১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

যুদ্ধবিরতি ও বন্দিবিনিময় চুক্তির দ্বারপ্রান্তে ইসরাইল-হামাস

-

- নিহত আরো ২৮ ফিলিস্তিনি প্রাণহানি ৩৮ হাজার ছুঁই ছুঁই
- গাজায় প্রতি ১০ জনে ৯ জনই বাস্তুচ্যুত : জাতিসঙ্ঘ
- হামাসের প্রস্তাব যাচাই করছে ইসরাইল

গাজায় যুদ্ধবিরতি ও ইসরাইলি ও ফিলিস্তিনি বন্দিবিনিময়ের লক্ষ্যে একটি ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তির দ্বারপ্রান্তে উপনিত হয়েছে হামাস ও তেল আবিব। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি ইসরাইলি সূত্র বিষয়টি জানিয়েছে। ইসরাইলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্তও ফিলিস্তিনি পক্ষের সাথে বন্দিবিনিয়মের খুব কাছাকাছি অবস্থান করছে তার দেশ।
মার্কিন সম্প্রচারমাধ্যম সিএনএন নিউজের খবরে বলা হয়েছে, সূত্রটি জানিয়েছে- ইসরাইলি কর্মকর্তারা বিশ্বাস করেন, হামাসের যুদ্ধবিরতি ও বন্দিবিনিময়ের লক্ষ্যে সর্বশেষ যে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে তা দুই পক্ষকে একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর লক্ষ্যে বিশদ আলোচনায় যেতে সাহায্য করবে।
তবে চুক্তির বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত হয়নি বা কোনো পক্ষ এটি নিশ্চিত করেনি। চুক্তিটি বাস্তবায়িত হওয়ার আগে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে আলোচনার পরবর্তী পর্বে প্রবেশের সবুজ সঙ্কেত দিতে হবে। হামাসের হাতে বন্দী ইসরাইলি বন্দীদের বিনিময়ে ফিলিস্তিনি বন্দীদের মুক্তিসহ একটি সম্ভাব্য চুক্তির বিশদ আলোচনার জন্য সম্ভবত কয়েক সপ্তাহ সময় লাগবে।
ইসরাইলি আলোচকরা বিস্তারিত আলোচনার এই পর্যায়ে যুক্ত হবেন কি না সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আগামী দিনে নেতানিয়াহুসহ ইসরাইলের রাজনৈতিক নেতৃত্ব আলোচনায় বসবেন। তবে হামাস নিশ্চিত করেছে যে, তারা মধ্যস্থতাকারী কাতার ও মিসরের কাছে ইসরাইলি যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।
হামাসের পলিটব্যুরোর সদস্য বাসেম নাইম বুধবার সিএনএনকে বলেছেন, ‘আমরা কিছু দাবি পেশ করেছি যা সম্পূর্ণ যুদ্ধবিরতি ও গাজা থেকে ইসরাইলি বাহিনী প্রত্যাহারের বিষয়টি নিশ্চিত করবে।’ হামাস বুধবার এক পৃথক বিবৃতিতে বলেছে, ‘আমরা আমাদের ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে আগ্রাসন বন্ধের লক্ষ্যে মধ্যস্থতাকারীদের সাথে কিছু চিন্তাভাবনা শেয়ার করেছি।’
পরে আরেক বিবৃতিতে হামাস জানিয়েছে, তারা ইসরাইলি প্রস্তাবকে ‘ইতিবাচকভাবে’ বিবেচনা করছে। বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে, হামাসের রাজনৈতিক শাখার প্রধান ইসমাইল হানিয়া ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাতার ও মিসরের মধ্যস্থতাকারীদের আলোচনা করেছেন, যাতে গাজায় যুদ্ধের অবসান ঘটাতে একটি চুক্তিতে পৌঁছানো সম্ভব হয়। এতে আরো বলা হয়, হামাস-প্রধান তুরস্কের কর্মকর্তাদের সাথেও আলোচনা করেছেন।
ইসরাইলের তরফ থেকে যুদ্ধবিরতি আলোচনায় অংশ নেয়া দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ বুধবার নিশ্চিত করেছে যে, মিসরীয় ও কাতারি মধ্যস্থতাকারীরা ইসরাইলের কাছে হামাসের সর্বশেষ প্রতিক্রিয়া জমা দিয়েছে। বিবৃতিতে মোসাদ বলেছে, ‘চুক্তির মধ্যস্থতাকারীদের আলোচনাকারী দল হামাস উত্থাপিত চুক্তির রূপরেখা ইসরাইলকে অবহিত করেছে। ইসরাইল এটি মূল্যায়ন করছে এবং মধ্যস্থতাকারীদের কাছে জবাব দেবে।’
এ দিকে তুরস্কের রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদ সংস্থা আনাদোলু এজেন্সির খবরে বলা হয়েছে- ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ত বৃহস্পতিবার বলেছেন, ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের সাথে বন্দিবিনিময় চুক্তিতে পৌঁছানোর লক্ষ্যে ‘অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি’ কাছাকাছি অবস্থানে আছে। ইসরাইলি সেনাবাহিনীর সম্প্রচারমাধ্যম কেএএন পর্যালোচনা করার জন্য একটি অধিবেশনে বসবে।
বাস্তুচ্যুত ১৯ লাখ ফিলিস্তিনি
এ দিকে ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ ও যুদ্ধবিধ্বস্ত ভূখণ্ড গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনে অঞ্চলটির ৯০ শতাংশ মানুষই বাস্তুচ্যুত হয়েছে। সেই হিসাবে প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯ জনই নিজ নিজ বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ হয়েছে। জাতিসঙ্ঘের মানবিক সহায়তা সংস্থার রিপোর্ট থেকে এ তথ্য জানা গেছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের রিপোর্টে এ তথ্য উঠে এসেছে।
