১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৮ ভাদ্র ১৪৩১, ৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি
`

গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনিশ্চিত রেখেই মধ্যপ্রাচ্য ছাড়লেন ব্লিনকেন

-

- রাফায় ৪০ জনকে হত্যার দায় স্বীকার ইসরাইলি বাহিনীর
- যুদ্ধবিরতি নস্যাতে নেতানিয়াহুকে দায়ী করছে ইসরাইলিরা

হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনিশ্চিত রেখেই মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন মধ্যপ্রাচ্য ত্যাগ করেছেন। দোহা থেকে ওয়াশিংটন ফেরার মাধ্যমে তার এবারের সফর শেষ হয়। দেশে রওনা করার আগে তিনি দোহায় সাংবাদিকদের বলেছেন, চুক্তিটি দ্রুতই সম্পন্ন করা প্রয়োজন। ইসরাইল যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবে সম্মত হয়েছে উল্লেখ করে হামাসকেও তা মেনে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। দ্য গার্ডিয়ান, ডেইলি সাবাহ ও আলজাজিরা।

গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি চূড়ান্ত করতে যুক্তরাষ্ট্র জোরালো প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তার অংশ হিসেবেই রোববার ইসরাইল ভ্রমণ করেন ব্লিনকেন। এরপর মিসর ও কাতারে মধ্যস্থতাকারীদের সাথে বৈঠক করেন। আলোচনায় হামাস প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেনি। তিনি বলেছেন, গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তি চূড়ান্ত করা এখন ‘সময়ের দাবি’। চুক্তি বাস্তবায়ন হলে ইসরাইল-হামাসের মধ্যে ১০ মাসের বেশি সময় ধরে চলা সংঘর্ষের অবসান হবে বলে আশা ব্লিনকেন এবং অন্য মধ্যস্থতাকারীদের। আলোচনা চলমান থাকবে বলে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আশা প্রকাশ করা হয়।

এ দিকে সর্বশেষ প্রস্তাবে ইসরাইলের দাবির প্রতিফলনই বেশি ঘটেছে বলে মন্তব্য করেছে হামাস। গত মঙ্গলবার তারা এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ইসরাইলের সাথে যুদ্ধবিরতি চুক্তি করতে তারা অনিচ্ছুক বলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট যে মন্তব্য করেছেন, তা ‘বিভ্রান্তিকর’। যুদ্ধবিরতি আলোচনায় হামাসের অন্যতম দাবি, গাজা থেকে ইসরাইলি সেনা সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহার অগ্রাহ্য করে আসছে দেশটি। ফলে যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা এখনো অধরাই রয়ে গেল।
মঙ্গলবার আগস্ট মিসর সফর শেষে দোহায় এসে পৌঁছান বলে জানায় কাতারের সংবাদমাধ্যম দোহা নিউজ। এ সময় কাতারের আমির তামিম বিন হামাদ আলে-সানি বিদেশ সফরে থাকায় তার সাথে ফোনে কথা হয় মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর। ইসরাইল ও মিসরের নেতাদের সাথে আলোচনার অগ্রগতি বিষয়ে তাকে অবহিত করেন।

অ্যান্টনি ব্লিনকেন কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মেদ আল খুলাইফির সাথে বিস্তারিত আলোচনা করেন। দুই পক্ষই সর্বশেষ মধ্যস্থকারী হিসেবে আলোচনার অগ্রগতি আরো ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখার বিষয়ে আলোচনা করেন। তাদের মধ্যকার আলোচনার বিষয়ে কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতি প্রকাশ করে।
তাতে বলা হয়, গাজায় যুদ্ধবিরতি ও বন্দিবিনিময়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। এ সময় তারা মধ্যপ্রাচ্যে আরো যুদ্ধ বিস্তৃতি রোধে সব পক্ষকে শান্ত থাকার আহ্বান জানানো হয়। এ ছাড়া পরবর্তীতে আরো করণীয় বিষয়ে আলোচনা তারা আলোচনা করেছেন বলে জানানো হয়েছে। এরপর বুধবার কাতার ত্যাগ করেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন।
মধ্যস্ততাকারীদের চেষ্টা অব্যাহত থাকলেও ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস বলছে, ইসরাইলের একগুঁয়েমির কারণেই চুক্তিটি হচ্ছে না। গাজার যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এ নিয়ে নবমবারের মতো মধ্যপ্রাচ্য সফর করলেন ব্লিনকেন। একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তির জন্য তিনি চেষ্টা করেন। কিন্তু এখনো সফল হতে পারেননি।

