১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৩১ ভাদ্র ১৪৩১, ১১ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`
গাজায় ৬ বন্দীর লাশ উদ্ধার

নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে বিক্ষোভের ডাক

-

- জেনিনে খাবার নেই, পানি-বিদ্যুৎ বন্ধ
- ইসরাইল-ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের সংঘর্ষ
- যুদ্ধবিরতি ও বন্দিমুক্তি নিয়ে নেতানিয়াহু-প্রতিরক্ষামন্ত্রী বিতণ্ডা

ফিলিস্তিনের গাজার একটি সুড়ঙ্গ থেকে ছয় বন্দীর লাশ উদ্ধার করেছে ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)। গতকাল রোববার রাফাহ ক্রসিংয়ের সুড়ঙ্গের ভেতর তাদের লাশ পাওয়া যায়। আইডিএফ জানিয়েছে, ইসরাইলি এসব বন্দীকে কয়েক দিন আগেই হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ছয় বন্দীর লাশ পাওয়ার পর দখলদার ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছেন সাধারণ ইসরাইলিরা। টাইমস অব ইসরাইল, আলজাজিরা ও রয়টার্স।
বন্দীদের পরিবারের সদস্যদের সংগঠন আন্দোলনে নামার ঘোষণা দিয়েছেন। তারা বলেন, নেতানিয়াহু যদি হামাসের সাথে চুক্তি করতেন তা হলে এই ছয়জনকে জীবিত অবস্থায় পাওয়া যেত। কারণ তারা কয়েক দিন আগেও জীবিত ছিলেন। ইসরাইলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমান বিরোধীদলীয় নেতা ইয়াইর লাপিদও নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, নেতানিয়াহু ও তার মৃত মন্ত্রী পরিষদের কারণে বন্দীরা জীবিত ফিরতে পারেননি। ছয় বন্দীর লাশ উদ্ধারের পর চাপে পড়ে হামাসের ওপর দায় চাপিয়ে একটি ভিডিওবার্তা দিয়েছেন নেতানিয়াহু। তিনি দাবি করেছেন, গত ডিসেম্বর থেকেই হামাসের সাথে যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন তিনি। কিন্তু হামাস রাজি হচ্ছে না। তিনি বলেছেন, গত ১৬ আগস্টও যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া নতুন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে সম্মত হয়েছিল ইসরাইল। কিন্তু হামাস এতে রাজি হয়নি। নেতানিয়াহু বলেছেন, ‘যারা বন্দীদের হত্যা করে তারাই যুদ্ধবিরতি চায় না।’ তবে তা সত্ত্বেও হামাসের সাথে যুদ্ধবিরতির চেষ্টা চালিয়ে যাবেন বলে জানিয়েছেন যুদ্ধাপরাধের অপরাধে অভিযুক্ত নেতানিয়াহু।
এ দিকে ইসরাইলি নিরাপত্তা বাহিনী রোববার তাদের বিবৃতিতে বলেছে, ‘বন্দীদের লাশ ইসরাইলে ফেরত আনা হয়েছে। তাদের সবাইকে ৭ অক্টোবর বন্দি করা হয়েছিল।’ বিবৃতিতে আরও বলা হয়, নিহতদের পরিবারের সাথে ইতোমধ্যে যোগাযোগ করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর বিবৃতি অনুযায়ী ছয় বন্দীর নাম কারমেল গ্যাট, এডেন ইয়েরুশালমি, হেরশ গোল্ডবার্গ-পোলিন, আলেক্সান্ডার লোবানোভ, আলমগ সারুসি ও মাস্টার সার্জেন্ট ওরি ডানিনো। মুখপাত্র রিয়ার অ্যাডমিরাল ড্যানিয়েল হাগারি বলেছেন, ‘বন্দীদের লাশ খুঁজে পাওয়ার কিছুক্ষণ আগে তাদের হত্যা করেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।’ মার্কিন নাগরিক গোল্ডবার্গ-পোলিনের মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, ‘এই খবরে আমি বিপর্যস্ত ও ক্ষুব্ধ।’
নেতানিয়াহু-গ্যালান্ট বাগি¦তণ্ডা
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ ভূখণ্ড গাজাতে যুদ্ধবিরতি চুক্তির শর্ত এবং বন্দী মুক্তি নিয়ে ব্যাপক বাগি¦তণ্ডায় জড়িয়ে পড়েছেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট। গত বৃহস্পতিবার রাতে দেশটির নিরাপত্তাসংক্রান্ত মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ ঘটনা ঘটে। ইসরাইলি সংবাদমাধ্যমগুলোর বরাতে এ খবর জানিয়েছে মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএন। টাইমস অব ইসরাইলের বরাতে সিএনএন জানায়, কোনো চুক্তির অংশ হিসেবে ফিলাডেলফি করিডোর থেকে ইসরাইলি সেনারা সরে যাবেন কি না, এমন প্রশ্নে ঝগড়া করেন নেতানিয়াহু ও গ্যালান্ট। ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই করিডোর গাজা-মিসর সীমান্তে অবস্থিত।
বর্তমানে ফিলাডেলফি করিডোর ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনী আইডিএফের নিয়ন্ত্রণের রয়েছে। যুদ্ধবিরতির প্রথমপর্যায়ে করিডোরটিতে ইসরাইলি সেনা মোতায়েন, ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে বিরোধের প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। হামাসের দাবি, যুদ্ধবিরতির সময় ইসরাইলি সৈন্যদের অবশ্যই সীমান্ত অঞ্চল থেকে প্রত্যাহার করতে হবে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবারের বৈঠকে নেতানিয়াহু একটি ম্যাপ দেখিয়ে বলেন, মন্ত্রিসভার অনুমোদনসাপেক্ষে তিনি ফিলাডেলফি করিডোরে ইসরাইলি সেনা মোতায়েন রাখতে চান। তখন গ্যালান্ট বলেন, এতে হামাস একমত হবে না। ফলে তারা কোনো যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে যাবে না। এর জেরে বন্দী ব্যক্তিদেরও ইসরাইলে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না।
এ বিষয়ে বেশ কিছুক্ষণ উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয় নেতানিয়াহু এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের মধ্যে। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ক্ষুব্ধভাবে দাবি প্রত্যাখ্যান করলেও গ্যালান্ট অবিচল ছিলেন। বৈঠকে চিফ অব দ্য জেনারেল স্টাফ হারজি হালেভির কাছ থেকে সমর্থন পেয়েছিলেন গ্যালান্ট। গ্যালান্ট অভিযোগ করেন, নেতানিয়াহু কায়রোতে ইসরাইলি আলোচকদের পছন্দের ভিন্ন মানচিত্র তৈরি করেছেন। এ সময় রাগান্তিতভাবে নেতানিয়াহু তার প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দাবি উড়িয়ে দেন। কিন্তু গ্যালান্ট জোর দিয়ে বলেছেন, আপনি অবশ্যই এটি জোর করে করেছেন।
গ্যালান্ট আরো বলেন, প্রধানমন্ত্রী প্রকৃতপক্ষে সব সিদ্ধান্ত নিতে পারেন এবং তিনি সব বন্দীকে হত্যার করার সিদ্ধান্তও নিতে পারেন। ৩০ জন বন্দীর জীবন শঙ্কার মধ্যে আছে বলে উল্লেখ করেছেন ইসরাইলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী। পরে নেতানিয়াহুর উপস্থাপন করা ম্যাপের অনুমোদনের জন্য ভোটাভুটির আয়োজন করা হয়। নেতানিয়াহুর পক্ষে ভোট পড়ে আটটি। বিপক্ষে ভোট দেন শুধু গ্যালান্ট। আর ভোটদানে বিরত ছিলেন ডানপন্থী জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন গভির।
জেনিনে খাবার নেই :
ইসরাইলের মুহুর্মুহু বোমা হামলায় তছনছ হয়ে গেছে ফিলিস্তিনের পশ্চিমতীরের জেনিন শরণার্থী শিবির। ০.৪২ বর্গকিলোমিটারজুড়ে থাকা ছোট্ট উদ্বাস্তু শিবির এখন ধ্বংসস্তূপ। সেখানে বাঁচার জন্য মানুষের খাবার নেই। এরই মধ্যে নতুন করে পানি, বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন করে অভিযান চালাচ্ছে ইসরাইলি সেনাবাহিনী। ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পোলিও টিকাদান কর্মসূচি সফল করতে অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ‘প্রকৃত যুদ্ধবিরতি’ প্রয়োজন।