জাতিসঙ্ঘের মানবিক সহায়তা সংস্থা ইউএন অফিস ফর কো-অর্ডিনেশন অব হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাফেয়ার্সের ফিলিস্তিন অঞ্চলের প্রধান আন্দ্রেয়া দে দোমিনিকো বুধবার জানিয়েছেন, গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনের কারণে অন্তত ১৯ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। আন্দ্রেয়া দে দোমিনিকো বলেন, ‘আমাদের অনুমান, গাজা উপত্যকায় গত বছরের অক্টোবর থেকে প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯ জনই অভ্যন্তরীণভাবে অন্তত একবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে।’ তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, অনেকে হয়তো এই সময়ের মধ্যে ১০ বারের বেশি বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
জাতিসঙ্ঘের এই কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘আগে আমাদের অনুমান ছিল ১৭ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে; কিন্তু আমরা রাফায় (ইসরাইলি অভিযান) অপারেশন দেখেছি, যার কারণে অতিরিক্ত মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘এরপর আবারো আমরা উত্তরাঞ্চলে (ইসরাইলি) অভিযান দেখেছি, যার ফলে আবারো কিছু মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।’
আন্দ্রেয়া দে দোমিনিকো জানান, এ ধরনের সামরিক অভিযান স্থানীয়দের বারবার নিজ আশ্রয় ছেড়ে যেতে বাধ্য করছে। তিনি বলেন, ‘বাস্তুচ্যুতদের এই সংখ্যার পেছনে এমন সব মানুষ আছে যারা ভীত, যাদের অভিযোগ আছে জীবন নিয়ে এবং তাদের সম্ভবত স্বপ্ন ও আশা ছিল। দুর্ভাগ্যবশত, আমি আজ ভয় পাই যে, তাদের সেসব আশা ও স্বপ্ন ভেঙে গেছে। গত ৯ মাস ধরে তারা দাবার বোর্ডের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে।’
নিহত আরো ২৮ ফিলিস্তিনি, প্রাণহানি ৩৮ হাজার ছুঁই ছুঁই
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা ভূখণ্ডে ইসরাইলি বর্বর হামলায় আরো ২৮ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এতে করে উপত্যকাটিতে নিহতের মোট সংখ্যা পৌঁছেছে প্রায় ৩৮ হাজারে। এ ছাড়া গত বছরের অক্টোবর থেকে চলা এই হামলায় আহত হয়েছেন আরো ৮৭ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি। এই তথ্য জানিয়েছে তুর্কি বার্তা সংস্থা আনাদোলু।
খবরে বলা হয়েছে, গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের চলমান হামলায় আরো ২৮ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এতে করে গত বছরের অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত মোট মৃতের সংখ্যা ৩৭ হাজার ৯৫৩ জনে পৌঁছেছে বলে বুধবার অবরুদ্ধ এই ভূখণ্ডের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, নিরলস এই হামলায় আরো অন্তত ৮৭ হাজার ২৬৬ জন ব্যক্তিও আহত হয়েছেন।
মন্ত্রণালয় বলেছে, শেষ ২৪ ঘণ্টায় তিনটি পরিবারের বিরুদ্ধে ইসরাইলি ‘হত্যাকাণ্ডে’ ২৮ জন নিহত এবং আরো ১২৫ জন আহত হয়েছেন। অনেক মানুষ এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে এবং রাস্তায় আটকা পড়ে আছেন কারণ উদ্ধারকারীরা তাদের কাছে পৌঁছাতে পারছেন না। গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির দাবি জানিয়ে জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব সত্ত্বেও ইসরাইল অবরুদ্ধ এই ভূখণ্ডে তার নৃশংস আক্রমণ অব্যাহত রেখেছে।
উল্লেখ্য, গত ৭ অক্টোবর থেকে ইসরাইল গাজা উপত্যকায় অবিরাম বিমান ও স্থল হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। ইসরাইলি এই হামলায় হাসপাতাল, স্কুল, শরণার্থী শিবির, মসজিদ, গির্জাসহ হাজার হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে। এ ছাড়া ইসরাইলি আগ্রাসনের কারণে প্রায় ২০ লাখেরও বেশি বাসিন্দা তাদের বাড়িঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।
ইসরাইলি আগ্রাসন গাজাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। জাতিসঙ্ঘের মতে, ইসরাইলের বর্বর আক্রমণের কারণে গাজার প্রায় ৮৫ শতাংশ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। আর খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি এবং ওষুধের তীব্র সঙ্কটের মধ্যে গাজার সবাই এখন খাদ্য নিরাপত্তাহীন অবস্থার মধ্যে রয়েছেন। এ ছাড়া অবরুদ্ধ এই ভূখণ্ডের ৬০ শতাংশ অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে। ইসরাইল ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement