১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২ আশ্বিন ১৪৩১, ১৩ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

জমির মূল্য ৩৪ গুণ বাড়িয়ে জনতা ব্যাংকের ২৪০ কোটি টাকা ঋণ

-

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারের পতন হলেও পতিত সরকারের প্রেতাত্মারা জনতা ব্যাংকে এখনো সক্রিয় রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ওই লুটপাটচক্র বাণিজ্যিক অডিট আপত্তিকে পাত্তা না দিয়েই বন্ধকি জমির মূল্য মৌজা রেট থেকে ২১ থেকে ৩৪ গুণ বাড়িয়ে তানিয়া মেটাল মার্কেটিং লিমিটেডের নামে ঋণচুক্তি নবায়ন করে এবং তানিয়া ট্রেডিং হাউজ লিমিটেডের নামে ঋণচুক্তি নবায়নে তৎপর রয়েছে। গত পাঁচ বছরে উভয় প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে চার গুণ। অথচ সরকারি সংস্থার ক্রেডিট রিস্ক রেটিং স্কোর অনুযায়ী প্রতিষ্ঠান দু’টির অবস্থান অগ্রহণযোগ্য। সরকারি বাণিজ্যিক অডিটের তথ্য মতে একই মালিকের দু’টি প্রতিষ্ঠানের নামে ২৪০ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হলেও সহজামানত হিসেবে বন্ধক রাখা জমির মৌজা ভ্যালু মাত্র ১৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। তা ছাড়া প্রতিষ্ঠান দু’টির বর্তমান দায় ২৫৮ কোটি টাকা বলে জানা গেছে। জনতা ব্যাংকের চট্টগ্রামের সাধারণ বীমা ভবন করপোরেট শাখা যেন প্রতিষ্ঠান দু’টির সাক্ষাৎ আলাদিনের চেরাগ।
জানা গেছে, জনতা ব্যাংকের সাবেক এমডি আবদুস সালাম আজাদের (২০২৩ সালে অবসরে যাওয়া) কার্যকালে এসব ঋণ অনুমোদিত হয়। গ্রাহক এ পর্যন্ত ঋণের বিপরীতে যা পরিশোধ করেছে তা কেবল সুদের টাকা। ঋণ পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ঋণের মূল টাকা তথা অন্য কোনো ব্যবসায়িক লেনদেন পরিলক্ষিত হয়নি। সূত্র জানায়, বাণিজ্যিক অডিট আপত্তিকে থোড়াই কেয়ার করে অতিসম্প্রতি তানিয়া মেটালের নামে ১৬০ কোটি টাকার ঋণ নবায়ন করা হয়েছে সহজামানত হিসেবে বন্ধক দেয়া জমির মৌজা ভ্যালুর ২১ গুণ বেশি ধরেই। আবার তানিয়া ট্রেডিং হাউজের ৮০ কোটি টাকার ঋণ নবায়নেও তোড়জোড় চলছে। ব্যাংকের ডিমডি গোলাম মুর্তজার বাড়ি চট্টগ্রামে। ঋণগ্রহীতা ও বন্ধকি জমি চট্টগ্রামের পটিয়ার হওয়ায় ওই ডিএমডির বিশেষ আনুকূল্যে এসব ঋণ নবায়ন হচ্ছে এমন অভিযোগ উঠেছে।
ঋণের লেনদেন পর্যালোচনায় দেখা যায়, গ্রাহক দীর্ঘ দিন ধরে কেবল সুদ প্রদান করে আসছে। অন্য কোনো ব্যবসায়িক লেনদেন পরিলক্ষিত হয়নি। ব্যাংকিং-সংশ্লিষ্টরা ফান্ড ডাইভারসনের (অন্য খাতে স্থানান্তর) আশঙ্কা করছেন। মুদ্রা পাচারেরও আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ।
বাণিজ্যিক অডিটে উল্লেখ করা হয়েছে, তানিয়া মেটালের নামে নেয়া ঋণ হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ঋণ হিসাব ডেবিট করে গ্রাহকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান তানিয়া ট্রেডিং হাউজ (প্রা:) লিমিটেডের বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। এতে প্রতীয়মান হয় যে, ঋণের ব্যবহার সম্পর্কে শাখা নিশ্চিত হয়নি। তা ছাড়া ডিভিসি (ডকুমেন্টস ভেরিফিকেশন কোড) নম্বর সংযুক্ত নিরীক্ষিত আর্থিক বিবরণীর মাধ্যমে আইসিআরআর প্রস্তুত করে বিনিয়োগঝুঁকি নির্ধারণ করা হয়নি এবং হাইপোথিকেশনে থাকা মালামালের ওপর কোনো বীমা করা হয়নি।
