১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৩ আশ্বিন ১৪৩১, ১৪ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাবিত খসড়াতেই যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হামাস

-

- ইসরাইলের বোমা হামলায় জাতিসঙ্ঘের ছয় কর্মীসহ নিহত ১৮
- পশ্চিমতীরে তৃতীয় সপ্তাহের মতো ইসরাইলি অভিযান চলছে
- ফিলিস্তিনির হামলায় ইসরাইলি সেনার মৃত্যু

গাজায় অতি দ্রুত যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছে হামাস। ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠনটি নিজেও আর কোনো শর্ত দিতে চায় না, নতুন করে আর কোনো পক্ষের কাছ থেকেও শর্ত দেখতে চায় না। যুক্তরাষ্ট্র যে খসড়া প্রস্তাব উত্থাপন করেছিল যুদ্ধবিরতির লক্ষ্যে, তাতেই রাজি তারা।
রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, ফিলিস্তিনি সংগঠনটি এক বিবৃতিতে বলেছে, হামাসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা খলিল আল-হাইয়ার নেতৃত্বে তাদের আলোচক দল বুধবার কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আবদুর রহমান আলে সানি এবং মিসরের গোয়েন্দা প্রধান আব্বাস কামেলসহ দোহায় গাজার সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে মধ্যস্থতাকারীদের সাথে দেখা করেছে।
মেহের নিউজ ও আল-জাজিরা জানায়, হামাসের প্রতিনিধিদল শুরু থেকেই তাদের এ অবস্থানে অটল ছিল যে, পুরো গাজা উপত্যকা থেকে দখলদার সব সেনা প্রত্যাহারের কথা যে চুক্তিতে থাকবে না, হামাস সে চুক্তি মেনে নেবে না। খলিল আল-হাইয়্যা বলেন, ইসরাইলি বন্দীদের জীবিত ফিরিয়ে নিতে হলে গাজা উপত্যকা থেকে সব সেনা প্রত্যাহার, বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের নিজ নিজ ঘরবাড়িতে প্রত্যাবর্তন, উপত্যকায় অবাধে ত্রাণবহর প্রবেশ এবং নির্বিঘেœ গাজার পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার বিষয়গুলো মেনে নিতে হবে। হামাস নেতা আরো বলেন, যুদ্ধ-পরবর্তী গাজা উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ কার হাতে থাকবে, সেটি সম্পূর্ণ ফিলিস্তিনের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ ব্যাপারে অন্য কারো মতামত চাপিয়ে দেয়া যাবে না।
এদিকে অবরুদ্ধ গাজা ও অধিকৃত পশ্চিম তীরে অব্যাহত ইসরাইলি হামলায় এ পর্যন্ত ৪১ হাজার ১১৮ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরো ৯৫ হাজার ১২৫ জন। যার মধ্যে বেশির ভাগই নারী ও শিশু।
দীর্ঘ ১১ মাস ধরে চলা এই যুদ্ধের অবসান ঘটাতে ব্যর্থ হয়েছে সব ধরনে আলোচনা। এখন পর্যন্ত কোনো চুক্তিতে পৌঁছাতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র, মিসর, কাতার এবং ইসরাইল ও হামাস। হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে ফিলাডেলফি করিডরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণে সর্বশেষ আলোচনাও বিফলে গেছে। এদিকে, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর পরিচালক উইলিয়াম বার্নস গত শনিবার বলেছিলেন, আগামী কয়েক দিনের মধ্যে আরো বিশদ যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব করা হবে। গাজায় যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়নে বহুপক্ষীয় যে আলোচনা চলছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের আলোচক দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন উইলিয়াম বার্নস।