মঙ্গলবার তিনি মিসরে গিয়ে প্রেসিডেন্ট আবদুল ফাত্তাহ আল-সিসির সাথে সাক্ষাত করেন। মিসরীয় নেতা তাকে আরো বড় আঞ্চলিক সঙ্ঘাতের ব্যাপারে সতর্ক করে দেন। ব্লিনকেন মিসর থেকে কাতারের রাজধানী যান। সেখানেও তিনি যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা করেন। দোহা ত্যাগের আগে তিনি আবারো একটি চুক্তির ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, কেবল ইসরাইলি পণবন্দী এবং ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের জন্যই নয়, বরং আঞ্চলিক উত্তেজনা বাড়া প্রতিরোধ করার জন্যও যুদ্ধবিরতি চুক্তি খুবই প্রয়োজন।

এর আগে ব্লিনকেন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্রের সংশোধিত প্রস্তাব ইসরাইল মেনে নিয়েছে। এখন হামাসকে তা মেনে নিতেই হবে। কিন্তু হামাস বলছে, সর্বশেষ প্রস্তাবটি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মে মাসে দেয়া মূল কাঠামোগত চুক্তি থেকে সরে গেছে। এই প্রেক্ষাপটে কায়রোতে আলোচনা অব্যাহত থাকবে বলে আশা করা হলেও যুদ্ধবিরতি চুক্তি হচ্ছে না বলেই মনে হচ্ছে।
নেতানিয়াহু এখনো জোর দিয়ে বলছেন যে ইসরাইলি সেনাবাহিনী অবশ্য গাজার কৌশলগত স্থানগুলোতে অবস্থান করবে। এ ছাড়া হামাসকে নির্মূল করাসহ তাদের ঘোষিত লক্ষ্যগুলোও তারা হাসিল করবে। আর তা করার জন্য আবার যুদ্ধ শুরু করতে হলেও তারা তা করবে। অন্য দিকে হামাস স্থায়ী যুদ্ধবিরতি এবং গাজা থেকে ইসরাইলি বাহিনীর পূর্ণ প্রত্যাহার দাবি করছে।

যুদ্ধবিরতি নস্যাতে নেতানিয়াহুকে দায়ী করছে ইসরাইলিরা : গাজায় যুদ্ধবিরতির আলোচনাকে ব্যাহত করার জন্য ইসরাইলের যুদ্ধবাজ প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। দেশটির পাবলিক ব্রডকাস্টার কান মঙ্গলবার আলোচনাকারী দলের সূত্রের বরাত দিয়ে এ অভিযোগের কথা জানিয়েছে। ইসরাইলি গণমাধ্যমটি বলেছে, অভিযোগটি গাজায় ইসরাইলি বন্দীদের পরিবারের প্রতিনিধিদের সাথে নেতানিয়াহুর সাম্প্রতিক বৈঠক সম্পর্কে মিডিয়ায় যে তথ্য ফাঁস হয়েছে, তার সাথে মিলে যায়। নেতানিয়াহু সে সময় স্বীকার করেছিলেন যে, তিনি ফিলিস্তিনিদের সাথে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে পৌঁছানোর বিষয়ে অনিশ্চিত ছিলেন।