তানিয়া ট্রেডিং হাউজ (প্রা:) লিমিটেডের নামে পাঁচ বছরে ঋণের প্রবৃদ্ধি চার গুণ বেড়েছে। ২৫ কোটি থেকে বেড়ে ঋণ প্রদান করা হয়েছে ৮০ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটির নামে বর্তমান আউটস্ট্যান্ডিং (দায়) ৮৫ কোটি। সূত্র জানায়, এই প্রতিষ্ঠানের সিসি (চলতি মূলধন) লিমিট ৮০ কোটি এবং পাঁচ কোটি সীমাতিরিক্ত দায় যা অনড ঋণে পরিণত হয়েছে। বাণিজ্যিক অডিট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এই প্রতিষ্ঠানের নামে প্রদত্ত ঋণের বিপরীতে সহজামানত সম্পত্তির মূল্যায়ন মৌজা ভ্যালুর চেয়ে ৩৪ গুণ বেশি অর্থাৎ তিন কোটি ৫৯ লাখ টাকার সম্পত্তিকে ১২০ কোটি ৮৮ লাখ টাকার হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়েছে। তা ছাড়া এই প্রতিষ্ঠানটির বিষয়ে সরকারি সংস্থার ক্রেডিট রিস্ক রেটিং স্কোর ৪৮.৫%, যা অগ্রহণযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও ঋণ বিতরণ করা হয়েছে বলে সূত্র জানায়।
প্রতিষ্ঠানটির এলসি লিমিট ১১০ কোটি এবং এলটিআর (লোন এগেইনস্ট ট্রাস্ট রিসিট) লিমিট ৬০ কোটি। এলটিআর এর ক্ষেত্রে ছয় মাস (১৮০ দিন) মেয়াদে পণ্যমূল্য পরিশোধের বিধান আছে। যার মধ্যে ৩৯ কোটি টাকা ওভারডিউ (অনিয়মিত) হয়েছে বলে জানা গেছে। অথচ এলটিআর-এর ক্ষেত্রে জামানতের বিধান হচ্ছে ১ঃ১, কিন্তু এর বীপরীতে মাত্র ১০ কোটি টাকার এফডিআর জামানত হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়েছে বলেও সূত্র জানায়। এ ছাড়া পিএডি (পেমেন্ট এগেইনস্ট ডকুমেন্ট) ওভারডিউ দায় (ফোর্স লোন সৃষ্টি) রয়েছে ১২ কোটি টাকা। ফলে টোটাল ওভারডিউ ৫১ কোটি বলেও সূত্র জানায়।
তানিয়া মেটাল মার্কেটিং লিমিটেডের নামে ২০১৭ সালে ৪০ কোটি টাকা দিয়ে ঋণ প্রদান শুরু হয়। পাঁচ বছরের মাথায় ২০২২ সালে ঋণের পরিমাণ উন্নীত হয় ১৬০ কোটি টাকায়। ওই ঋণের বর্তমান আউটস্ট্যান্ডিং (দায়) ১৭৩ কোটি। এই ঋণের সিসি (চলতি মূলধন) লিমিট-১৬০ কোটি টাকা এবং ১৩ কোটি টাকা সীমাতিরিক্ত দায় যা অনড ঋণে পরিণত হয়েছে বলে সূত্র জানায়।
সূত্র মতে, এক দিকে একই সহজামানত সম্পত্তি পুনঃমূল্যায়ন করে ঋণের পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। অন্য দিকে সহজামানত সম্পত্তির মৌজা রেটের চেয়ে ২১ গুণ বেশি মূল্যায়িত করা হয়েছে অর্থাৎ মাত্র ৯ কোটি ৭৯ লাখ টাকার সম্পত্তিকে ব্যাংক কর্তৃক ২০৮ কোটি ৪০ লাখ টাকার হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়েছে। বিশাল এই জালিয়াতির মাধ্যমে ২০১৭ সালে ছিল ৪০ কোটি, ২০১৯ সালে ৬০ কোটি, ২০২০ সালে ৯০ কোটি, ২০২১ সালে ১২৫ কোটি, ২০২২ সালে ১৬০ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে নেয় প্রতিষ্ঠানটি।
