০২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৮ ভাদ্র ১৪৩১, ২৭ সফর ১৪৪৬
`

নিষিদ্ধের পরও থেমে নেই বালাইনাশক কার্বোফুরান বেচা-বিক্রি

কঠোর অবস্থানে সরকার
-

নিষিদ্ধ হয়েছে প্রায় সাড়ে সাত মাস হলো। কিন্তু এখনো মাঠে বিক্রি হচ্ছে বিষাক্ত কীটনাশক কার্বোফুরান। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরে প্রায় দেড় টন এবং গত জুলাইয়ে নীলফামারীর সৈয়দপুরে প্রায় ৯৯ টন নিষিদ্ধ বালাইনাশক কার্বোফুরান জব্দ করা হয়। এর মধ্যে সৈয়দপুরে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে গ্রেফতার এবং বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করা হয়েছে। অন্য দিকে কোটচাঁদপুরে জব্দ কার্বোফুরান ধ্বংস করে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে বলে জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, কার্বোফুরান একটি দানাদার কীটনাশক। এটা এতটাই ভয়ঙ্কর যে, জমিতে একবার ব্যবহার করলে ফসলে এর বিষাক্ততা ৩০ দিন পর্যন্ত লেপ্টে থাকে। এটি প্রতিরোধক ও প্রতিষেধক দুই কাজই করে। এই বালাইনাশক আগে ব্যবহার করলে ফসলের ধারেকাছেও পোকা আসে না, আর কীটপতঙ্গ হানা দেয়ার পর ব্যবহারে কীট মুহূর্তেই মারা পড়ে। কার্বোফুরানের বিষাক্ততা মানবস্বাস্থ্য ও আবাদযোগ্য জমির উর্বরতার জন্য ক্ষতিকর উল্লেখ করে ২০১৬ সালে তা নিষিদ্ধের আহ্বান জানায় জাতিসঙ্ঘ। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে গত বছরের ৩০ জুন কার্বোফুরান নিষিদ্ধ করে সরকার। পরে আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীদের আবদারে নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা গত ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। সাড়ে সাত মাস অতিবাহিত হয়েছে কার্বোফুরান নিষিদ্ধের। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে এখনো এর ব্যবহার অব্যাহত রয়েছে বলে জানা যায়। কার্যকর নজরদারি না থাকায় নিষিদ্ধ কার্বোফুরান এখনো বেচাকেনা হচ্ছে সারা দেশে।
তবে সম্প্রতি সৈয়দপুর ও কোটচাঁদপুরে বিপুল পরিমাণ কার্বোফুরান পাওয়া যাওয়ায় নড়েচড়ে বসে কৃষি মন্ত্রণালয়সহ প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরা। গত ২৫ জুন নীলফামারীর সৈয়দপুর বিসিক শিল্পনগরীর একটি গুদাম থেকে প্রায় ৯৯ টন নিষিদ্ধ ব্রিফার জি-৫ (কার্বোফুরান) জব্দ করে স্থানীয় প্রশাসন। উপজেলা প্রশাসন, কৃষি বিভাগ, র‌্যাব ও পুলিশের যৌথ অভিযানে এসব বালাইনাশক জব্দ করা হয়। এ সময় গোডাউনের মালিক মনোয়ার হোসেনকে (৫২) গ্রেফতার করা হয়েছে। রথ্যাব জানায়, সৈয়দপুরে গোডাউনে মজুদ রাখা এসব নিষিদ্ধ কীটনাশক ট্রাকযোগে যশোরে পাঠানোর খবর পেয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা যৌথভাবে অভিযান চালান।

