স্থবির যুদ্ধবিরতি আলোচনা গাজার উত্তর ও দক্ষিণে যুদ্ধ তীব্রতর
- নয়া দিগন্ত ডেস্ক
- ০১ জুলাই ২০২৪, ০১:২০
- যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাবিত ও নিরাপত্তা পরিষদ সমর্থিত যুদ্ধবিরতি আলোচনা ব্যর্থ
- শুজাইয়া ও রাফায় ইসরাইলি নির্বিচার হামলা অব্যাহত
- হামাসের হাত থেকে বন্দীদের মুক্ত করতে লাখো ইসরাইলির বিক্ষোভ
ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড গাজায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে কোনো অগ্রগতি নেই বলে জানিয়েছে ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস। এদিকে ইসরাইলি সেনাবাহিনী অবরুদ্ধ উপত্যকার উত্তরাঞ্চলীয় শুজাইয়া এলাকা ও দক্ষিণাঞ্চলীয় রাফাহ শহরের পশ্চিম ও মধ্যাঞ্চলে নৃশংস হামলা অব্যাহত রেখেছে এবং তারা ট্যাংক নিয়ে আরো অগ্রসর হয়েছে। অন্যদিকে হামাসের হাতে বন্দী ইসরাইলিদের ফিরিয়ে আনতে হাজারো মানুষ বিক্ষোভ করেছে তেলআবিবের রাস্তায়। আলজাজিরা ও রয়টার্স।
আল জাজিরার খবরে বলা হয়েছে, লেবাননে অবস্থানরত হামাসের অন্যতম সিনিয়র নেতা ওসমান হামাদান জানিয়েছেন, হামাস এখনো ইসরাইলের সাথে যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা করতে প্রস্তুত, যাতে প্রায় ৯ মাস ধরে চলা যুদ্ধ শেষ হয়। হামাস নেতা ওসমান হামাদান লেবাননের রাজধানী বৈরুতে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আবারো বলছি যে, একটি স্থায়ী যুদ্ধবিরতি, গাজা উপত্যকা থেকে (ইসরাইলি বাহিনীর) প্রত্যাহার এবং একটি কার্যকর বন্দিবিনিময় চুক্তি নিশ্চিত করে এমন যেকোনো (যুদ্ধবিরতি) প্রস্তাব হামাস ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করতে প্রস্তুত।’
তবে যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাবিত ও জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদ সমর্থিত যুদ্ধবিরতি আলোচনা ব্যর্থ হয়ে গেছে। হামাস ও ইসরাইল উভয় পক্ষের অনড় অবস্থান এবং ছাড়া না দেয়ার জন্য পরস্পরকে দোষারোপের কারণে এই আলোচনা ব্যর্থ হয়ে গেছে। হামাস চায় গাজা ইসরাইলি সেনাদের পুরোপুরি প্রত্যাহার ও স্থায়ী যুদ্ধবিরতি।
বিপরীতে ইসরাইলের দাবি একটি অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি। যার পর আবারো আগ্রাসন চালিয়ে হামাসকে নির্মূল করার কাজ চালিয়ে যেতে চায় দেশটি। এই অবস্থায় হামাসের নেতারা বলছেন, যুদ্ধবিরতি নিয়ে অচলাবস্থার জন্য দায়ী ইসরাইলই। ওসমান হামাদান এ সময় যুদ্ধবিরতির শর্ত মানাতে যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে চাপ দেয়নি বলেও অভিযোগ করেন।
জানা গেছে, গাজা যুদ্ধবিরতি ও বন্দীমুক্তি চুক্তি নিয়ে মাসব্যাপী অনিয়মিত আলোচনায় সামান্য অগ্রগতি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গত মাসের শেষের দিকে ছয় সপ্তাহের যুদ্ধবিরতির রূপরেখা দিয়েছিলেন, যেখানে ইসরাইলে বন্দী ফিলিস্তিনি ও কিছু ইসরাইলি বন্দিবিনিময়ের কথা রয়েছে। মার্কিন গণমাধ্যম অ্যাক্সিওস জানিয়েছে, ওয়াশিংটন গত সপ্তাহে প্রস্তাবিত চুক্তির অংশগুলোর জন্য ‘সংশোধনী’ উপস্থাপন করেছে। তবে লেবাননে হামাসের কর্মকর্তা ওসামা হামদান নিশ্চিত করেছেন, ইসলামি আন্দোলন সর্বশেষ প্রস্তাব পেয়ে বলেছে, এটি ‘আগ্রাসন বন্ধের জন্য আলোচনায় কোনো বাস্তব অগ্রগতি’ উপস্থাপন করেনি। হামদান এই প্রস্তাবগুলোকে ‘সময়ের অপচয়’ বলে আখ্যা দিয়েছেন, যার উদ্দেশ্য ‘গণহত্যা অনুশীলনের জন্য দখলদারদের (ইসরাইল) অতিরিক্ত সময় দেয়া’।
এদিকে গাজা সিটির শুজাইয়া জেলায় গতকাল রোববার চতুর্থ দিনের মতো গোলা ও বোমাবর্ষণ করেছে ইসরাইলি বাহিনী। ধ্বংসপ্রাপ্ত এলাকাটি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি। ইসরাইলি সেনাবাহিনী দাবি করেছে, তারা হামাস ও ইসলামিক জিহাদের যোদ্ধাদের সাথে ‘মাটির ওপরে ও নিচে’ সুড়ঙ্গগুলোতে লড়াই করছে। কয়েক মাস আগে ইসরাইলি সেনাবাহিনী গাজার উত্তরাঞ্চলে হামাসের কমান্ড কাঠামো ধ্বংসের ঘোষণা করেছিল।
