১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

গাজায় যুদ্ধবিরতি ও দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানে গুরুত্বারোপ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর

-

- আলোচনায় বাধা সৃষ্টি করছেন নেতানিয়াহু : হামাস
- শরণার্থী শিবিরে হামলায় ৫ শিশু নিহত

গাজায় যুদ্ধবিরতি ও বিরাজমান সঙ্কটের দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন ব্রিটেনের নতুন প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার। ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের নেতাদের সাথে টেলিফোনে আলাপকালে এমন কথা বলেন তিনি। ইসরাইল অবশ্য ধ্বংসাত্মক এ যুদ্ধ থামাতে কোনো আগ্রহ দেখায়নি, যদিও এ পর্যন্ত ৩৮ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। কিয়ার স্টারমার ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে বলেন, ‘যুদ্ধবিরতি, বন্দীদের প্রত্যাবর্তন এবং গাজায় অবস্থানরত বেসামরিক নাগরিকদের মানবিক সহায়তার পরিমাণ অবিলম্বে বাড়ানো উচিত।’ আলজাজিরা ও ওয়াফা।
বিরোধীদলীয় নেতা থাকাকালে স্টারমারের বিরুদ্ধে গাজায় যুদ্ধবিরতির আহ্বান না জানানোর অভিযোগ আনা হয়েছিল। তিনি পার্লামেন্টে গাজায় যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবের বিরোধিতা করে জনসাধারণের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েন। এর কয়েক মাস পর ফেব্রুয়ারিতে গাজায় যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানান তিনি। এ ছাড়াও লেবার পার্টির সাবেক প্রধান জেরেমি করবিনসহ দলটির কিছু ফিলিস্তিনপন্থী সদস্যকে নির্বাচনে মনোনয়ন না দেয়ার অভিযোগ আনা হয়েছিল তার বিরুদ্ধে। জেরেমি করবিনসহ কমপক্ষে পাঁচজন স্বতন্ত্র ফিলিস্তিনপন্থী প্রার্থী ব্রিটেনের সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন।
গত অক্টোবরে এলবিসি পডকাস্টে গাজায় পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করার অধিকার ইসরাইলের রয়েছে বলে মন্তব্য করে স্টারমার ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছিলেন। পরে লেবার পার্টির একজন মুখপাত্র স্টারমারের ওই ব্যক্তব্যকে ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকার সম্পর্কিত একটি প্রশ্নের জবাব ছিল বলে ব্যাখ্যা করেন। ব্রিটিশ সরকারের বিবৃতিতে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী সঙ্কটের দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের জন্য দীর্ঘমেয়াদি শর্তগুলো পূরণ করতে এবং ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে কার্যকরভাবে পরিচালনায় আর্থিক সংস্থান নিশ্চিত করার আহ্বান জানান।

স্টারমার নেতানিয়াহুকে আশ্বস্ত করে বলেন, ইসরাইলের ক্ষতিকর হুমকি প্রতিরোধে সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে চায় ব্রিটেন। স্টারমারের সাথে ফোনালাপের পর নেতানিয়াহুর কার্যালয় থেকে কোনো বিবৃতি দেয়া হয়নি। স্টারমার ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সাথে ফোনালাপেও একই অগ্রাধিকারগুলো নিশ্চিতের আহ্বান জানান। ডাউনিং স্ট্রিটের একজন মুখপাত্র সাংবাদিকদের বলেন, ফিলিস্তিনের জন্য আন্তর্জাতিক বৈধতা নিশ্চিত করার বিষয়ে আলোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, শান্তি প্রক্রিয়ায় অবদান রাখায় তার দীর্ঘদিনের নীতি পরিবর্তিত হয়নি। এটি ফিলিস্তিনিদের অনস্বীকার্য অধিকার। বার্তা সংস্থা ওয়াফার তথ্যমতে, মাহমুদ আব্বাস ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিতে ব্রিটেনের প্রতি জোর আহ্বান জানান। ফিলিস্তিনকে ১৪০টিরও বেশি দেশ একটি সার্বভৌম দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। মে মাসের শেষের দিকে আয়ারল্যান্ড, স্পেন ও নরওয়ে সর্বশেষ ইউরোপীয় দেশ হিসেবে ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে। জাতিসঙ্ঘ ও বৈশ্বিক সহায়তা সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, ইসরাইলি সেনাবাহিনী গাজায় আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তা উল্লেখযোগ্যভাবে সীমিত করছে, এর ফলে শিশুদের মাঝে ব্যাপক অপুষ্টি দেখা দিচ্ছে।
নেতানিয়াহুর সাথে ফোনালাপের সময় স্টারমার ইসরাইল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে সীমান্ত উত্তেজনা নিয়েও আলোচনা করেছেন। কারণ, যেকোনো মুহূর্তে ইসরাইল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হতে পারে। স্টারমার বলেন, ইসরাইলের উত্তর সীমান্তের পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক ছিল এবং সব পক্ষ সতর্কতার সাথে কাজ করায় আপাতত যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব হচ্ছে। গাজায় চলমান সংঘাতে ৩৮ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যাদের বেশির ভাগই শিশু ও নারী। ৮৭ হাজারেরও বেশি মানুষ আহত হয়েছে এবং হাজার হাজার মানুষ নিখোঁজ রয়েছে।
আলোচনায় বাধা নেতানিয়াহু : ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকাজুড়ে ইসরাইলি হামলা যুদ্ধের অবসানে ক্রমবর্ধমান আলোচনায় কোনো সহায়তা করছে না বলে মন্তব্য করেছে হামাস। একই সাথে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে আলোচনায় বাধা সৃষ্টি করার জন্যও অভিযুক্ত করেছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র এই গোষ্ঠীটি। মঙ্গলবার এই তথ্য জানিয়েছে আলজাজিরা।