সৈয়দপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ধীমান ভূষণ বলেন, জব্দকৃত এসব কার্বোফুরানের বাজারমূল্য প্রায় ১ কোটি ৬৭ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। এ ঘটনায় নিজে বাদি হয়ে সৈয়দপুর থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫ ধারায় একটি মামলা করা হয়েছে। একইভাবে জব্দকৃত নিষিদ্ধ বালাইনাশক কার্বোফুরান গোডাউনে রেখে সিলগালা করা হয়েছে বলে জানান সৈয়দপুর থানার ওসি শাহা আলম।
এ ঘটনার সপ্তাহ না পেরুতেই চলতি জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরে অভিযান চালিয়ে প্রায় ১৪ শ’ কেজি কার্বোফুরান জব্দ করে স্থানীয় প্রশাসন। পরে তা ধ্বংস করে দেয়া হয় বলে জানান স্থানীয় উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রাজিবুল হাসান। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে এই অভিযানের সময় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে শাস্তি হিসেবে ১ হাজার টাকা জরিমানা করা হয় বলে জানান উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা।
এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের ঝিনাইদহ জেলার উপপরিচালক ষষ্ঠি চন্দ্র রায় নয়া দিগন্তকে জানান, মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে নিষিদ্ধ কার্বোফুরান জব্দ করে তা ধ্বংস করা হয়েছে।
সৈয়দপুর ও কোটচাঁদপুরে জব্দ হওয়া কার্বোফুরান এসিআই কোম্পানির বলে জানা যায়। এ বিষয়ে এসি পেস্টিসাইডের সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার সুবীর চৌধুরী গতকাল রাতে বলেন, প্রায় ৪০ বছর ধরে এই বালাইনাশক ব্যবহার হয়ে আসছিল। কার্বোফুরান পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এখনো আছে। চীনে কৃষক পর্যায়ে ব্যবহার শেষ হচ্ছে চলতি বছরের ডিসেম্বরে। আমাদের গত অক্টোবরের পর থেকে আমদানি, উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করে সরকার। আমরা যেহেতু সরাসরি কৃষকদের কাছে এটা বিক্রি করি না। ডিলার বা পরিবেশকের মাধ্যমে এটার বিপণন করা হয়ে থাকে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই আমরা আমাদের পণ্য ডিলারদের কাছে পৌঁছে দিয়েছি। শুধু আমরা নই অন্য কোম্পানিও এটাই করেছে। ডিলাররা হয়তো বিক্রি করতে পারেনি। তাদের কাছে থেকে গেছে।

তিনি জানান, আমাদের দেশে কার্বোফুরান আমদানি, উৎপাদন ও ব্যবহার একই সাথে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আমার মনে হয় এতে প্রক্রিয়াগত গ্যাপ ছিল। যদি এমন হতো যে, অক্টোবর পর্যন্ত এটা কোম্পানি পর্যায়ে বিক্রি বন্ধ, কৃষক পর্যায়ে ব্যবহার বন্ধ ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত, সেটা হলে ভালো হতো।
সংশ্লিষ্টরা জানান, কার্বোফুরানের বিষাক্ততা মানব স্বাস্থ্য ও আবাদযোগ্য জমির উর্বরতা উভয়ের জন্য ক্ষতিকর উল্লেখ করে ২০১৬ সালে তা নিষিদ্ধের আহ্বান জানায় জাতিসঙ্ঘ। কার্বোফুরান নিষিদ্ধ করা ৮৮তম দেশ বাংলাদেশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি মানুষ হৃদরোগ ও স্ট্রোকে মারা যায় এবং এর পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ খাদ্যে বিষক্রিয়া। কীটতত্ত্ববিদ বলছেন, কার্বোফুরানের ব্যবহারে মাটির উর্বরতা কমে। কৃষিজমিতে কার্বোফুরান ব্যবহারের পর ৩০ দিন পর্যন্ত ফসল বিষাক্ত থাকে।
কীটনাশক কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির (পিটাক) তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত তিন হাজার ২৮৫ টন কার্বোফুরান মজুদ ছিল। যেসব কোম্পানির কাছে কার্বোফুরান আছে, তাদের গত ৩০ অক্টোবরের মধ্যে সব ধ্বংস করে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিল পিটাক। অন্যথায় কোম্পানিগুলোকে নিবন্ধন বাতিলসহ আইনি পদক্ষেপের মুখোমুখি হতে হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছিল।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের পরিচালক (উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং) ও পিটাক কমিটির সদস্যসচিব মো: আশরাফ উদ্দিন বলেন, যেখানেই নিষিদ্ধ কার্বোফুরান পাওয়া যাচ্ছে সেখানেই ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, আমাদের যে আইন (বালাইনাশক) আছে সেখানে মামলার ধারা উল্লেখ নাই। এ কারণে বিশেষ ক্ষমতা আইনে স্থানীয় প্রশাসন মামলা করেছে। পেস্টিসাইডের আইনে সরাসরি মোবাইল কোর্ট তফসিলভুক্ত না। তাই লোকাল প্রশাসন যা মনে করেছে সেভাবেই মামলা করেছে। মো: আশরাফ উদ্দিন বলেন, (কার্বোফুরান) কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে থাকলে সেটা আমাদের মধ্যে, কিন্তু যেখানে পাওয়া গেছে তা কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে ছিল না।


আরো সংবাদ



premium cement