এ ছাড়াও তারা মধ্য গাজা ও দক্ষিণ রাফা এলাকায় হামলার কথা জানিয়েছে। রাফাতে একটি বাড়ি লক্ষ করে ভোরে বিমান হামলায় আরো ছয়জন নিহত হয়েছে বলে নাসের হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, রাফা শহরের দক্ষিণেও কামানের গোলাবর্ষণ করেছে ইসরাইলি বাহিনী। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু একসপ্তাহ আগে ঘোষণা করেছিলেন, ৭ অক্টোবর থেকে চলমান যুদ্ধের ‘তীব্র পর্যায়’ শেষ হওয়ার পথে রয়েছে। তার ঘোষণার পরই নতুন করে এই হামলা শুরু হয়। জাতিসঙ্ঘের মানবিক সংস্থা ওসিএইচএর অনুমান, বৃহস্পতিবার নতুন যুদ্ধ শুরু এবং সেনাবাহিনী মানুষকে সরে যাওয়ার আদেশ জারির পর থেকে শুজাইয়ার ‘৬০ থেকে ৮০ হাজার বাসিন্দা বাস্তুচ্যুত হয়েছে’।
হামাসের সামরিক শাখা ও তাদের মিত্র ইসলামিক জিহাদ শুজাইয়া ও রাফাহতে তুমুল লড়াইয়ের কথা জানিয়েছে। তারা বলেছে, তাদের যোদ্ধারা ইসরাইলি সেনাবাহিনীকে লক্ষ করে ট্যাংকবিধ্বংসী রকেট ও মর্টার নিক্ষেপ করেছে। গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসন শুরু হওয়ার আট মাস পরও ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা ইসরাইলি সেনাদের লক্ষ্য করে হামলা অব্যাহত রেখেছে। কয়েক মাস ইসরাইলি সেনাবাহিনী যেসব এলাকায় নিয়ন্ত্রণ নেয়ার দাবি করেছিল সেসব এলাকায় সক্রিয় রয়েছে হামাস যোদ্ধারা।
অন্যদিকে, গাজায় হামাসের হাতে বন্দী ইসরাইলিদের ফিরিয়ে আনতে তেলআবিবের রাস্তায় বিক্ষোভ করেছে লাখো মানুষ। শনিবার রাতে তেলআবিবের রাস্তায় প্রায় এক লাখ ৩০ হাজার মানুষ বিক্ষোভ করেছেন। এ সময় তারা যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাবিত যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব মেনে বন্দীদের ফিরিয়ে আনার দাবি জানান।
উল্লেখ্য, গাজায় প্রায় ৯ মাস ধরে চলা ইসরাইলি আগ্রাসনে এখন পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ৩৭ হাজার ৭১৮ ফিলিস্তিনি। নিহতদের মধ্যে ১৫ হাজারের বেশি শিশু। এই সময়ে আহত হয়েছে আরো ৮৬ হাজার ৩৭৭ জন। এ ছাড়া নিখোঁজ আছে আরো ১০ হাজারের বেশি। এর বাইরে, গত ৭ অক্টোবরের পর থেকে অপর ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড পশ্চিম তীরে ইসরাইলি বাহিনীর হামলায় এখন পর্যন্ত ৫৫৩ জন নিহত হয়েছে। নিহতদের মধ্যে ১৩৭ জনই শিশু। একই সময়ে আহত হয়েছে আরো ৫ হাজার ২০০ জনের বেশি।
তা ছাড়া গাজায় সংঘর্ষের কারণে লেবাননের সাথে ইসরাইলের উত্তর সীমান্তেও উত্তেজনা বেড়েছে। সেখানে ইসরাইলি সেনাবাহিনী অক্টোবর থেকে হিজবুল্লাহ আন্দোলনের সাথে আন্তঃসীমান্ত সংঘর্ষে জড়াচ্ছে। হিজবুল্লাহ ইসরাইল ও তার পশ্চিমা মিত্রদের বিরুদ্ধে ইরানসমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর ‘প্রতিরোধ জোটের’ অংশ। এই জোটে ইরাকের যোদ্ধা ও ইয়েমেনের হাউছিরাও অন্তর্ভুক্ত।
ইসরাইলের সামরিক বাহিনী এই মাসে বলেছে, লেবাননে আক্রমণের জন্য তাদের পরিকল্পনা ‘অনুমোদিত ও বৈধ’ করা হয়েছে। এরপর হিজবুল্লাহ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলে, পূর্ণাঙ্গ সংঘাত হলে ইসরাইলের কোনো অংশকেই রেহাই দেয়া হবে না। জাতিসঙ্ঘে ইরানের মিশন শনিবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বলেছে, তেহরান ‘লেবাননে আক্রমণ করার ইচ্ছা সম্পর্কে ইহুদিবাদী শাসকের প্রচারণাকে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ বলে মনে করে’। সেই সাথে চিরশত্রু ইসরাইলকে সতর্ক করে বলেছে, ‘ইসরাইল যদি পূর্ণ মাত্রায় সামরিক আগ্রাসন শুরু করে, তাহলে ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ শুরু হবে। এতে সব বিকল্প, সব প্রতিরোধ ফ্রন্টের সম্পূর্ণ সম্পৃক্ততা থাকবে।’