উল্লেখ্য, চলতি বছরের জুনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন একটি খসড়া যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব উত্থাপন করেন গাজায় যুদ্ধবিরতি এবং ইসরাইলি ও ফিলিস্তিনি বন্দী বিনিময়ের লক্ষ্যে। এই প্রস্তাবে তিন ধাপে একটি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়ন করার কথা ছিল। পরে বাইডেনের প্রস্তাব জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদেও সমর্থন পায়। হামাসও তা মেনে নেয়। তারপর থেকে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু নানা ধরনের নতুন নতুন শর্ত আরোপ করে যুদ্ধবিরতির আলোচনাকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
জাতিসঙ্ঘের ছয় কর্মীসহ নিহত ১৮ : গাজায় শরণার্থী শিবিরে রূপান্তরিত জাতিসঙ্ঘ পরিচালিত আরেকটি স্কুলে বোমা হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। এতে ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু বিষয়ক জাতিসঙ্ঘ সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ-র ছয় কর্মীসহ অন্তত ১৮ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, নুসেইরাত আশ্রয় শিবিরের আল-জাওনি স্কুলে বুধবারের এ হামলার সময় বিস্ফোরণের ধাক্কায় নারী ও শিশুরা টুকরা টুকরা হয়ে যান।
ইউএনআরডব্লিউএ বলেছে, গাজার ১১ মাসের যুদ্ধে এক ঘটনায় তাদের ‘সবচেয়ে বেশি কর্মী নিহত’ হয়েছেন এ হামলায়। ইউএনআরডব্লিউএ-র তথ্য অনুযায়ী, স্কুলটিতে প্রায় ১২ হাজার উদ্বাস্তু ফিলিস্তিনি আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। স্কুল ভবনটিতে ইসরাইলি বাহিনী আকাশপথে দুইবার হামলা চালায়। আলজাজিরা জানিয়েছে, আশ্রয় শিবিরটি জাতিসঙ্ঘ পরিচালনা করত আর নিহতদের মধ্যে তাদের ব্যবস্থাপকও আছেন।
ইউএনআরডব্লিউএ জানায়, গত অক্টোবরে গাজায় ইসরাইল হামলা শুরু করার পর থেকে এই নিয়ে পঞ্চমবারের মতো স্কুলটিতে হামলা চালানো হলো। সামাজিক মাধ্যম এক্স এ করা পোস্টে তারা লিখেছে, ‘গাজায় কেউ নিরাপদ না। কেই রেহাই পাচ্ছে না।’ ঘটনাস্থল থেকে আলজাজিরার সাংবাদিক জানান, স্কুলটিতে ‘ব্যাপক ধ্বংসলীলা চালানো হয়েছে। সেখানে বাতাসে রক্তের গন্ধ ভেসে আসছে। পুরো এলাকাটি ধ্বংসস্তূপ ও আবর্জনায় ভরে আছে।
তিনি বলেন, ‘লোকজন যখন খাবারের জন্য অপেক্ষা করছিল তখন হামলাটি চালানো হয়। কোনো সরঞ্জাম না থাকায় জরুরি বিভাগের কর্মীরা খালি হাতে ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে আটকাপড়াদের উদ্ধারের চেষ্টা করছেন।’ হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া এক ফিলিস্তিনি নারী জানিয়েছেন, এ হামলায় তিনি তার ছয় সন্তানের সবাইকে হারিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এই শিশুরা কি সন্ত্রাসী ছিল? আল্লাহ ওদের শাস্তি দিন। ইসরাইলিরা আমাদের বাড়ি ধ্বংস করে দিয়েছে, আমাদের লোকজনকে হত্যা করছে ও অনাহারে রাখছে; নারীরা বিধবা আর শিশুরা এতিম হচ্ছে।’
বেঁচে যাওয়া আরেক ব্যক্তি জানান, স্কুলের যে অংশটিতে হামলা চালানো হয়েছে ওই অংশটিতে শুধু নারীরা থাকতো। তিনি বলেন, ‘হঠাৎ বিশাল একটি বিস্ফোরণ ঘটল, এতে নারী ও শিশুরা টুকরা টুকরা হয়ে উড়ে যায়। ‘এই নিয়ে পঞ্চমবার, পঞ্চমবারের মতো স্কুলটিতে হামলা চালাল ইসরাইলি যুদ্ধবিমান। এটি একটি নিরাপদ এলাকা হওয়ার কথা ছিল।’ ইসরাইলি সামরিক বাহিনী স্কুলটিতে হামলা চালানো কথা নিশ্চিত করেছে। সেখানে হামাসের একটি কমান্ড ও কন্ট্রোল সেন্টারকে তারা লক্ষ্যস্থল করেছে বলে কোনো প্রমাণ ছাড়াই দাবি করেছে তারা।
পশ্চিমতীরে ইসরাইলি অভিযান : অধিকৃত পশ্চিম তীরে তৃতীয় সপ্তাহের মতো সামরিক অভিযান চালাচ্ছে ইসরাইলি বাহিনী। বুধবার সকাল ও সন্ধ্যায় বেশ কয়েকটি এলাকায় অভিযান চালানো হয়। এতে অন্তত ৯ ফিলিস্তিনি নিহত হয়। আলজাজিরা এ খবর জানিয়েছে। ওয়াফা নিউজ এজেন্সি জানিয়েছে, সন্ধ্যায় তুলকারেম শহরে একটি গাড়িতে ড্রোন হামলায় তিনজন ও তুবাস শহরের কাছের ফার’আ শরণার্থী শিবিরে ইসরাইলি স্নাইপারের গুলিতে আরো একজন ফিলিস্তিনি নিহত হয়। সন্ধ্যায় তুলকারেমে ইসরাইলি ড্রোন হামলায় গাড়িটিতে আগুন ধরে যায়। সেখান থেকে পাশের একটি বাড়িতেও আগুন ধরে যায়।
এদিকে ফার‘আ শরণার্থী শিবিরে ৪৬ বছর বয়সী সুফিয়ান জাওয়াদ ফায়েজ আব্দুল জাওয়াদকে গুলিতে হত্যা করে ইসরাইলি স্নাইপার। আর বুধবার সকালে তুবাসে একটি বিমান হামলায় পাঁচ জন নিহত হয়। এই অভিযানে শত শত মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং রাস্তাঘাট, পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসঙ্ঘ। হতাহতের বিষয়ে ইসরাইলের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
২০০০ সালের পর থেকে পশ্চিম তীরে ইসরাইলের সবচেয়ে বড় সামরিক অভিযান তৃতীয় সপ্তাহে গড়িয়েছে। গত ২৮ আগস্ট শুরু হওয়া ইসরাইলি অভিযানে এ পর্যন্ত ৫০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। গত ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরাইলি অভিযানে নিহত হয়েছে অন্তত ৪১ হাজার ১১৮ ফিলিস্তিনি। আহত হয়েছে কমপক্ষে ৯৫ হাজার ১২৫ জন। এর পাশাপাশি পশ্চিম তীরেও হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল।
ইসরাইলি সেনার মৃত্যু : ফিলিস্তিনের অধিকৃত পশ্চিম তীরে গাড়ি হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন এক ভারতীয় ইসরাইলি সেনা। গেরি গিদিয়ন হাংহাল নামের এই সেনা কাফির ব্রিগেডের নাসোন ব্যাটালিয়নের সদস্য ছিলেন। বার্তাসংস্থা পিটিআই জানিয়েছে, ২০২০ সালে ভারত থেকে ইসরাইলে যান হাংহাল। তিনি ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যের বাসিন্দা ছিলেন। ইসরাইলে গিয়ে বনেই মেনেশে গোত্রের সাথে থাকতেন তিনি। বনেই মেনেশের মানুষরা মূলত ভারতের মণিপুর ও মিজোরাম রাজ্যের বাসিন্দা। বলা হয়ে থাকে এই গোত্রের লোকজন একসময় ইসরাইলি উপজাতিভুক্ত ছিলেন।
২০০৫ সালে ইহুদিদের তৎকালীন প্রধান ধর্মগুরু সোলোমো আমের এসব ভারতীয়দের হারিয়ে যাওয়া মানেশা গোত্রের সদস্য হিসেবে ঘোষণা করেন। এতে এই গোত্রের মানুষের ইসরাইলে যাওয়ার পথ সুগম হয়। বনেই মেনেশে গোত্রের প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ ইতোমধ্যে ইসরাইলে চলে গেছেন। এর মধ্যে গত পাঁচ বছরে গেছেন ১ হাজার ৫০০ জন। এই গোত্রের আরো পাঁচ হাজার সদস্য ভারত থেকে ইসরাইলে যাওয়ার অপেক্ষায় আছেন।
এদিকে হামলার ঘটনার একটি ফুটেজে দেখা গেছে, ফিলিস্তিনের লাইসেন্সধারী একটি ফুয়েল ট্রাক ইসরাইলি সেনাদের চৌকিতে সজোরে ধাক্কা মারছে। ওই ট্রাকটি দিয়ে ইসরাইলি সেনাদের চাপা দেন হাইল দাইফাল্লা নামের এক ফিলিস্তিনি। গত দুই সপ্তাহে পশ্চিম তীরের বেশ কয়েকটি জায়গায় সামরিক আগ্রাসন চালায় দখলদার ইসরাইলের সেনারা। এরপরই পশ্চিম তীরের বিভিন্ন জায়গায় আত্মঘাতীসহ বিভিন্ন ধরনের হামলা চালাচ্ছে ফিলিস্তিনিরা।


আরো সংবাদ



premium cement