সূত্র জানায়, ঋণাঙ্কের দেড় গুণ সহজামানত সম্পত্তি নেয়ার বিধান থাকলেও এ ক্ষেত্রে তা পরিপালিত হয়নি। বাণিজ্যিক নিরীক্ষাদল (কমার্শিয়াল অডিট)-এর নিরীক্ষা সুপারিশে বলা হয়েছে- মঞ্জুরিপত্রের শর্ত ও উপরোক্ত বিধিবিধান পরিপালন না করার বিষয়ে দায়দায়িত্ব নির্ধারণ এবং ঋণনীতি ও ঋণঝুঁকি ব্যবস্থাপনা গাইডলাইন অনুযায়ী যথাযথভাবে জামানত মূল্যায়নকরত সম্পূর্ণ ঋণাঙ্ক আবৃত করে সহজামানত গ্রহণপূর্বক ঋণ হিসাবটি ঝুঁকিমুক্ত করা আবশ্যক। যা ব্যাংক পুনঃমূল্যায়ন বা পরিপালন করেনি এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দায়দায়িত্ব নির্ধারণেও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
ইতোমধ্যে তানিয়া মেটাল মার্কেটিং লিমিটেডের নামীয় ঋণ সীমাতিরিক্ত দায় থাকা সত্ত্বেও বাণিজ্যিক অডিটের সুপারিশ উপেক্ষা করে সহজামানত সম্পত্তি যথাযথ মূল্যায়নের কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে ঋণপরবর্তী এক বছরের জন্য নবায়ন করা হয়েছে। তানিয়া ট্রেডিং হাউজ (প্রা:) লিমিটেডের ঋণ সীমাতিরিক্ত দায় থাকা সত্ত্বেও বাণিজ্যিক অডিটের সুপারিশ উপেক্ষা করে সহজামানত সম্পত্তি যথাযথ মূল্যায়নের কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে ঋণপরবর্তী মেয়াদে নবায়নের চেষ্টা চলছে বলে জানা গেছে।
সাধারণত সিসি (হাইপোথিকেশন) লোনের ক্ষেত্রে ঋণাঙ্কের সমপরিমাণ মালামাল কোম্পানি বা গ্রাহকের কাছে মজুদ থাকার কথা। আলোচ্য ঋণ দু’টির সংশ্লিষ্ট গোডাউনগুলোয় মালামালের মজুদ এর ধারে কাছেও নেই বলে সূত্র দাবি করেছে। তা ছাড়া নিজস্ব অথবা ভাড়াকৃত গোডাউন থাকার কথা থাকলেও প্রদত্ত ঠিকানা অনুযায়ী গোডাউনগুলোয় অন্য কোম্পানির সাইনবোর্ড রয়েছে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গাইডলাইনস অন ইন্টারনাল ক্রেডিট রিস্ক রেটিং ফর ব্যাংকস-২০১৮-এর প্যারা ১.৯(ডি) অনুযায়ী, ক্রেডিট রিস্ক রেটিং অগ্রহণযোগ্য হলে তা ঋণগ্রহীতার দুর্বল আর্থিক অবস্থা ও ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা নেই নির্দেশ করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওই গ্রাহকের ঋণসীমা বর্ধিতকরণ করা হয়েছে বাণিজ্যিক অডিটে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে জানতে ব্যাংকের ডিএমডি গোলাম মুর্তজার সেল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি এই প্রতিবেদকের পরিচয় জানার পর রং নাম্বার বলে লাইন কেটে দেন।


আরো সংবাদ



premium cement
সাবেক রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন গ্রেফতার সোনারগাঁয়ে শেখ হাসিনা-শেখ রেহেনাসহ ২৩৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা গাজার চলমান ঘটনাবলী সমসাময়িক বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভুল : বসনিয়া রাজনৈতিক অস্থিরতার পর থেকে ভারতের আসাম-মেঘালয় সীমান্তে আটক ৬৫ বাংলাদেশী ঐক্যের মাধ্যমেই কেবল মুসলিম উম্মাহ'র মর্যাদা প্রতিষ্ঠা সম্ভব : ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হোসেনপুরে স্কুলশিক্ষকের বসতঘর পুড়ে ছাই রাজশাহী, খুলনা ও চট্টগ্রামে ভারী বৃষ্টির আভাস 'শ্রম আইন সংস্কার করে শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার বাস্তবায়ন করতে হবে' সিংগাইরে ধলেশ্বরী নদী থেকে লাশ উদ্ধার সাতক্ষীরায় বজ্রপাতে মৎস্যচাষির মৃত্যু সাংবাদিক শ্যামল দত্ত ও মোজাম্মেল বাবুর ওপর ডিম নিক্ষেপ

সকল