০৬ জুলাই ২০২৪, ২২ আষাঢ় ১৪৩১, ২৯ জিলহজ ১৪৪৫
`

গাজার সেফ জোনে বিমান হামলা ১২ ফিলিস্তিনি নিহত

-

- নেতানিয়াহুকে উপেক্ষা করে যুদ্ধবিরতি চান ইসরাইলি জেনারেলরা
- বাইডেনের গাজানীতির প্রতিবাদে আরেক মার্কিন কর্মকর্তার পদত্যাগ
- গাজায় হামলা বন্ধ হলে থামবে হিজবুল্লাহ

গাজার দক্ষিণের শহর খান ইউনুস ও রাফাহ ছেড়ে ‘সেফ জোনে’ গিয়েও শেষরক্ষা হলো না। কথিত ‘নিরাপদ’ অঞ্চলেও বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। এতে গতকাল বুধবার ভোরে প্রাণ গেছে শিশুসহ ১২ ফিলিস্তিনির। জীবন বাঁচাতে পালাতে থাকা এসব মানুষের ওপরও বিমান হামলা চালাচ্ছে ইসরাইল। নিরীহ ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলের হামলা সত্ত্বেও অব্যাহত মার্কিন সমর্থনের প্রতিবাদে পদত্যাগ করেছেন আরেক মার্কিন কর্মকর্তা। এ দিকে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে উপেক্ষা করে গাজায় যুদ্ধবিরতি চান ইসরাইলি জেনারেলরা। অন্য দিকে গাজায় হামলা বন্ধ হলে ইসরাইলে হামলা থামানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে লেবাননের রাজনৈতিক সংগঠন হিজবুল্লাহ। আল জাজিরা, রয়টার্স ও এএফপি ।
ইসরাইলি সামরিক কর্তৃপক্ষ স্থল অভিযান শুরুর আগে গত সোমবার গাজার খান ইউনুস ও রাফাহ শহর ছাড়তে নির্দেশ দেয় শহর দু’টিতে আশ্রয় নেয়া ফিলিস্তিনিদের। নির্দেশনা অনুযায়ী গত দুই দিনে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে যেতে বাধ্য হয়েছে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি। তবে জীবন বাঁচাতে পালাতে থাকা এসব মানুষের ওপরও বিমান হামলা চালাচ্ছে ইসরাইল। একটি সূত্র জানিয়েছে, খান ইউনুস শহরের পূর্বাঞ্চল থেকে ‘নিরাপদ অঞ্চলে’ যাওয়া মানুষজনের ওপর বিমান হামলা চালানো হয়েছে। ইসরাইলি বিমান হামলায় গতকাল বুধবার ভোরে ১২ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যার মধ্যে একটি পরিবারের নয়জন সদস্য রয়েছে। ইসরাইলের স্থল অভিযানের আশঙ্কায় খান ইউনুসের ইউরোপীয় হাসপাতাল থেকে শত শত অসুস্থ ও আহত মানুষ পালিয়ে গেছে। স্থল আক্রমণের হাত থেকে হাসপাতালটিকে রক্ষা করার জন্য অনুরোধ করেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধি রিক পিপারকর্ন। জাতিসঙ্ঘ অনুমান করছে, খান ইউনুস ও রাফাহ থেকে দুই দিনে অন্তত আড়াই লাখ মানুষ ইসরাইলের খালি করে দেয়ার নির্দেশের পর বাড়িঘর ছেড়েছে। এ নিয়ে গাজায় মোট বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ১৯ লাখে পৌঁছেছে।