পশ্চিমতীরে সংঘর্ষ :
অধিকৃত পশ্চিমতীরের জেনিন শহরে ইসরাইলের চলমান সামরিক অভিযানের মধ্যে গত শনিবার ইসরাইলি সেনাদের সাথে ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের সংঘর্ষ বেঁধে যায়। শুক্রবার সন্ধ্যায় পৃথক দু’টি ঘটনা ঘটার পর ইসরাইলি সেনারা ইহুদি বসতিগুলোর চারপাশের এলাকায় তল্লাশি চালাতে শুরু করে। জেনিনে মাথার ওপর ড্রোন ও হেলিকপ্টারগুলোকে চক্কর কাটতে দেখা যায় আর তখন শহরটিতে বিক্ষিপ্ত গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছিল।
বুধবার থেকেই পশ্চিমতীরে অভিযান চালাচ্ছে শত শত ইসরাইলি সেনা। এটি কয়েক মাসের মধ্যে অধিকৃত অঞ্চলটিতে তাদের সবচেয়ে বড় সামরিক অভিযান। তাদের নাগরিকদের ইরান সমর্থিত ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে এ অভিযান শুরু করা হয়েছে বলে দাবি ইসরাইলের, কিন্তু আন্তর্জাতিক বহু পক্ষ এ অভিযান বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে। অভিযানটি শুরু হওয়ার পর থেকে বেসামরিক ও যোদ্ধাসহ এ পর্যন্ত অন্তত ২০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে শারীরিক প্রতিবন্ধী এক ফিলিস্তিনিও আছেন বলে জানিয়েছে আলজাজিরা।
পোলিও ভ্যাকসিনেশন শুরু :
গাজায় তিন দিনের মানবিক যুদ্ধবিরতিতে ছয় লাখ ৪০ হাজার শিশুকে ১৩ লাখ পোলিও ডোজ খাওয়ানো হচ্ছে। গতকাল রোববার থেকে গাজা উপত্যকায় ভ্যাকসিনেশন ক্যাম্পেইন চালাচ্ছে জাতিসংঘের বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। আগামীকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত তিন দিন এ কার্যক্রম চলবে। এই তিন দিন মানবিক যুদ্ধবিরতি বজায় রাখতে ইসরাইল রাজি হওয়ার পর রোববার গাজায় শিশুদের পোলিও টিকা খাওয়াবে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা। জানা গেছে, রোববার থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত মোট ৩ দিন ১০ বছর বয়সের নিচে ছয় লাখ ৪০ হাজার শিশুকে পোলিও ডোজ খাওয়ানোর উদ্যোগ নিয়েছেন দুই হাজার স্বেচ্ছাসেবী।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) জানায়, ২৫ বছর পর গাজায় এবারই প্রথম ১০ বছর বয়সের এক শিশুকে পাওয়া গেছে, যে পোলিও রোগে আক্রান্ত। সে এখন পায়ের প্যারালাইসিসে ভুগছে। সংস্থাটি জানায়, ধারণা করা হচ্ছে, গাজায় উপসর্গবিহীন শতাধিক পোলিও আক্রান্ত রোগী রয়েছে। বেশির মানুষেরই পোলিও রোগের উপসর্গ সম্পর্কে ধারণা নেই। অনেকেই হয়ত সপ্তাহখানেকের মধ্যে সুস্থ হয়ে যান। পোলিও রোগে আক্রান্ত হলে শেষমেষ রোগী পঙ্গুত্ববরণ করে। এ রোগ শ্বাসপ্রণালীর মাংসপেশিকে আক্রান্ত করে।
গাজা উপত্যকায় পোলিও টিকা খাওয়ানো একেবারে সহজসাধ্য কাজ হবে না। কারণ গাজার রাস্তা, হাসপাতালসহ ঘরবাড়ি ভীষণ খারাপভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া স্থানীয় বাসিন্দারা বাস্তুচ্যুত হয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছেন। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) জানায়, সংস্থাটি গাজার শিশুদের পোলিও ভ্যাকসিন খাওয়ানোর জন্য ইসরাইলের সাথে সমঝোতায় পৌঁছেছে। তবে এ মানবিক যুদ্ধবিরতিতে তাদের অনেক সমস্যায় পড়তে হবে। কারণ গাজার ৯০ শতাংশ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছেন।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল