিতর্কিত কারিকুলামের নেপথ্যের সব নায়ক। নতুন শিক্ষা কারিকুলামের আড়ালে মূলত নতুন প্রজন্মকে ধ্বংস করতে শিক্ষাবিমুখ এবং নৈতিকতা বিবর্জিত শিক্ষা কাঠামো চাপিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র হয়েছিল গত এক দশক ধরে। পতিত স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের সুদূরপ্রসারী একটি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্য নিয়েই চালু করা হয়েছিল অবাস্তব একটি শিক্ষা ব্যবস্থা। ভিনদেশীদের পরামর্শ আর এনজিওদের পৃষ্ঠপোষকতায় সরকারের মন্ত্রী থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায়ের বেশ কিছু কর্মকর্তা নেপথ্যে থেকে জোরালো ভূমিকা রেখেছেন বিতর্কিত এই কারিকুলাম প্রণয়নের কাজে। আঁটঘাট বেঁধে কারিকুলাম তৈরির কাজে সহযোগিতার পুরস্কার হিসেবে কাউকে দেয়া হয় পদোন্নতির লোভনীয় প্রস্তাব। আবার ঊর্ধ্বতন কাউকে কাউকে দেয়া হয় আন্তর্জাতিক এনজিওতে বিশেষজ্ঞ পদে নিয়োগে সুপারিশের প্রস্তাব।

এ দিকে গত ৫ আগস্টের পর ছাত্র জনতার ঐতিহাসিক বৈপ্লবিক গণ-অভ্যুত্থানে দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেদের অপকর্মের ফলাফল আন্দাজ করতে পেরে ইতোমধ্যে ভোল পাল্টে ফেলেছেন অনেক কর্মকর্তা। বিগত সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ডা: দীপু মনি ছিলেন বিতর্কিত এই কারিকুলামের প্রধানতম প্রবক্তা। মূলত তার নিদের্শেই পুরো শিক্ষা কাঠামো পরিবর্তনের কাজটি শুরু হয় ২০১৯ সালে। দুই বছর প্রথম পর্যায়ের কিছু কাজ চলমান অবস্থায় ২০২০ সালে চলে আসে বিশ্বব্যাপী করোনার আঘাত। ওই সময় সব উদ্যোগ থমকে গেলেও থেমে থাকেনি কারিকুলাম প্রস্তুতের কাজ। শিক্ষক-অভিভাবক ও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট অংশীজনদের মতামত দেয়া বা নেয়ার যথেষ্ট সুয়োগ না দিয়েই ২০২২ সাল থেকে শ্রেণিভেদে চাপিয়ে দেয়া শুরু হয় বিতর্কিত এই কারিকুলাম। যদিও সাবেক শিক্ষামন্তী দীপু মনি বর্তমানে হত্যাসহ বিভিন্ন মামলায় জেলহাজতে রয়েছেন।

অভিযোগ রয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) তৎকালীন সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক ড. মশিউজ্জামান নতুন কারিকুলাম বিষয়ে নেতৃত্ব দিয়ে সব কলকাঠি নেড়েছেন। তিনিসহ কয়েকজন আজ্ঞাবহ কর্মকর্তা পুরো কারিকুলামের বিষয়টি নিজেদের মতো করে কমিটি গঠন এবং পছন্দের বিশেষজ্ঞ দিয়ে কাজ করিয়েছেন। কারিকুলাম বিষয়ে অনুষ্ঠিত সভাগুলোতে ভিন্ন মতকে কখনোই গ্রহণ করা হয়নি। বরং কোনো কর্মকর্তা বা বিশেষজ্ঞ যদি যুক্তির খাতিরেও কোনো ভিন্ন মতামত তুলে ধরতেন তাহলে ওই সভাতে প্রকাশ্যেই তাকে তিরস্কার বা অপদস্থ করা হতো। এমনও দেখা গেছে সিনিয়র কোনো কর্মকর্তা যদি তার নিজের মতামত কখনো দিতেন সেটি যৌক্তিক হলেও তা গ্রহণ করা হতো না। অনেক কর্মকর্তাকে (সেসময়ে) আওয়ামী সরকার বিরোধী বলে মিটিংয়েই পাকড়াও করা হতো।

যুক্তি দিয়ে যদি কোনো কর্মকর্তা কারিকুলামের দুর্বল দিকগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করতেন তাহলে দেখা যেত পরবর্তী সভায় ওই সিনিয়র কর্মকর্তাকেই সভায় না ডেকে তাকে এনসিটিবির বাইরে কোনো অনুষ্ঠানে পাঠিয়ে দেয়া হতো। বিতর্কিত কারিকুলাম প্রণয়নের কাজে এনসিটিবিতে সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলেন অন্যতম সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) মো: মোখলেস উর রহমান। তিনিই মূলত কাকে কোন কাজের দায়িত্ব দেয়া হবে তা নির্ধারণ করতেন। বিশেষ করে বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞদের দায়িত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে তিনিই মূল ভূমিকা পালন করেছেন। এই কর্মকর্তা গত সপ্তাহে এনসিটিবি থেকে মুন্সীগঞ্জের সরকারি হরগঙ্গা কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে বদলি হয়েছেন।