যুদ্ধবিরতি চান ইসরাইলি জেনারেলরা
প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে উপেক্ষা করে গাজায় যুদ্ধবিরতি চান ইসরাইলি জেনারেলরা। হামাসের হাতে থাকা বাকি বন্দীদের মুক্ত করার জন্য এই যুদ্ধবিরতি জরুরি বলে মনে কারেন এসব জেনারেল। এ ছাড়া লেবাননের হিজবুল্লøাহকে দমনের ক্ষেত্রেও গাজায় যুদ্ধবিরতি প্রয়োজন বলেন মনে করেন তারা। মঙ্গলবার প্রকাশিত মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক বিশেষ খবর থেকে এ তথ্য জানা গেছে। ইসরাইলের সাবেক ও বর্তমান ছয় সেনা কর্মকর্তার সাথে কথা বলে এই তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যমটি। এই ছয় সেনা কর্মকর্তা মনে করেন, হামাসের হাতে থাকা আরো প্রায় ১২০ জিম্মিকে দ্রুত উদ্ধারে যুদ্ধবিরতি জরুরি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এসব সেনা কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ইসরাইলি সেনাবাহিনীর শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা মনে করেন, তাদের বাহিনী, এখন বিগত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘতম যুদ্ধের জন্য সুসজ্জিত নয়। তারা বলছেন, হিজবুল্লøাহর সাথে পূর্ণ মাত্রার যুদ্ধ শুরু হলে বাহিনীকে পুনরায় সজ্জিত করার জন্য সময় প্রয়োজন। তারা জানিয়েছেন, সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হেরজি হালেভিসহ প্রায় ৩০ জন জ্যেষ্ঠ জেনারেলের সমন্বয়ে গঠিত ইসরাইলের শীর্ষ সামরিক নীতিনির্ধারণী সংস্থা জেনারেল স্টাফ ফোরাম গাজায় একটি অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি হিজবুল্লাহর সাথে উত্তেজনা কমাতে পারে বলে মতৈক্যে পৌঁছেছে।
বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরেই একটি গুজব ভেসে বেড়াচ্ছে যে, এমনটা না হলে জেনারেল হালেভি পদত্যাগ করতে পারেন। অবশ্য এ বিষয়ে নিশ্চিত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে ইসরাইলের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ইয়াল হুলাতা বলেছেন, ‘সেনাবাহিনী বন্দিচুক্তি ও যুদ্ধবিরতিকে পূর্ণ সমর্থন করছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘গাজায় যুদ্ধবিরতি লেবাননে উত্তেজনা হ্রাসের সম্ভাবনা বাড়াবে এবং হিজবুল্লাহর সাথে একটি সম্ভাব্য বৃহত্তর সঙ্ঘাতের ক্ষেত্রে (ইসরাইলকে) প্রস্তুত হওয়ার পর্যাপ্ত সময় দেবে।’

গাজায় যুদ্ধ পরিচালনা সংক্রান্ত কৌশলে সশস্ত্রবাহিনীর পরিবর্তন ও নেতানিয়াহু সরকারের সুনির্দিষ্ট ‘গাজা পরিকল্পনার রূপরেখা’ না থাকার কারণে সমরবিদদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। সরকারি দিকনির্দেশনার অভাবে গাজায় একটি ‘পাওয়ার ভ্যাকুয়াম’ বা শক্তির শূন্যতা তৈরি হয়েছে। এর ফলে, ইসরাইলি বাহিনী হামাস যোদ্ধাদের একটি এলাকা থেকে সরিয়ে দিলেও শিগগিরই সেই এলাকা আবার দখল হয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থায় সমরনেতারা প্রকাশ্যে তাদের ব্যক্তিগত অসন্তোষ তুলে ধরছেন। নেতানিয়াহু হামাসকে নির্মূল করা এবং বন্দীদের মুক্তি নিশ্চিত করাসহ যুদ্ধের সব লক্ষ্য অর্জনে তার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকসহ বিশেষজ্ঞেরা এসব লক্ষ্য অর্জনকে সুদূর পরাহত বলে আখ্যা দিয়েছেন। গাজা আগ্রাসনের ৯ মাস পর, ইসরাইলি জেনারেলরা উপসংহারে পৌঁছেছেন যে, বন্দীদের মুক্ত করার জন্য অব্যাহত সামরিক অভিযান তাদের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। তারা আরো মনে করছেন, গাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো সুস্পষ্ট পরিকল্পনা না থাকায় দীর্ঘস্থায়ী সঙ্ঘাত হামাসকে অক্ষতই রাখবে এবং বিপরীতে ইসরাইলি বাহিনীর সম্পদ ও মনোবল নষ্ট হবে। ইসরাইলি সামরিক বাহিনী জনসাধারণের জন্য যেসব বিবৃতি দিচ্ছে, সেখানে সরাসরি যুদ্ধবিরতিকে সমর্থন না করা হচ্ছে না। তবে এই বিষয়টি নেতিবাচক হতে পারে বলে মনে করেন ইসরাইলি সশস্ত্রবাহিনীর মুখপাত্র অ্যাডমিরাল ড্যানিয়েল হ্যাগারি। তিনি ইঙ্গিত করেছেন, বর্তমান কৌশল জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করছে।