সোমবার এক বিবৃতিতে হামাস প্রধান ইসমাইল হানিয়া সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ‘গাজায় যা ঘটছে তার বিপর্যয়কর পরিণতি’ হিসেবে ‘আলোচনা প্রক্রিয়াকে আবার নতুন করে শুরু করার জায়গায় নিয়ে যেতে পারে’। গাজায় ফিলিস্তিনের সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে হামাস বলেছে, নেতানিয়াহু এবং তার সেনাবাহিনী ‘এই পথের পতনের সম্পূর্ণ দায়ভার বহন করবে’।
বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে, ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর সম্প্রসারণমূলক কর্মকাণ্ডের বিষয়ে মধ্যস্থতাকারী কাতার এবং মিসরের সাথে ‘জরুরি যোগাযোগ’ করেছেন ইসমাইল হানিয়া। ইসরাইলি বাহিনী গাজা শহরের আশপাশের এলাকাগুলোর বাসিন্দাদের আবারো উচ্ছেদের আদেশ জারি করেছে। এর ফলে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হচ্ছেন, যাদের মধ্যে অনেককে আবার একাধিকবার এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সরে যেতে বাধ্য করা হয়েছে।
গত রোববার ইসরাইলের সামরিক বাহিনী গাজা শহরের তুফাহ, দারাজ এবং ওল্ড সিটির পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলো থেকে বাসিন্দাদের ‘তাৎক্ষণিকভাবে’ সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। পৃথক বিবৃতিতে নেতানিয়াহুকে ‘আমাদের (ফিলিস্তিনি) জনগণের বিরুদ্ধে আগ্রাসন এবং অপরাধ বৃদ্ধি’ করার জন্য অভিযুক্ত করেছে হামাস। তারা বলেছে, ‘চুক্তিতে পৌঁছানোর সব প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করার জন্য ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করার এই প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে’।
মধ্য গাজার দেইর আল-বালাহ থেকে আলজাজিরার হিন্দ খৌদারি বলেছেন, ফিলিস্তিনিদের গাজা উপত্যকার কেন্দ্রস্থলে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে যদিও এলাকাটি ইতোমধ্যেই সমগ্র গাজা ভূখণ্ড থেকে আশ্রয় নেয়া বিপুলসংখ্যক বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিতে পরিপূর্ণ। ইসরাইলি আগ্রাসনের কারণে গাজার ২৩ লাখ ফিলিস্তিনির বেশিরভাগই বাস্তুচ্যুত হয়েছেন, তাদের মধ্যে লাখ লাখ ফিলিস্তিনি আবার তাঁবুতে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন।

হিন্দ খৌদারি বলেছেন, তিনি এমন অনেক ফিলিস্তিনির সাথে কথা বলেছেন যারা ইসরাইলি নির্দেশের পরও অন্য কোথাও সরে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, কারণ গাজায় এখন আর ‘যাওয়ার জন্য নিরাপদ কোনো জায়গা’ নেই। তিনি বলেন, তারা ‘অস্থায়ী শিবিরে বাস্তুচ্যুত হয়ে নিজেদের মর্যাদা হারাতে চায় না এবং সেখানে খাবার এবং পানির সরবরাহও থাকে না।’ ইসরাইলি বাহিনী অবশ্য ইতোমধ্যেই বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের আবাসন হিসেবে ব্যবহৃত তাঁবুতেও হামলা চালিয়েছে।
শরণার্থী শিবিরে হামলা : এদিকে গতকাল মঙ্গলবার গাজার বুরেজ শরণার্থী শিবিরে ইসরাইলি হামলায় অন্তত ৯ জন নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে পাঁচ শিশুও রয়েছে, যারা রাস্তায় খেলছিল। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সোমবার জানিয়েছে, গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে ইসরাইল কমপক্ষে ৩৮ হাজার ২৪৩ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। এছাড়া হামলায় আরো আহত হয়েছেন প্রায় ৮৮ হাজার মানুষ। মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, শেষ ২৪ ঘণ্টায় আরো ৫০ জন ফিলিস্তিনি ইসরাইলি হামলায় নিহত হয়েছেন আর আহত হয়েছেন ১৩০ জন।

 


আরো সংবাদ



premium cement