গত কয়েক দিন এনসিটিবিতে কে বা কারা বিতর্কিত ওই কারিকুলাম প্রণয়নে উলঙ্গভাবে অতি উৎসাহিত হয়ে কাজ করেছেন তাদের বিষয়ে অনুসন্ধান চালিয়েছে নয়া দিগন্ত। অনুসন্ধানে জানা গেছে এনসিটিবির কর্মকর্তাদের মধ্যে যারা কারিকুলাম তৈরির সাথে জড়িত ছিলেন তাদের বেশির ভাগই এই ধরনের বিতর্কিত ও বাস্তবতা বিবর্জিত কারিকুলাম চাননি। তারা চেয়েছিলেন শ্রেণিকক্ষে পড়ালেখা এবং সেই আলোকে পরীক্ষা পদ্ধতির। ডিম ভাজি, আলু ভাজি আর খিচুরি রান্নার কৌশলের বিরুদ্ধে তারা সব সময়ই সোচ্চার ছিলেন। কিন্তু কিছু দুরভিসন্ধী কর্মকর্তার সিন্ডিকেটের কারণে তারা তাদের মতামতকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, কয়েকজন কর্মকর্তা পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের ইচ্ছা আর ভিনদেশী ও এনজিওদের খুশি করতে জাতি ও প্রজন্ম ধ্বংস করার মতো শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়নের অপতৎপরতায় মেতে উঠেছিলেন। তাদের অন্যতম ছিলেন মাধ্যমিকের বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তা খাদিজা আক্তার (শিল্পকলা)। খাদিজা বর্তমানে বরিশালের টিটি কলেজে বদলি নিয়ে চলে গেছেন। এনসিটিবিতে এখনো কর্মরত রয়েছেন মাধ্যমিকের বিশেষজ্ঞ নুরুন্নেসা সুলতানা (ডাক নাম সিলকী), মো: আহসানুল আরেফীন চৌধুরী (বিশেষজ্ঞ), মাধ্যমিকের মোরশেদ (বিশেষজ্ঞ)। মোরশেদও সম্প্রতি বদলি হয়ে নোয়াখালীর চৌমুহনী কলেজে চলে গেছেন। এই তালিকায় আরো আছেন মাধ্যমিকের রাকিব (ঊর্ধ্বতন বিশেষজ্ঞ)। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক (ইংরেজি নামের আদ্যাক্ষর টি) প্রথমে বিতর্কিত এই কারিকুলামের বিরোধিতা করলেও পরবর্তী সময়ে বিশেষ কোনো সুবিধার বিনিময়ে তিনিই আবার এই কারিকুলাম কমিটির সদস্য হয়ে চুপসে যান।

এনসিটিবির সাবেক সদস্য অধ্যাপক ড. মো: মশিউজ্জামান নয়া দিগন্তকে জানান, আমরা যে কারিকুলাম তৈরি করেছিলাম এটা কিছু অভিভাবক হয়তো বুঝতেই পারেননি। তবে শহরের কিছু অভিভাবক ভুল বুঝলেও গ্রামের সব অভিভাবকই ওই (বিতর্কিত) কারিকুলামকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। শহরাঞ্চলের চার হাজার স্কুলের অভিভাবকদের মধ্যে বিরূপ মন্তব্য থাকলেও গ্রামের প্রায় ২৬ হাজার ু‹লের অভিভাবক ওই কারিকুলামকে সবাই স্বাগত জানিয়েছিল। অন্য দিকে গাইড বই আর কোচিং ব্যবসায়ীরা শুরু থেকেই আমাদের ওই কারিকুলামের বিরোধিতা করে আসছিল। শুধু আমাদের দেশে নয় পৃথিবীর সব দেশেই নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন শুরু হলে তার বিরোধিতা থাকবে এটাই স্বাভাবিক।

মো: আহসানুল আরেফিন চৌধুরী গতকাল এ প্রতিবেদককে বলেন, আমরা কারিকুলাম প্রণয়নে কাজ করেছি এটা ঠিক। তবে আমরা তো সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী কেউ না। সরকার যে সিদ্ধান্ত দিয়েছে আমরা তার আলোকেই কাজ করেছি মাত্র। তিনি বলেন, আমরা যদিও বিশেষজ্ঞ লেভেলে কাজ করি কিন্তু এ বিষয়ে এক্সপার্টরা যে মতামত দিয়েছেন তার বাইরে আমাদের কাজ করার কোনো সুযোগও ছিল না। নুরুন্নেসা সুলতানা সিলকী নয়া দিগন্তকে বলেন, আমরা রুল মেনেই কাজ করেছি। প্রয়োজনে সরকার যদি চায় আবারো কারিকুলাম পরিবর্তন হবে আমরাও সেভাবেই কাজ করব। এটা মূলত নির্ভর করে সরকারের ইচ্ছা আর পরিকল্পনার ওপরে। যে সরকার যেভাবে চাইবে কারিকুলাম সেভাবেই প্রণয়ণ করা হবে। তিনি বলেন সরকারের পলিসি লেভেলে সিদ্ধান্ত হলে আমরা সেভাবেই কাজ করতে প্রস্তুত আছি। আমরাতো সত্যিকার অর্থে আমাদের ওপরে অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছি মাত্র।

 


আরো সংবাদ



premium cement