০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৮ ভাদ্র ১৪৩১, ২৭ সফর ১৪৪৬
`

ছাত্রলীগে পদত্যাগের হিড়িক

-

কোটা সংস্কার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া বক্তব্য ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে পদত্যাগ করছেন সংগঠনটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। গতকাল মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত চারটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত দেড় শতাধিক নেতাকর্মী পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন।

গত রোববার চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর ওই দিন রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ছাত্রলীগের পাঁচজন নেতা পদত্যাগ করেন। এরপর দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয় পদত্যাগের হিড়িক।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত পদত্যাগ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদ এবং কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পক্ষে অবস্থানের কথা জানান দেয়ার মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে পদত্যাগের ঘোষণা দেন ওই সব নেতাকর্মী। পদত্যাগকারী শিক্ষার্থীরা দাবি করছেন, যেই ছাত্র সংগঠন সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর বর্বরোচিত হামলা চালায়, নারী শিক্ষার্থীদের ওপর নৃশংস হামলা করে, তারা সুস্থ মস্তিষ্কের কেউ নয়। তাদের সাথে সম্পর্ক রাখা অনুচিত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলের সহসভাপতি পদ থেকে পদত্যাগ করা শিপন মাহমুদ ফেসবুকে লিখেছেন, আমি চলমান ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান করছি। ন্যায়ের পক্ষে থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শোকজ খাওয়া এবং মুচলেকার মুখে পড়া ছাত্র আমি। আমি আজীবন নজরুল। প্রতিবাদ আমার রক্তে। আমি আজন্ম প্রতিবাদী পুরুষ। আমি মো: শিপন মিয়া, সহসভাপতি, বিজয় একাত্তর হল ছাত্রলীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। চলমান যৌক্তিক ছাত্র আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন প্রদান করে, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, বিজয় একাত্তর হল-এর সহসভাপতির পদ থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করলাম। অন্যায় আর শিপন এক লাইনে থাকে না। কুয়েত মৈত্রী হল থেকে পদত্যাগ করা জুয়েনা আলম মুন লিখেছেন, আমি জুয়েনা আলম মুন, অর্থ সম্পাদক বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ছাত্রলীগকে ন্যায়ের কাণ্ডারি ভেবে ছাত্রলীগ করতাম। কিন্তু এখন এই সংগঠনের সাথে নিজের সম্পৃক্ততা ছিল এটা মনে করলেও আমার রক্তাক্ত বন্ধু-বান্ধবী, সিনিয়র, জুনিয়রদের চেহারা মনে পড়বে। তাই স্বেচ্ছায়, সজ্ঞানে পদত্যাগ করছি। এ রকম আশিকুর রহমান জীম মাস্টার দ্য সূর্যসেন হল ছাত্রলীগের কার্যকরী সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করার ঘোষণা দিয়েছেন এবং তিনি লিখেছেন, আইন অনুষদের গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক থেকে পদত্যাগ ঘোষণা করছি।

পদত্যাগ প্রসঙ্গে জান্নাতুল মাওয়া লিখেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রোকেয়া হল সহসভাপতি পদ থেকে মুক্তি নিলাম, পদত্যাগ ঘোষণা করেছি, যেহেতু রাজাকার বলে আখ্যায়িত করেছেন, রাজাকার হয়েই থাকতে চাই।

এছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল ছাত্রলীগের সহসভাপতি হাসিবুল হাসান হাসিব, কুয়েত মৈত্রী হলের বিজ্ঞান উপ-সম্পাদক জেবা সায়ীমা, মেহেরুন্নিসা মিম নাট্য ও সাহিত্যবিষয়ক সম্পাদক এবং মনিরা তিশা আইন সম্পাদক, প্রচার সম্পাদক আমরিন জান্নাত তাইরু, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি নুরুল ইসলাম হৃদয়, মেহেদী হাসান কার্যনির্বাহী সদস্য, জসীমউদ্দিন হল ছাত্রলীগের মো: রাফিউল ইসলাম রাফি, বিজয় একাত্তর হল শাখার গ্রন্থনা ও প্রকাশনা উপসম্পাদক শাহ সাকিব সাদমান প্রান্ত, শামসুন নাহার হল ছাত্রলীগের উপপাঠাগার সম্পাদক ইসরাত জাহান সুমনা, সার্জেন্ট জহরুল হক হল ছাত্রলীগের সহসভাপতি ওয়াসিক এবং রাসেল হোসেন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ শাখার গণযোগাযোগ ও উন্নয়ন সম্পাদক মাছুম শাহরিয়ার, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট শাখার মুক্তিযুদ্ধ ও গবেষণাবিষয়ক উপ-সম্পাদক রাতুল আহামেদ ওরফে শ্রাবণ, কলাভবন ছাত্রলীগের ১ নং সহসম্পাদক মো: মুহাইমিনুল ইসলামসহ আরো কয়েক বেশ কয়েকজন পদত্যাগ করেছেন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কার্যনির্বাহী সদস্য ইমরান আহমেদ তার ফেসবুক পোস্টে লেখেন, একটা আদর্শ বুকে নিয়ে কোনপ্রকার স্বার্থের বাইরে ছাত্রলীগের রাজনীতি করতাম। কিন্তু গতকাল রাতের ঘটনার পরও যদি চুপ থাকি তাহলে নিজের বিবেক আর আদর্শের কাছে সারাজীবন অপরাধী হয়ে থেকে যাব। আমি ইমরান বশর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কার্যনির্বাহী সদস্য। আজকের পর থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সমস্ত রকম কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে অব্যাহতি দিলাম। শাখা ছাত্রলীগের সহসম্পাদক আফরিন আলম রিমি ফেসবুকে দেয়া পোস্টে বলেন, বিবেকের কাছে পদ-পদবি, ক্ষমতার জন্য হেরে যেতে পারব না। আমি আফরিন আলম রিমি, আজ থেকে সমস্ত ধরনের ছাত্রলীগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে নিষ্কৃতি দিলাম।

এছাড়াও কোটা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় প্রতিবাদ জানিয়ে শেখ রাসেল হল শাখা ছাত্রলীগের দফতর সম্পাদক মোহাম্মদ সামি, শাখা ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক নিয়ামুল আরফে (বিএমবি ৪৭) ও খাদিজা জুই (গণিত ৪৯), সিদরাতুল মুনতাহা (নবাব ফয়জুন্নেছা হল সেক্রেটারি), রিপনুল ইসলাম রবিনসহ অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে পদত্যাগ করেছেন।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ থেকে এখন পর্যন্ত এমন ছয়জনের নাম পাওয়া গেছে। পদত্যাগ শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার বিভিন্ন ইউনিটের নেতাকর্মী। সামাজিকমাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়ে ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করা এসব নেতা হলেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ শাখার সহ-সভাপতি মাহমুদুল হাসান সামি ও রসায়ন বিভাগ শাখার সহসভাপতি তাওসিফ কবির, মনোবিজ্ঞান বিভাগ শাখার সহসভাপতি রনি সরকার ও যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মো: আশিকুর রহমান এবং ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ শাখার সহসভাপতি মাহমুদুল হাসান নোমান এবং শিঞ্জন বসাক।

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ছাত্রলীগ থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ৫০ জন শিক্ষার্থীর নাম পাওয়া গেছে। পদত্যাগ শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের বিভিন্ন ইউনিটের নেতাকর্মী। বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী হল শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পদ থেকে প্রথম পদত্যাগকারী নুসরাত জাহান সুরভী বলেন, ‘আপনিও মানুষ, আমিও মানুষ। আপনিও জানেন দেশে কি হচ্ছে। সেই মানবিক দিক বিবেচনা করে আমি শাখা ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করেছি।’

ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত হল শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো: বোরহান উদ্দিন তার ফেসবুকে লেখেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিন থেকে ছাত্র রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম। ছাত্র রাজনীতি ছিল আমার পছন্দের জায়গা, ভালোবাসার জায়গা। আজকের পর থেকে ছাত্রলীগের সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। কেউ আমাকে ডাকবেন না, ধন্যবাদ।’ আরেক পদত্যাগকারী লেখেন, ‘আমি রাহিলাতুল শবনম মিম। আমিসহ নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী হলের ১৬তম ব্যাচের সব পলিটিক্যাল মেয়ে ছাত্রলীগ থেকে ইস্তফা দিলাম। আজ থেকে লীগের কোনো প্রোগ্রামে আমরা যাব না।’

 


আরো সংবাদ



premium cement