আরেক মার্কিন কর্মকর্তার পদত্যাগ
গাজা ভূখণ্ডে আগ্রাসনে সরাসরি ইসরাইলের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। একই সাথে গাজায় ইসরাইলি গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের বিষয়েও দেশটি নীরব। এই পরিস্থিতিতে পদত্যাগ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের আরো একজন কর্মকর্তা। পদত্যাগের পর প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের পররাষ্ট্রনীতির কঠোর সমালোচনাও করেছেন তিনি। গাজায় প্রায় ৯ মাস ধরে চলা যুদ্ধের সময় ইসরাইলের প্রতি প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের অব্যাহত সমর্থনের প্রতিবাদে এখন পর্যন্ত অন্তত নয়জন মার্কিন কর্মকর্তা পদত্যাগ করেছেন। পদত্যাগকারী এসব কর্মকর্তার কেউ কেউ আবার মার্কিন প্রেসিডেন্টকে ফিলিস্তিনের গাজা ভূখণ্ডে ইসরাইলি নৃশংসতার বিষয়ে চোখ বন্ধ রাখার মতো অভিযোগও করেছেন। তবে বাইডেন প্রশাসন এটি অস্বীকার করেছে। সর্বশেষ পদত্যাগকারী মার্কিন ওই কর্মকর্তার নাম মরিয়ম হাসনাইন। তিনি মার্কিন স্বরাষ্ট্র বিভাগের বিশেষ সহকারী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বাইডেনের গাজানীতির প্রতিবাদে মঙ্গলবার চাকরি ছেড়ে দেন তিনি। পরে তিনি প্রেসিডেন্ট বাইডেনের পররাষ্ট্রনীতির কঠোর নিন্দা করেন। এমনকি বাইডেনের এই নীতিকে ‘গণহত্যা-সক্ষমকারী’ এবং আরব ও মুসলমানদের জন্য অমানবিক হিসেবে বর্ণনা করেন মরিয়ম। আর ইসরাইলের প্রতি ওয়াশিংটনের অব্যাহত সমর্থন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি সরকারি সংস্থাজুড়ে একের পর এক কর্মকর্তার পদত্যাগের ঘটনা ঘটেছে এবং এর মধ্যে সর্বশেষ পদত্যাগ করলেন মরিয়ম হাসনাইন।

গাজায় হামলা বন্ধ হলে থামবে হিজবুল্লাহ
ইসরাইলে হামলা থামানোর জন্য মাত্র একটি শর্ত দিয়েছে লেবাননের হিজবুল্লাহ। সেই শর্তটি হলো- ইসরাইলের প্রতিরক্ষাবাহিনীকে অবশ্যই গাজায় সামরিক অভিযান বন্ধ করতে হবে। হিজবুল্লাহর অন্যতম শীর্ষনেতা ও সাংগঠনিক উপ-প্রধান শেখ নাঈম কাসেম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। মঙ্গলবার মার্কিন সংবাদমাধ্যম অ্যাসোসিটেটেড প্রেসকে (এপি) দেয়া এক সাক্ষাৎকারে শেখ নাঈম কাসেম বলেন, ‘হামাসের মিত্র হিসেবে আমরা এখন থেকে (ইসরাইলে) হামলা চালাচ্ছি। গাজায় যদি যুদ্ধবিরতি হয়, অর্থাৎ ইসরাইলি বাহিনী যদি সেখানে অভিযান বন্ধ করে, আমরা সাথে সাথে হামলা বন্ধ করে দেবো। আমাদের আর কোনো শর্ত নেই।’ গাজায় ইসরাইলি বাহিনীর আগ্রাসন শুরুর এক মাস পর থেকে ইসরাইল-লেবানন সীমান্ত থেকে ইসরাইলের বিভিন্ন সামরিক-বেসামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র ও রকেট হামলা শুরু করে হিজবল্লাহ। সেই হামলার জবাব দেয়া শুরু করে আইডিএফও। হিজবুল্লাহ ও আইডিএফের পাল্টাপাল্টি এই হামলায় গত সাত মাসে লেবাননে নিহত হয়েছেন ৪৮১ জন। তাদের মধ্যে বেসামরিকদের সংখ্যা ৯৪ জন। অন্য দিকে লেবাননের হামলায় ইসরাইলে নিহত হয়েছেন অন্তত ১৫ জন সেনা এবং ১১ জন বেসামরিক।

হাইফায় হামলার দাবি হাউছিদের
ইসরাইলের হাইফায় ‘গুরুত্বপূর্ণ’ লক্ষ্যবস্তুতে হামলার দাবি করেছে ইয়েমেনের হাউছি বিদ্রোহীরা। মঙ্গলবার তারা দাবি করেছে, ইরাকের প্রতিরোধ গোষ্ঠীর সাথে যৌথভাবে এই হামলা চালানো হয়েছে। হাউছিদের সামরিক মুখপাত্র ইয়াহিয়া সারি টেলিভিশনে প্রচারিত এক বিবৃতিতে বলেছেন, একাধিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে এই সামরিক অভিযান চালানো হয়েছে। তবে কোন লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করা হয়েছে সেটি প্রকাশ করেননি তিনি। গাজার ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানিয়ে লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক ও সামরিক জাহাজে নিয়মিত হামলা করে আসছে হাউছিরা। নভেম্বর থেকে লোহিত সাগরের গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথে অসংখ্য ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে হাউছিরা। তাদের হামলায় দু’টি নৌযান ডুবেছে, অপর একটি তারা জব্দ করেছে। এ ছাড়া অন্তত তিনজন ক্রু নিহত হয়েছেন।

 


আরো সংবাদ



premium cement