ইসরাইলের আলোচনাকারী দলের সূত্রের বরাত দিয়ে ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ‘নেতানিয়াহুর সাম্প্রতিক বিবৃতিগুলোর লক্ষ্য ছিল আলোচনাকে নাশকতা করা’। কান জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু সচেতন যে ইসরাইলিরা একটি সঙ্কটময় সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কারণ ইসরাইলি বাহিনী ফিলাডেলফি করিডোর এবং নেটজারিম প্যাসেজের সমাধান খুঁজতে কাজ করছে। ইসরাইলি সরকার এ বিষয়টিকে পরবর্তী বৈঠকের আগে উপস্থাপন করবে বলেও ঠিক করেছে। যেটি মধ্যস্থতাকারীদের সাথে কায়রোতে অনুষ্ঠিত হবে। যদিও এ বৈঠকের তারিখ এখনো নির্ধারণ করা হয়নি।
ইসরাইলি গণমাধ্যমটি আরো জানিয়েছে, তবে নেতানিয়াহু এমন সব বিবৃতি দিচ্ছেন, যা মধ্যস্থতাকারীদের সাথে একমত হওয়া বিষয়গুলোর সাথে সাংঘর্ষিক। গাজায় বন্দী ইসরাইলিদের পরিবারের সাথে বৈঠকের সময় দেশটির সংবাদমাধ্যম মারিব জানায়, নেতানিয়াহু বলেছেন- ইসরাইল কোনো অবস্থাতেই এমনকি প্রচণ্ড চাপের মধ্যেও ফিলাডেলফি করিডোর এবং নেটজারিম প্যাসেজের দখল ছাড়বে না।
গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে গাজা উপত্যকায় ইসরাইল তার নৃশংস হামলা অব্যাহত রেখেছে। জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানো সত্ত্বেও। স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের মতে, ইসরাইলি আগ্রাসনে এ পর্যন্ত ৪০ হাজার ১৭০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। যাদের বেশির ভাগই নারী এবং শিশু। এ ছাড়া আহত হয়েছেন ৯২ হাজার ৭৪০ জনেরও বেশি।

রাফায় ৪০ জনকে হত্যার দায় স্বীকার ইসরাইলি বাহিনীর : গাজা উপত্যকার দক্ষিণাঞ্চলীয় এলাকা রাফায় খুব কাছ থেকে লড়াই ও বিমান হামলার মাধ্যমে প্রায় ৪০ জনকে হত্যার করেছে বলে স্বীকার করেছে ইসরাইল। গত মঙ্গলবার ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) এ খবর দিয়েছে। আইডিএফ জানিয়েছে, রাফার তেল আল-সুলতান এলাকায় লক্ষ্যবস্তুতে অভিযান অব্যাহত রেখেছে ইসারইলি সৈন্যরা। সৈন্যরা স্থানীয় একটি সামরিক কাঠামোর মধ্যে রকেটচালিত গ্রেনেড সজ্জিত একটি ‘সন্ত্রাসী সেল’ শনাক্ত করার পর ইসরাইলি বিমান বাহিনী (আইএএফ) সেখানে হামলা করে। আইডিএফ আরো জানায়, এ ছাড়াও একটি সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে আসা দুইজনকে লক্ষ্য করেও হামলা চালায় বিমানবাহিনী। হামাস নির্মূলে ইসরাইলের বৃহৎ অভিযানগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম।

আরো ৫২ জন নিহত : ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর হামলায় গত ২৪ ঘণ্টায় আরো ৫২ ফিলিস্তিনি নাগরিক নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে গাজা শহরের একটি স্কুলে ১২ জন এবং দেইর এল-বালাহ শহরের একটি এলাকায় ৯ জন নিহত হয়েছে। গতকাল বুধবার আলজাজিরার এক খবরে এ তথ্য জানা গেছে। খবরে বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টা ধরে গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি সামরিক বাহিনী বোমাহামলা চালিয়েছে। দেইর আল-বালাহ শহরের একটি এলাকায় ৯ এবং গাজা শহরের একটি স্কুলে ১২ জনসহ অন্তত ৫২ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement